PROBANDHA | PALLAV MUKHAPADHAYA | MASTER DA | MUKTADHARA — 2025 FEBRUARY 5

প্রবন্ধ | পল্লব মুখোপাধ্যায় | অগ্নিপুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেন | মুক্তধারা | ২০২৫ ফেব্রুয়ারি ৫

সাহিত্যের পাতা

PROBANDHA  PALLAV MUKHAPADHAYA  MASTER DA  MUKTADHARA    2025 FEBRUARY 5

প্রবন্ধ | মুক্তধারা

অগ্নিপুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেন

পল্লব মুখোপাধ্যায়

 

“ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম
রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো । তিনি সংগঠনে বিভেদ না আসার
জন্য একান্তভাবে আবেদন করেন । শেষ দিনগুলিতে জেলে থাকার সময় তাঁর একদিন গান
শোনার খুব ইচ্ছা হল। সেই সময় জেলের অন্য এক সেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী
চৌধুরী। রাত ১১টা/১২টার দিকে কল্পনা দত্ত তাঁকে চিৎকার করে বলেন “এই বিনোদ,
এই বিনোদ, দরজার কাছে আয়। মাষ্টারদা গান শুনতে চেয়েছেন । বিনোদ বিহারী গান
জানতেন না। তবুও সূর্য সেনের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না
আসে তবে একলা চলো রে গানটি গেয়ে শোনান । ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি মধ্যরাতে
সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসী কার্যকর হবার কথা উল্লেখ করা হয়। সূর্য
সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে ব্রিটিশ সেনারা নির্মম ভাবে অত্যাচার করে।
চট্রগ্রামেই জন্ম সূর্য সেন-এর। বহরমপুর কে.এন. কলেজে পড়ার সময়েই ভারতের
স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবীবাদী ধারাটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। সূর্য সেন
বিশ্বাস করতেন, একমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামের পথেই ভারতের স্বাধীনতা অর্জন
সম্ভব।
চট্টগ্রামের স্কুল শিক্ষকের প্রখর ব্যক্তিত্ব, অজেয় মনোবল, প্রবল সাহস ও
দেশপ্রেমের টানে একে একে জড়ো হতে লাগলেন গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, লোকনাথ বল,
অম্বিকা চক্রবর্তীর মতো বিপ্লবীরা। পিছিয়ে রইলেন না মেয়েরাও৷ এলেন প্রীতিলতা
ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তের মতো অনেকে। মাস্টারদার নেতৃত্বে গড়ে উঠল ইন্ডিয়ান
রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা।
এর পরের ঘটনা ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামের অন্যতম উজ্জ্বল অধ্যায়। সূর্য সেন-
এর নেতৃত্বে ঝড় তুলে দিলেন বিপ্লবীরা। একের পর এক আঘাতে কেঁপে উঠল ব্রিটিশ।
অসংখ্য শহীদের রক্তে চট্টগ্রামের বুকে রচিত হল নতুন ইতিহাস।
‘...দাসত্বের দিন চলে যাচ্ছে। স্বাধীনতার লগ্ন আগত। ওঠো জাগো। জয় আমাদের
সুনিশ্চিত। ফাঁসির আগের দিন দেশবাসীর উদ্দেশে এই কথাগুলি চিঠিতে লিখেছিলেন
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের অদ্বিতীয় বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্য সেন।
ছোটবেলা থেকেই সূর্য সেন ছিলেন পরোপকারী। মানুষ, এমনকী পশুপাখিরও কষ্ট তিনি
দেখতে পারতেন না। পড়াশোনা শুরু হয়েছিল দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে, পরে হরিশ দত্তের
জাতীয় স্কুলে। এখানে মাস্টারমশাইদের কাছ থেকে প্রথম জানতে পারেন পরাধীন
ভারতবর্ষের মানুষের দুরবস্থার কথা। কলেজে পড়ার সময় শিক্ষকরূপে তিনি পান
বড়িশাল ষড়যন্ত্র মামলার পলাতক হেমেন্দ্রলাল মুখুটি ও বিপ্লবী নেতা সতীশ

চক্রবর্তীকে। স্নাতক হয়ে অঙ্ক শিক্ষক হিসেবে সূর্য সেন যোগদান করেন উমাতারা
উচ্চ বিদ্যালয়ে। হয়ে উঠলেন সবার প্রিয় ‘মাস্টারদা । ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খ্যাতি।
সূর্য সেনকে অনুপ্রাণিত করেছিল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা
‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটির জীবনদর্শন। তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তিতে তিনি ১৯১৭
সালে গড়ে তুললেন গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থা ‘সাম্য আশ্রম। তাঁর অনুগামীদের মধ্যে ছিলেন
অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, নির্মল সেন, অনন্ত সিংহ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,
কল্পনা দত্ত সহ আরও অনেকে। মাস্টারদা গড়ে তোলেন এক বিরাট বাহিনী।
১৯২৪ সালে জারি হয় ‘বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স। ১৯২৬ সালে গ্রেপ্তার করা হয়
মাস্টারদাকে। ১৯২৮ সালে কারামুক্তির পর আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির অনুপ্রেরণায়
স্বদেশীদের নিয়ে গড়ে তোলেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা। যার
প্রেসিডেন্ট হন তিনি নিজে। সূর্য সেনের বিপ্লবী জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল আয়ারল্যান্ডের ইস্টার
বিদ্রোহের দিনটিতেই মাস্টারদার নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী মুষ্টিমেয় অস্ত্রশস্ত্র
সম্বল করে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন | ব্যাপক আলোচনা ও
পরিকল্পনার পর, ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে, সূর্য সেন এবং তাঁর সহযোদ্ধারা
(ভারতীয় প্রজাতন্ত্র সেনাবাহিনীর ব্যানারে) 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' এবং
'সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে' স্লোগান দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। চট্টগ্রাম পুলিশের
হেডকোয়ার্টার ও অক্সিলিয়াটি ফোর্সের অস্ত্রাগার চলে আসে তাঁদের দখলে।
চট্টগ্রামকে অন্যান্য জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য উপড়ে ফেলা হয়েছিল
টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন যোগাযোগ। বিপ্লবীদের কারণে ব্রিটিশ শাসনের পদস্থ
কর্মচারীরা প্রাণভয়ে মাঝ সমুদ্রে জাহাজের ভিতর লুকিয়ে পড়েছিল। ৪৮ ঘণ্টার জন্য
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনমুক্ত সম্পূর্ণ স্বাধীন| তাঁদের
ছত্রভঙ্গ করার জন্য এরপর ইংরেজ শুরু করল গেরিলা যুদ্ধ। যুদ্ধ ক্ষেত্রে মাস্টারদা
সারাক্ষণ নির্দেশ দিতে থাকেন সবার মনোবল অটুট রাখার জন্য। বুকে হেঁটে বিপ্লবীদের
বন্দুকে গুলিও জুগিয়ে দেন। শেষপর্যন্ত তাঁরই নির্দেশে বিপ্লবীরা এবং তিনি নিজে
আত্মগোপন করেন। কিছুদিন পর আবারও মাস্টারদার পরিকল্পনায় শুরু হয় সশস্ত্র
বিপ্লব—পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ। ইংরেজ মাস্টারদাকে গ্রেপ্তারের
জন্য অনেক টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তাঁকে গ্রেপ্তার করতে এসে ক্যাপ্টেন
ক্যামারুন নিহত হন। কিন্তু ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জ্ঞাতিভাই নেত্র সেনের
বিশ্বাসঘাতকতায় গৈরালা গ্রামে ধরা পড়ে যান মাস্টারদা| বিচারের নামে চলে
প্রহসন|ফাঁসির সাজা হয় মাস্টারদা সূর্য সেন-এর। অবশ্য তার আগেই সেই
বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেন ও মাস্টারদার গ্রেপ্তারের জন্য দায়ী পুলিস অফিসার

মাখনলাল — দুজনেই বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের
ইতিহাসে মাস্টারদা সূর্য সেন-এর ভূমিকা চিরস্মরণীয়।
১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি অর্থাৎ আজকের দিনে ফাঁসি হয় এই মহান বিপ্লবী নেতা
তথা সকলের প্রিয় মাস্টারদা সূর্য সেন-এর |

Comments :0

Login to leave a comment