Special session

নিরবাচন কমিশন বাছাইয়ে বিতর্কিত বিল পাসই লক্ষ্য!

জাতীয়

আজ দুপুরেও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী টুইট করেছেন, এখনই জানানো যাবে না বিষয়বস্তু। রবিবার বিকেলে সর্বদলীয় বৈঠকে আসুন, জানিয়ে দেওয়া কী কী নিয়ে আলোচনা হবে। সেই টুইটের প্রতিক্রিয়াতেই কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের তীব্র কটাক্ষ, ‘বিশেষ অধিবেশনে আলোচনার বিষয় সম্ভবত একজনই, খুব বেশি হলে আরেকজন জানতে পারেন।’ মোদী-শাহকে নিয়ে কড়া ঝাঁঝের এই কটাক্ষের কয়েক ঘন্টা পরই অবশ্য আপাত নির্বিষ এক সংসদীয় বুলেটিন ইস্যু করা হলো কেন্দ্রের তরফে। যাতে বলা হয়েছে ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া পাঁচদিনের এই বিশেষ অধিবেশনে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত বিলটি আলোচনায় উঠবে। ‘অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের’ নামে এই কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতি পালটাতে চেয়ে আনা মোদী সরকারের এই বিলটি নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক রয়েছে। দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বাছাই প্রক্রিয়া থেকে দেশের প্রধান বিচারপতিকে ছেঁটে ফেলতে এই বিলটি আনা হয়েছে। নতুন বিলে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তাঁরই মনোনীত একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা নিয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার কথা বলা হয়েছে। বিরোধীদের তরফে আপত্তি সত্ত্বেও সেই বিলটাই অধিবেশনের শুরুতে আলোচনায় আনতে চাইছে মোদী সরকার। 
কেন, কী কারণে পাঁচ দিনের সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হলো তা নিয়ে জল্পনা রয়েছেই। বিরোধীরা বার বার জানতে চেয়েছে, সবে মাত্র শেষ হওয়া বাদল অধিবেশন এবং আগামী শীতকালীন অধিবেশনের মাঝে এমন কী দরকার পড়ল যে, আবার একটা অধিবেশন ডাকতে হচ্ছে! কিন্তু ‘এক দেশ, এক ভোট’ থেকে সাধারণ নির্বাচন এগিয়ে আনা থেকে ইন্ডিয়ার বদলে দেশের নাম ‘ভারত’ করার সম্ভাবনার কথা ঘোরাফেরা করছে। বিরোধীরা বার বার কী নিয়ে হঠাৎ করে বিশেষ অধিবেশন ডাকা হলো, তা জানতে চাইলেও নির্বিকার থেকেছে সরকারপক্ষ। এমনকি এনিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রী মোদীকে চিঠিও দিয়েছিলেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী। জবাব না দিয়ে সেই সময় উলটে সোনিয়াকে কটাক্ষ করেছিলেন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী। যেমন ধোঁয়াশা তৈরি করে রাখাই লক্ষ্য হয় বিজেপি’র, চলছিল সেই ভাবেই। সেই যোশী ‘এক্স’ (আগের টুইটার) হ্যান্ডেলে জানিয়ে দেন ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে চারটেয় বিশেষ অধিবেশন নিয়ে সর্বদলীয় সভা ডাকা হয়েছে। অর্থাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে সংসদে বিশেষ অধিবেশন বসার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে সব দলকে নিয়ে আলোচনায় বসবে সরকারপক্ষ! তবে আলোচ্য বিষয় এখনও প্রকাশ করা হয়নি। তিনি শুধু জানিয়েছেন, ‘চলতি মাসের ১৮ তারিখ সংসদ অধিবেশন বসার আগে সব দলের নেতাদের নিয়ে ১৭ তারিখ বিকেল সাড়ে চারটেয় বৈঠক হবে। সংশ্লিষ্ট নেতাদের ই-মেল মারফত আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে।’ কর্নাটকের সাংসদ যোশী ওই বিবৃতির আবার কন্নড় ভাষাতেও অনুবাদ করে পোস্ট করা হয়েছে।
দুপুর আড়াইটেয় সংসদীয় মন্ত্রীর এমন টুইটের পর রাত সাড়ে নটায় হঠাৎই প্রকাশ হলো সংসদীয় বুলেটিন। সেখানে লোকসভায় পাস করিয়ে নিলেও রাজ্যসভায় আটকে থাকা কয়েকটি বিল পাস করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে। তেমনই বিতর্কিত আরেকটি বিল ‘প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রৃশন অব পিরিওডিক্যালস বিল ২০২৩’ রয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের অধিকার খর্ব করার এই বিল নিয়ে এডিটর্স গিল্ড সহ বিভিন্ন মহল থেকেই আপত্তি রয়েছে। লোকসভার মহাসচিক উৎপল কুমার সিংয়ের জারি করা এই বুলেটিনে বলা হয়েছে, ৭৫ বছরের সংসদীয় সফর নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বিশেষ অধিবেশনে বেশ কিছু সংসদীয় কাজও হবে। তার মধ্যে রাজ্যসভায় পাস হওয়া অথচ লোকসভায় আটকে থাকা দুটো বিল আসবে আলোচনায়। তারই একটি প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রৃশন অব পিরিওডিক্যালস বিল ২০২৩’। এবং আরেকটি হলো অ্যাডভোকেট (সংশোধনী) বিল। এছাড়াও রাজ্যসভায় পেশ হয়ে যাওবা অথচ স্ট্যান্ডিং কমিটিতে না পাঠানো দুটো বিল নিয়ে আলোচনার কথাও বলা হয়েছে। তার একটি পোস্ট অফিস বিল, ২০২৩ এবং নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ের বিলটি। 
বুলেটিন প্রকাশের পর অবশ্য রাজনৈতিক মহলে খানিকটা ‘পর্বতের মুষিক প্রসবের’ সঙ্গে বিশেষ অধিবেশন তুলনা শুরু হয়েছে। তবে বিজেপি, বিশেষ করে মোদী সম্পর্কে পোড় খাওয়া রাজনৈতিকরা অবশ্য বলছেন, তড়িঘড়ি প্রকাশ করা দেওয়া এই বুলেটিন আসলে মুখোশ। এখনও মোদী আড়ালেই রেখেছেন আসল ছক। কারণ ভোটের আগে মোদী্র এই অধিবেশন অনেক হিসেব কষেই ডেকেছেন এমনটাই আশঙ্কা রাজনৈতিক মহলের। 
সদ্য সমাপ্ত জি-২০ শীর্ষ বৈঠকের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ইন্ডিয়া’র বদলে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’ বলে উল্লেখ করার পর আরও বড় ধরনের জল্পনা উসকে দিয়েছে। তাহলে কি দেশের নাম পাকাপাকিভাবে ‘ভারত’ রাখার কৌশলেই সংসদের বিশেষ অধিবেশনের আয়োজন? এরই সঙ্গে ‘এক দেশ, এক ভোট’ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে কমিটিও গঠন করে ফেলা হয়েছে। এবিষয়টিও বিশেষ অধিবেশনে আলোচ্যসূচিতে রাখা হবে কীনা, তা নিয়েও জোর আলোচনা রয়েছে। অসমর্থিত সূত্রে জানা গিয়েছে, লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে সংসদে মোদী তাঁর ’৫৬ ইঞ্চি ছাতি’র আস্ফালন আরও বেশি করে দেখাতেই বিশেষ অধিবেশনের আয়োজন। সেখানে জি-২০ বৈঠকের প্রেক্ষিতে মোদীর ‘বিশ্বগুরু’ ভাবমূর্তি, ‘দেশের উন্নয়ন’-এর পাশাপাশি চন্দ্রযান ৩’র সাফল্য তুলে ধরতে চাইবে সরকারপক্ষ। এও জানা গিয়েছে, ১৮ তারিখ অর্থাৎ প্রথম দিন বাদ দিয়ে বিশেষ অধিবেশনের বাকি চারদিন বসবে সংসদের নবনির্মিত ভবনে। এরই মাঝে দেশে গণেশ পুজো রয়েছে। আবার সংসদ অধিবেশন আগের দিনই রয়েছে মোদীর ‘স্বঘোষিত জন্মদিন’। গণেশ পুজোর মধ্যে অধিবেশন ডাকায় সূচি পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে শিবসেনা (উদ্ধব গোষ্ঠী) এবং এনসিপি।
বিশদে কিছু না জানিয়ে সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী যোশীর বিবৃতি নিয়েও এদিন তীব্র সমালোচনা করেছেন। অধিবেশন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে সব দলকে আলোচনায় ডাকার যুক্তি কী, সেনিয়েই সরব হয়েছে বিরোধীরা। জয়রাম রমেশ যেমন ‘ওই দুজনেই জানেন আলোচ্য বিষয়’ বলে কটাক্ষ করে অতীতে এই ধরনের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হলে কত আগে তা জানিয়ে দেওয়া হতো, সেকথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘মোদী সরকারই সংবিধানের যাবতীয় রীতিনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।’’ রমেশের সুরেই মোদী সরকারকে আক্রমণ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। সিপিআই’র সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা মনে করেন, ‘‘এই ধরনের বিশেষ অধিবেশন ডাকার আগে সরকারের উচিত ছিল বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া। কেউই জানেন না বিশেষ অধিবেশনের আলোচ্য বিষয় কী? কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন সবাই?’’
বিরোধীদের মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’র তরফে আগেই বলা হয়েছিল, ‘‘দেশবাসীর পাশাপাশি সাংসদরা পর্যন্ত জানেন না কী কারণে আচমকা সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে দেওয়া হলো। ওই অধিবেশনে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে তা জানানো উচিত সরকারপক্ষের। অথচ গোটা দেশকে এবিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখেছে বিজেপি। এই প্রশ্নে স্বচ্ছতা কিংবা দায়বদ্ধতা দেখাতে ব্যর্থ শাসকগোষ্ঠী। আমরা ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের সাংসদরা মনে করি, দেশের এই মুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ, জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত বিশেষ অধিবেশনে। এই আলোচনা হলে আমরা সদলবলে তাতে অংশ নেব এবং প্রয়োজনে পরামর্শ দিতেও প্রস্তুত। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে আমরা ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই চলব।’’ 
একইভাবে বিশেষ অধিবেশনের আলোচ্য বিষয় জানানো হয়নি অভিযোগ করে গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী। তবে তিনি শুধু অভিযোগ করেই ক্ষান্ত হননি, বিশেষ অধিবেশনে এই মুহূর্তে দেশের কী কী সমস্যা বা সঙ্কট নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত, এমন ৯টি বিষয় বিশদভাবে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব থেকে মণিপুরের হিংসা, হরিয়ানায় ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, আদানিকাণ্ডে যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) দিয়ে তদন্ত কিংবা শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) প্রতিশ্রুতি রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘‘কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করেই সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। সেই অধিবেশনে কী নিয়ে আলোচনা হবে, তা আমরা কেউই জানি না। আমাদের শুধু বলা হয়েছে, সরকারের বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু এই অধিবেশনে আলোচনায় অংশ নিতে আগ্রহী তাঁরা। তার কারণ, দেশবাসীর সমস্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ এসে গিয়েছে আমাদের কাছে। আমরা আশা করব, এইসব জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা বা বিতর্কের জন্য যথেষ্ঠ সময় দেওয়া হবে।’’

Comments :0

Login to leave a comment