প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়
এই দুরন্ত গরম আর পয়লা বৈশাখের সঙ্গে বেশ ঘন মিল রয়েছে টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ার। গা জ্বালিয়ে দেওয়া গরম, তার সঙ্গে নতুন পোশাকের গন্ধ। এসবের সঙ্গে স্টুডিওর অন্দরমহলে ক্ল্যাপস্টিকের ঠক ঠক শব্দের এক অদ্ভুত যুগলবন্দী থাকে।
প্রত্যেক বছর স্টুডিওপাড়ার এই নুতন মেজাজের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা জানেন একসময় কী ঘটত।
সারা প্রকৃতি যখন গরমে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে, রাস্তায় গাড়ি, লোকজন কম। তখন কিন্তু খাঁ খাঁ রোদ্দুরে স্টুডিওপাড়া সরগরম থাকত। নামি দামি শিল্পীরা আসতেন। ফ্লোরের চাপা গরমে বসে কুলকুল করে ঘামতে ঘামতে ঠান্ডা পানীয়ের বোতলে চুমুক দিতেন।
এই মেজাজ মর্জি থেকে বাদ যাননি তাবড় তাবড় পরিচালক, প্রযোজকরা। বাদ যাননি উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেনের মত জনপ্রিয় শিল্পীরাও। তাঁরা পয়লা বৈশাখের এই দিনটাতে সাজগোজ করে হাজির হতেন স্টুডিওর ফ্লোরে। হাইস্পিড ফ্যানের হাওয়ায় তাঁদের মেকআপ এলোমেলো হত বৈকি। তার সঙ্গে জবজবে হয়ে উঠতেন গরমের আদরের ঘামে।
এসব হওয়ার পর হঠাৎ করে প্রযোজক মশাই আসতেন। পরিচালক প্রস্তুত হতেন। সহ পরিচালক খাতা খুলে পড়িয়ে নিতেন দু’চারটি ডায়লগ। তারপরই পরিচালক চিৎকার করতেন, পাখা বন্ধ, ক্যামেরা, আলো, ট্রলি।
সহ পরিচালক দৌড়ে গিয়ে ট্রলির ওপর বাঁক নেওয়া ক্যামেরার সামনে কাঠের চারচৌকো বোর্ডটা তুলে ধরতেন। সেখানে ছবির নাম লেখা, শট নম্বার দেওয়া। সিনের নম্বার দেওয়া। পরিচালক বলে উঠতেন অ্যাকশন। নিশব্দময় হয়ে পড়ত ফ্লোর। বাইরে থেকে ভেসে আসত অবাধ্য কাকের কা কা ধ্বনি। তারই মধ্যে নায়ক নায়িকার আদুরে সামান্য ডায়লগ। পরিচালক চিৎকার করতন, কাট। আবার চলতে শুরু করত পাখা। জ্বলে উঠত আলো।
এভাবেই বছরের শুরুর দিনটা শুরু হত স্টুডিওয়। যাকে বলে স্টুডিওর হালখাতা পর্ব। এই পর্ব বেশ কয়েক বছর আগেও হয়েছে। প্রবীণ থেকে নবীন শিল্পীরা স্টুডিওপাড়ার পয়লা বৈশাখকে এভাবেই চিনতেন। এই মহরত শেষ হবার পর আসত খাওয়া দাওয়ার পালা, শেষে মিষ্টিমুখ।
ক্রমে সেই মেজাজ হারিয়েছে টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়া। বৈশাখের স্টুডিও বাঙালিয়ানাকে পরাস্ত করে কালচারের বদল ঘটে গেছে আমাদের সকলেরই চোখের সামনে। এখন আর সেই বাঙালি সাজগোজে অনেকেই আসেন না নববর্ষে স্টুডিওপাড়ায়। এলেও সংখ্যাটা এত নগণ্য যে চোখেই পড়ে না। খাঁ খাঁ স্টুডিওয় পোশাকের নতুন গন্ধ, মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে ‘কেমন আছেন দাদা’ এক সহকর্মীর আরেক কর্মীকে জিজ্ঞাসা নেই। পারফিউম মাখা সুদৃশ্য রুমাল নামি শিল্পীদের বা সাধারণ স্টুডিওকর্মীদের পকেট থেকে বেরিয়ে বারবার চোখ মুখের ঘাম কেউ মোছেন না। বিশাল বিশাল ফ্লোরগুলো চুপচাপ পড়ে থাকে বেশিটাই। বৈশাখের সেই কড়া চেনা রোদ্দুর এখনও স্টুডিওর ইতিউতি পড়ে থাকে। সেই রোদ্দুরে শুধু চেনা মুখগুলো আসে যায় না।
বদলেছে এই কালচার। যেমন টালিগঞ্জের প্রযোজনার ক্ষেত্রে টাকা আসা যাওয়ার দৃশ্য বদলেছে। অনেক ছবিতেই ঢুকে যাচ্ছে অচেনা টাকার পাহাড়। তাই কখন যেন নববর্ষের এই স্বচ্ছতাকে ডিঙিয়ে ক্ল্যাপস্টিকের আওয়াজ হাওয়া হয়ে গেছে। বিনিময়ে বড় বড় হোটেলের ঠান্ডা ঘরে জমে ওঠে পয়লা বৈশাখের অন্য ক্ল্যাপস্টিক। সেখানে চৌকো কাঠের বোর্ডে লেখা থাকে না ছবির নাম, শট নম্বার।
ইদানিংকার দেখনদারির সময়ে অন্য ভাবে উদযাপিত হয় স্টুডিওপাড়ার পয়লা বৈশাখ বা হালখাতা। যা মনের খাতায় আর আঁক কাটে না, চোখ ধরে রাখে সাজানো গোছানো আন্তরিকতাহীন কিছু দৃশ্যাবলী। কেউ শুনতে পান না আর অ্যাকশন, কাট’র অদ্ভুত শব্দগুলো।
চিরদিনই নিয়ম নীতিতে হয়ত বা বদল ঘটে, কিন্তু এভাবে!
অলঙ্করণ: মনীষ দেব
Comments :0