Fascism

ফ্যাসিবাদীরা আপনার দোরগোড়ায়

সম্পাদকীয় বিভাগ

ভারতের সংবিধানে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার ১৯(১)(এ) ধারাতে সুরক্ষিত করা হয়েছে। এই ধারায় ভারতের নাগরিকদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়া আছে। এই অধিকার সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত একটি মৌলিক অধিকার, কারোর করুণা নির্ভর নয়। কিন্তু দেশের মানুষের এই অধিকারকে কেড়ে নিতে তৎপর দেশের নয়া ফ্যাসিবাদী এবং বিভিন্ন স্বৈরাচারী শাসকরা। এটা ঠিক, এই অধিকার কিছু সীমাবদ্ধতা এবং শর্তাবলী দ্বারা আবদ্ধ। সংবিধানেরই ১৯(২) ধারা অনুযায়ী, সরকার কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করতে পারে, যদি তা জাতীয় নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্বের জন্য বিপজ্জনক কোনও মন্তব্য বা মতামত কেউ প্রকাশ করেন। অর্থাৎ এই ধারা অনুযায়ী, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার সীমাবদ্ধ করা হতে পারে যদি তা রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী হয়। এটাও উল্লেখ করা আছে, ব্যক্তিগত বা সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তাদের সম্মান বা খ্যাতি ক্ষুণ্ণ করার জন্য মতামত প্রকাশ করা যাবে না, জনসাধারণের শালীনতা বা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর বক্তব্য রাখা, ভুল তথ্য বা মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যাবে না। সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্য বিপদে পড়বে এমন বক্তব্যও রাখা যাবে না। তা এর মধ্যে কোনটা লঙ্ঘন করেছেন এই শিল্পী? দলবদলু, ক্ষমতার জন্য ডিগবাজি খেতে পারদর্শী রাজনৈতিক নেতাকে বিশ্বাসঘাতক বলা নাকি সংবিধান বিরোধী, এমনই বিচিত্র আবদার আরএসএস-বিজেপি’র! মহারাষ্ট্র সরকারের বর্তমান উপমুখ্যমন্ত্রী দলবদল করে প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী, তারপরে উপমুখ্যমন্ত্রী হন। ক্ষমতার জন্য দলবদলু এই নেতাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে একটি প্যারোডি গান করেন গত রবিবার একজন জনপ্রিয় কৌতুকশিল্পী, একটি টিভি শোতে। সেজন্য তার বিরুদ্ধে ৬টি এফআইআর করেছে মুম্বাই পুলিশ আর বৃহণ্মুম্বাই পৌর কর্পোরেশন এই মৌলবাদীদের সঙ্গে মিলে যে স্টুডিওতে শ্যুটিং হয়েছে, সেটি ভেঙে দিয়েছে। সঙ্ঘ পরিবারভুক্ত বিভিন্ন উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে, যেখানে এই শিল্পীকে দেখা যাবে সেখানেই তাকে উত্তম মধ্যম দেওয়া হবে। কোথাও তাকে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হবে না। এই হামলা, প্রকাশ্য মারধরের হুমকি এগুলো কি সাংবিধানিক নাকি? এই প্রথম নয় তার ওপর আক্রমণ। এর আগেও সঙ্ঘ পরিবার ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিককে নিয়ে কৌতুক করার জন্য তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করা হয়েছিল। দেশের বিমান সংস্থাগুলোকে চাপ দিয়ে ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়েছিল, এই শিল্পীকে বিমানে চড়তে দেওয়া হবে না। তবে এই শিল্পীও মাথা নত করেননি। বরং রুখে দাঁড়িয়েছেন, জানিয়ে দিয়েছেন তিনি কোনোভাবেই মাথা নত করবেন না এই মৌলবাদী উগ্রবাদীদের কাছে। তার সাফ কথা, “আমি ক্ষমা চাইব না। আমি যা বলেছি, তা এর আগে অজিত পাওয়ারও (মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী) বলেছিলেন একনাথ শিন্ডে সম্পর্কে। আমি উন্মত্ত জনতাকে ভয় পাই না এবং কোনোভাবেই খাটের তলায় লুকাবো না।” 
সরকারের সমালোচনা করার অধিকার গণতন্ত্র রক্ষার অন্যতম একটা প্রাকশর্ত। অথচ বিগত ১০ বছর ধরে আমাদের দেশের শাসকদল বিজেপি বিন্দুমাত্র সমালোচনা সহ্য করতে রাজি নয়। এমনকি ব্যঙ্গচিত্র, কমেডিতেও সরকারের সমালোচনা করলে চলছে হামলা, মামলা। কখনও সিনেমা হলে হামলা ভাঙচুর, কখনও চিত্র প্রদর্শনীতে ভাঙচুর, কোথাও নাটকের ওপর হামলা। আরএসএস-বিজেপি সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতাদের মনপসন্দ নয়, এমন কোনও নাটক, সিনেমা, চিত্রকলা, গান সৃষ্টি করলেই সাথে সাথে মামলা, হামলা, জেলবন্দি করা– এটাই মোদী সরকারের রীতি। নয়া ফ্যাসিবাদীরা এখন আপনার দরজায় পৌঁছে গেছে। মানুষের ঘরে ঢুকে পড়ছে তীক্ষ্ণ নখ, দাঁত বের করে হিংস্র চেহারায়। রুখে দাঁড়াতেই হবে। বহু লড়াইয়ে অর্জিত বাক্ স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, প্রতিবাদের অধিকারকে বিসর্জন দিতে দেওয়া যায় না। ফ্যাসিবাদীদের সামনে মাথা নত করা নয়, রুখে দাঁড়াতে হবে সব মানুষকেই।

Comments :0

Login to leave a comment