Post editorial on mrinal sen

ভগ্নস্তূপ ও ব্রুটাসের ট্রিলজি

উত্তর সম্পাদকীয়​

 সম্রাট মুখোপাধ্যায়

"এট টু ব্রুটাস!"তুমিও, হায়, ব্রুটাস!
এটা বলার জন্যই যেন তৈরি হয় মৃণাল সেনের তিন ছবি ‘আকালের সন্ধানে’(১৯৮০), ‘খণ্ডহর’ (১৯৮৩) আর ‘অন্তরীণ’ (১৯৯৩)। মৃণাল সেনের ধ্বংসস্তূপ ত্রয়ী।
না, মৃণাল সেন এই তিন ছবিকে কখনও এক বন্ধনীতে ‘ট্রিলজি’ বলে চিহ্নিত করেননি। যেভাবে ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’ আর ‘পদাতিক’-কে তিনি কলকাতা-ট্রিলজির মর্যাদা দিয়েছেন। এই তিনটি ছবি একত্রে সাতের দশকে যৌবনের বজ্রনির্ঘোষের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে থাকা ক্রোধ, জড়িয়ে থাকা রোমান্টিসিজম আর ঝরে পড়ার উদ্বেগকে মনে করায়। এরা দাঁড়িয়ে থাকে কাহিনিচিত্রের প্রশস্ত বৈঠকখানা আর দলিলচিত্রের বিশ্বস্ত স্থাপত্য নিয়ে। ফিচার আর ডকুমেন্টারির করমর্দনে। এরা নিঃসন্দেহে একটি ট্রিলজি। খালি অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা একই মরজিমেজাজের ‘কোরাস’-কে এর অন্তর্ভুক্ত করলে যা দাঁড়ায় একটি ‘কোয়াট্রেট’ বা চতুষ্কে।
আবার নানা সাক্ষাৎকারে মৃণাল সেন মনে করিয়ে দিয়েছেন তাঁর মধ্যবিত্ত জীবনকেন্দ্রিক তিন ছবি ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘খারিজ’ আর ‘একদিন অচানক’ বিদেশের দর্শকদের কাছে পরিচিত এক ত্রয়ী হিসাবেই। সেখানকার সমালোচকরা এদের চেনে ‘অ্যাবসেন্ট ট্রিলজি’ হিসাবে। প্রথম ছবিতে একটি কাজ করতে বেরোনো মেয়ে রাতে বাড়ি ফেরে না। দ্বিতীয় ছবিতে একটি বাচ্চা ছেলে গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে এসে এক বাড়িতে রাতে বন্ধ ঘরে শুয়ে মারা যায়। তৃতীয় ছবিতে এক বয়স্ক ব্যক্তি একদিন হঠাৎই নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এই অনুপস্থিত হয়ে যাওয়াগুলোই অবশ্য মনে হয় একমাত্র সূত্র নয়, এদের এক সুতোয় গাঁথার। এই তিন ছবির চিত্রনাট্যেই পরতে পরতে খসে পড়ে মধ্যবিত্তের তৈরি করা নানা ‘বুলি’, নানা মূল্যবোধ। ফলে এরা ত্রয়ী হয়ে ওঠে সমালোচকদের চোখে। মৃণালও তাকে মান্যতা দেন।
এই তাঁর বিখ্যাত দুই ত্রয়ী।
এখানে বলা ভালো তাঁর আরও দুটি ছবিকে যে তিনি একই বন্ধনীতে দেখতে অভ্যস্ত সে কথা তিনি বিজ্ঞাপনেও ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর যে ছবি দিয়ে ভারতীয় সিনেমার দ্বিতীয় নবতরঙ্গ শুরু, সেই ‘ভুবন সোম’- এর সঙ্গে নিজের শেষতম ছবি ‘আমার ভুবন’-কে জুড়ে নিয়েছিলেন এক বিজ্ঞাপনী উল্লেখে। ‘‘মৃণাল সেনের দুই ভুবন’’ এই অভিধায়। জুড়ে গিয়েছিল বনফুল আর আফসার আহমেদের রচিত আখ্যান। জুড়ে গিয়েছিল ১৯৬৯ আর ২০০২। তেত্রিশ বছর সময়কালের সিনেমা জার্নির দু’টি স্টেশন। তবে এখানে ট্রিলজি হয়নি। মৃণাল সেন আর ছবিও করেননি।
এ লেখার শুরুতে বলা শেক্সপিয়ারীয় উক্তি বা ‘ধ্বংসস্তূপ ট্রিলজি’র স্থানাঙ্ক তবে কোথায়? তাদের আমরা কীভাবে একত্রে পড়ব?



------

সেবার মৃণাল সেন এক বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবে গেছেন। দেখা হলো সাহিত্যিক বন্ধু গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সঙ্গে। মার্কেজ মৃণালকে বললেন তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক’ থেকে সিনেমা করতে। মার্কেজের ধারণা এই উপন্যাসের প্রতি সুবিচার একমাত্র মৃণালই করতে পারবেন। কারণ এই উপন্যাসের কথা মার্কেজের মাথায় আসে ভারতীয় এক পরিত্যক্ত প্রাসাদের ছবি দেখে। তিনি এটাও দেখেছেন যে মৃণালের বহু ছবিতেই এই পরিত্যক্ত প্রাসাদের ছবি থাকে। তারা ইতিহাসের এক একটি মূর্ত স্বাক্ষরের মতো আসে।
মৃণালের নিজের কথায়, ‘‘আমি পুরাতত্ত্বের ভক্ত নই,আমি সারাজীবন এই মুহুর্তের জন্য বেঁচে থেকেছি। ধ্বংসস্তূপ বা অতীতকে আমি বর্তমানের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করি। যখনই আমি অতীতের এইসব উদাহরণের মুখোমুখি হয়েছি, আমি তাদের মিউজিয়ামের টিকিট লাগানো সংগৃহীত বস্তু বলে মনে করিনি। আমি তাদের সাম্প্রতিক জীবনযাত্রার অঙ্গ বলেই মনে করেছি।’’
এইভাবে এই ধ্বংসস্তূপ যে বারবার ফিরে আসে মৃণাল সেনের ছবিতে, তা আসে নিছক  একটা কালচারাল বা আর্কেটাইপাল স্পেস হিসাবে নয়, আসে ইতিহাসের ভেতরে থাকা নানা শ্রেণি সংগ্রাম আর শ্রেণি সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত হিসাবেও। পড়ন্ত সামন্ততন্ত্রের এক ভগ্ন সাক্ষ্যকে প্রেক্ষাপটে রেখে পরতে-পরতে খুলতে থাকে মধ্যবিত্তের যত আত্মপ্রবঞ্চনা। স্মৃতিকাতরতার আড়ালে। অতীতকে খাড়া করে তার সেই স্মৃতিকাতরতাকে সম্বল করে সে যে তার বর্তমান থেকে আসলে পালাতে চায়, তার সাময়িক দলিলকেই বিন্যস্ত করেন মৃণাল। এবং সেক্ষেত্রে তাঁর বর্শাফলকের লক্ষ্য সাংস্কৃতিকভাবে অগ্রবর্তী যে মধ্যবিত্ত, তারা। তার আড়ালে হয়ত থাকে অগ্রবর্তী চেতনার অধিকারী বলে পরিচিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী বা ‘কালচারাল লেফট’-এর জানা-না-জানা ভীরুতা-দ্বিধাগ্রস্ততার চোরাটান। সাতের দশকে ‘বসন্তের যে উত্তাল বজ্রনির্ঘোষ’ তাঁকে, তাঁর সিনেমাকে তোলপাড় করেছিল হয়ত থাকে সেই লড়াই কেন সফল হলো না, কেন কিছুদূর গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল, কোন পিছুটানে, কোন অংশটির ভীরুতায়-দুর্বলতায় তারও বিশ্লেষণ।
তাই বলা মার্কেজকে স্মরণে রেখে এদের ‘ধ্বংসস্তূপ ত্রয়ী’ও বলা যায়। আবার শেকসপিয়রকে টেনে এনে এদের ‘ব্রুটাস ট্রিলজি’ও বলা যায়।



------

‘আকালের সন্ধানে’ দেখতে বসে আমরা বুঝতে পারি সত্তরের ঝড় থেমে গেছে। বাইরে এবং ছবির ভেতরে। রাগ বিশ্লেষণে ও আবেগে দ্রবীভূত। ‘কোরাস’ (১৯৭৪)-এর মতো এখন আর শহুরে শ্রমিকদের বিশাল মিছিল গ্রামে যায় না। ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো’র বদলে গ্রামেই আসে এক শুটিং পার্টি। না, বিপ্লব ‘ডিপোর্ট’ করতে নয়। এক বিশেষ কালপর্বের শ্রেণিচেতনার ছবি করতে। উদ্দেশ্য আকালের ছবি তোলা। অমলেন্দু চক্রবর্তীর মূল উপন্যাসে শুটিং পার্টি উঠেছিল ছুটি-শুরু-হওয়া স্কুলবাড়িতে। এখানে মৃণাল তাদের নিয়ে আসেন এক অতীতের ভগ্নমান জমিদার বাড়িতে। যাকে ঘিরে আছে এক প্রাচীন দেবদেউল। যে রক্ষণশীল মূল্যবোধ এই ছবির পরতে পরতে আমরা দেখব, তারই প্রতীক হিসাবে যেন ঐ প্রাসাদ দাঁড়িয়ে।
যখন শুটিং পার্টি গাড়ি নিয়ে ঢোকে গ্রামে,সর্বাঙ্গে দারিদ্র পীড়িত এক মানুষ বলে ওঠেন,‘‘বাবুরা আমাদের আকালের ছবি তুলতে এসেছেন, আকাল তো আমাদের সর্বাঙ্গে।’’ তখনই স্পষ্ট হয়ে যায় পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি। ঐ ছবির শুটিং খানিকটা হয়। সেই সুবাদে মৃণাল সেনের চিত্রনাট্য (যা তিনি অনেকটাই শুটিং স্পটে গিয়ে ঠিক করেন) আমাদের ভ্রমণ করায় দুটি বাস্তবতায়। একটি যা অতীতের, আকালের দিনগুলোর। যা পুনর্নির্মিত হচ্ছে সিনেমায়। আর একটি সমকালের। যার ভেতরে থেকে আমরা শুটিংটা দেখি। কিন্তু এই দুটি বাস্তবতা সমান্তরালে চলে না। চলে দ্বন্দ্বময়ভাবে। সমকালের ওপরও ছাপ আছে আকালের দিনগুলোর স্মৃতির। সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি সে সময় গ্রামে আসা শহুরে লোভী, নারী লোলুপ কনট্রাক্টর দলের। পেছনে জমিদার বাড়িকে রেখে তিনি যেন মনে করিয়ে দেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গ্রামে আসা নব্য জমিদারকূলের কথাও। গ্রামগুলোর ক্রমাগত শহরের উপনিবেশ হয়ে যাওয়ার কথা। এই যে শুটিং পার্টি যারা আকালের বা অনাহারের ছবি করতে এসেছে তারা বাজার দর চড়িয়ে দেয়, তাদের রান্নাঘরে ছড়াছড়ি যায় ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন, তাদের ফেলে দেওয়া সিগারেট আর প্রসাধন সামগ্রীর প্যাকেট/কৌটো কুড়িয়ে খুশি হয় শিশুরা! এইভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, আকালের কালের ভোগী সম্প্রদায় আর একালের বিলাসে অভ্যস্ত সমাজতন্ত্রী শিল্পীদের এক মাত্রায় আনেন মৃণাল।
তার চেয়েও বড় কথা, গ্রামের মানুষদের সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয় শুটিং দলটি। যাদের জন্য একটি ‘বিপ্লবী’ শক্তি কাজ করছে, তাদেরকে তার গুরুত্ব বোঝাতে ব্যর্থ হলে কী করুণ অবস্থা হয়, তা খুলে দেখান তিনি। শুটিং ‘দরকচা’ মেরে খানিকটা হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। শুটিং দল শহরে চলে আসে। গ্রাম পড়ে থাকে গ্রামে। অনেক বুলি কপচেও এই দলের পরিচালক (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) বা অন্য কেউ কোনও সম্পর্কই স্থাপন করতে পারে না গ্রামের অভাবী মানুষদের সঙ্গে। ছবির শেষ কিন্তু এই শহুরে দলটির নীরব প্রস্থানেই শেষ করেন না মৃণাল সেন। বরং শহুরে মানুষদের অজানা এক কাহিনিতে ছবির শেষ ফ্রেমগুলো গ্রথিত হয়। সেখানে দুর্গা (শ্রীলা মজুমদার) নামের এক অভাবী গ্রামীণ মেয়ে, যে ঐ ইউনিটে ফাইফরমাশ খাটত, সে নির্বাসিতের মতো পড়ে থাকে পেছনে। অভাবের তাড়নায় তার শিশু সন্তানটি মারা যায়, অসুস্থ স্বামী নিখোঁজ হয়ে যায়।
এই সময়েই নেমে আসে আকাল। অথচ তার ছবি তোলার ক্ষমতা নেই ঐ ‘মানবিক’ পরিচালকের।



------

এই নির্বাসিতের আখ্যানই আরেকবার ফিরে আসে, মাঝে দুটি ছবি পার করে আবার যখন তিনি ‘খণ্ডহর’ বানান। এবারের কাহিনি প্রেমেন্দ্র মিত্রের। তাঁর সেই বিখ্যাত গল্প ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’। এখানেও শহরের গ্রামের কাছে আসা। প্রতিশ্রুতি নিয়ে। সরাসরি প্রতিশ্রুতি দিতে। এবং নিষ্ফলা ফিরে যেতে। সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে চালু বঞ্চনার গল্পের আর এক অনুক্রম। আজকের গ্রামহিতৈষণার ছদ্মবেশে।
এখানে শহরের তিন যুবক গ্রামে আসে ‘উইক এন্ড’ কাটাতে। এখন শহর আরও নির্মম। আরও মনহীন। তাই ভগ্নস্তূপের ভেতর যামিনী (শাবানা আজমি) নামের এক নারীরত্নকে খুঁজে পেয়েও, তাকে ফেলে রেখে চলে আসে সুভাষ (নাসিরুদ্দিন শাহ) আর তার বন্ধুরা। অসুস্থ যামিনী পেছনে পড়ে থাকে নিজের দুর্দশায়, ঠিক ‘আকালের সন্ধানে’র  দুর্গার মতো। এখানেই দুটি ছবি এক হয়ে যায়। পেছনে ভগ্ন জমিদার বাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকে মূক যন্ত্রণার মতো বা ‘ডেকাডেন্ট’ পুরুষতন্ত্রের মতো।
এখানে ব্যঙ্গোক্তি তীব্র হয় আরও। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পে নায়ক ম্যালেরিয়ার প্রকোপে পড়ে সব স্মৃতি থেকে দূরে নির্বাসন নেয়। এখানে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের স্টুডিওতে মডেলদের ছবি তুলতে।
অর্থাৎ সাংস্কৃতিক পশ্চাদাপসারণ।
যারা বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রামে এসেছিল, আসতে চেয়েছিল সেই সব নাগরিক যুবাদের একাংশের গুলি খেয়ে গলিতে-ময়দানে মুখ থুবড়ে পড়ার কাহিনি মৃণাল শুনিয়েছিলেন তাঁর সাতের দশকের কলকাতা ত্রয়ী আর ‘কোরাস’-এ। এবার আট/নয় জুড়ে শোনালেন তাদের গল্প যারা গ্রাম ঘুরে এসে সোজা চলে গিয়েছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার সড়কে। দামি চাকরি বা বিদেশে।
দুটো মিলেই মৃণালের সত্তর।
দুটো মিলেই মৃণালের রাজনৈতিক সন্দর্ভ।



------

এখানেই শেষ নয়। মাঝে আবার তিনটি ছবি এবং পাক্কা একটি দশকের জল বয়ে যাওয়া। এবার সাদাত হোসেন মান্টোর গল্প থেকে বানানো 'অন্তরীণ'। এখানেও একটি মেয়ে নিজের দুরবস্থার ভেতরে বন্দি। আর সেই বন্দিত্বের ভেতর থেকে সে (ডিম্পল কাপাডিয়া) ফোন করে একজন মানুষকে। যে মানুষটি একজন লেখক। চিত্র পরিচালক, চিত্রগ্রাহকের পর এবার লেখক। আবার মধ্যবিত্ত এক বুদ্ধিজীবিকে বেছে নেন মৃণাল। এই যে মেয়েটি অনেকক্ষণ পর্যন্ত যে ধন্দটা থাকে এ বাস্তব কিনা, বা এই মেয়েটি কোনও মনোবিকলনের শিকার কিনা, তা থেকে এক ঝটকায় সরে আসেন পরিচালক। দেখান এই মেয়েটি বাস্তব এবং তার অস্তিত্ব অতিমাত্রায় জ্বলন্ত বাস্তব। সে এক অর্থনৈতিক শোষণের শিকার। এক ধনীর হাতে বন্দি রক্ষিতা। এ যেন সেই দৈত্য, ঘুমন্ত রাজকন্যা আর পরিব্রাজক রাজকুমারের রূপকথা। কিন্তু চিত্রনাট্য রূপকথার আদলে শেষ হয় না। মৃণাল জানেন হতে পারে না। কারণ শ্রেণি হিসাবে মধ্যবিত্ত ‘রেনিগেড’, বিশ্বাসঘাতক। সদা পলাতক। অতএব দ্বিধাগ্রস্ত লেখক সুযোগ পেয়েও মেয়েটিকে তার বাস্তবতার বাইরে আনে না। যদি এটা গল্পও হয়,তো লেখক হিসাবে এ তার ব্যর্থতা।
এ ছবিতে বারবার উল্লেখে আসে রবি ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’। দুটি কাহিনির মাঝে ‘রেফারেন্স’ টানেন মৃণাল। কিন্ত বিশ শতকের শুরুর কালের লেখকের থেকে একালের লেখক শ্রেণিগতভাবে আরও ধূর্ত। তাই ঐ অতীতের গল্পের মতো লেখক নিজে গ্রস্ত বা বিপন্ন না হয়ে বরং পরিস্থিতির জাল কেটে পালান। দায়হীনভাবে পালান।
তবে এবার এই মেয়েটির পরিণতি দুর্গা বা যামিনীর মতো হয় না। সে নিজেই তার শিকল ভেঙে পালায়। লেখকের সঙ্গে তার ট্রেনে দেখা হয়। যেহেতু দু’জনের মধ্যে একমাত্র সংযোগসূত্র ছিল টেলিফোন, তাই লেখক তাকে চিনতে পারে না। মেয়েটি কিন্তু গলা শুনে ছেলেটিকে চিনতে পারে। কিন্তু নিজের পরিচয় দেয় না। নীরবে ঘোষিত হয় তার অনুকম্পা, ঘৃণা, উপেক্ষা কিংবা প্রতিশোধ।
গোটা ট্রিলজি জুড়ে মধ্যবিত্ত ‘বিশ্বাসঘাতক’ পলায়নপর বুদ্ধিজীবীদের যে ভীরুতার আখ্যান, তার ‘এপিটাফ’টি রচনা করে এই মেয়েটি এই মুহুর্তে।
এই যে ট্রিলজি, এ যে সমাপতন নয়, তার আর এক সাক্ষ্য তিনটি ছবিতেই একটি সৎ গরিব মানুষের থেকে যাওয়া। প্রথমে সরবে। তারপর প্রায় নীরবে। নিজেদের বিশ্বাস, শ্রম আর আগলে রাখা নিয়ে। এই তিনজন যেন একই চরিত্র তিনটি ছবির ভেতর দিয়ে জার্নি করছে। আক্ষরিক অর্থেই ‘কেয়ার-টেকার’ হিসাবে। প্রথম দুটি ছবিতে চরিত্রটি একই অভিনেতা করেছেন। রাজেন তরফদার। পরে তাঁর মৃত্যু হলে ঐ চরিত্রে তৃতীয় ছবিতে এসেছেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় একই রূপসজ্জা আর চালচলনে। এই লোকটিও যেন ঐ প্রাসাদের মতোই ইতিহাসের আর এক বিলুপ্তপ্রায় সাক্ষ্য।
মনে পড়ে প্রথম দুটি ছবির প্রাসাদের লোকেশনও এক। শেষেরটির আলাদা।



------

লেখা শেষ করতে গিয়ে এটাও মনে পড়ে গেল পশ্চাদাপসারণকারী এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ও একটি ট্রিলজি বানিয়েছিলেন। সেখানেও অনেকটাই মিশেছিল রবীন্দ্র-মধ্যস্থতা। এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রও! যথাক্রমে ‘পোস্টমাস্টার’। ‘চারুলতা’। ‘কাপুরুষ’।

Comments :0

Login to leave a comment