SC ADANI

ভরসা সেবি~তে, `আদানিকে স্বস্তি সুপ্রিম কোর্টের

জাতীয়

মোদী-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানির কোম্পানির বিরুদ্ধে শেয়ারের দামে কারচুপির মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জয়ের পতাকা তুলে দিল আদানি গোষ্ঠীর হাতেই। বুধবার এই মামলার রায়ে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ জানিয়ে দিল, আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ওই অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব থাকবে সেবির হাতেই। সেবির বদলে এই দায়িত্ব বিশেষ তদন্তকারী দ‍‌লের (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা সিট) হাতে তুলে দেওয়ার কোনও কারণ নেই। এটাই চেয়েছিল আদানি গোষ্ঠী, এটাই চেয়েছিল মোদী সরকারও। মামলার শুনানিতে উভয় পক্ষই সেবির থেকে নিয়ে তদন্তের দায়িত্ব সিটের হাতে তুলে দেওয়ার আরজির জোরালো বিরোধিতা করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের এই রায়ে জয় হলো আদানির ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর, জয় হলো বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রের সরকারেরও। বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র। 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গোষ্ঠীর কার্যকলাপ নিয়ে ১০৬ পৃষ্ঠার বিশদ রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল গত জানুয়ারির ২৪ তারিখে। সেই রিপোর্টে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সহ শেয়ারের কূট কারবার, আর্থিক জালিয়াতি, নিয়ম ভঙ্গের একগুচ্ছ অভিযোগ এনে হিন্ডেনবার্গ বলেছিল, আদানি গোষ্ঠী মরিশাস, সাইপ্রাস, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, বিভিন্ন ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের মতো কর ছাড়ের দেশগুলিতে স্তরে স্তরে শিখণ্ডী সংস্থা তৈরি করেছে। আদানি-পরিবারেরই কেউ না কেউ এই সব সংস্থা চালাচ্ছেন। সেখান থেকেই ভারতের শেয়ার বাজারে নিজেদের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলির শেয়ারের দাম বাড়ানো-কমানোর খেলায় লিপ্ত আদানি গোষ্ঠী। এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পরে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল। আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলির শেয়ারের দাম হু হু করে পড়েছিল। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট নিয়ে উত্তাল হয়েছিল সংসদও। বিরোধীরা বারবার দাবি জানালেও ওই সময়ে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এত মারাত্মক অভিযোগ নিয়ে একটি বিবৃতিও সংসদে দেয়নি মোদী সরকার। এত বড় কারচুপি ভারতের শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া বা সেবির চোখ কীভাবে এড়িয়ে গেল, না কি আদানি মোদী-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি বলে সেবি এই কারচুপির কথা জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ বুজে থেকেছে— এই প্রশ্নও উঠে এসেছিল। তারপরে সেবি তদন্ত শুরু করলেও অনেকটা দায়সারা ভঙ্গিতে সেই কাজ চালানোর অভিযোগ উঠতে শুরু করে। এমন পরি‍‌স্থিতিতে সেবির বদলে সিট গঠন করে ওই অভিযোগের তদন্তের আরজি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেছিলেন দুই আইনজীবী এম এল শর্মা ও বিশাল তিওয়ারি, কংগ্রেস নেত্রী জয়া ঠাকুর এবং সমাজকর্মী অনামিকা জয়সোয়াল। সেই মামলার রায়েই এদিন তাঁদের আরজি খারিজ করে দিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। উলটে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ বিধি ভেঙেছে কি না, সরকারকে তার তদন্ত করার এবং সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে। ইতিমধ্যে সেবি শীর্ষ আদালতকে জানিয়েছে, এমন ২৪টি অভিযোগের তদন্ত তারা করছে। ২২টির তদন্ত শেষ। দু’টির তদন্ত শেষ হয়নি বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য হাতে না আসায়। এদিনের রায়ে সেই তদন্ত শেষ করার জন্য সেবিকে আরও তিন মাস সময় দিয়েছে শীর্ষ আদালত।  
এদিন রায় দিতে গিয়ে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে উল্লেখিত তথ্যপ্রমাণকে বিবেচনার মধ্যেই যায়নি। বেঞ্চ সরাসরি বলেছে, যাচাই না করে কোনও তৃতীয় পক্ষের রিপোর্টকে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। শীর্ষ আদালত যে এমন রায় দিতে পারে, তার ইঙ্গিত মিলেছিল গত ২৪ নভেম্বরের শুনানিতেই। সেদিন প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ মামলার আবেদনকারীদের আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণকে বলেছিল, আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টকে অকাট্য সত্য বলে বিবেচনা করা যায় না। বুধবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট আরও যুক্তি দিয়েছে যে, সংবাদপত্রের রিপোর্ট এবং তৃতীয় পক্ষের কথায় ভরসা করে সেবির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যুক্তিসঙ্গত নয়। ওই রিপোর্টকে তথ্য বলে বিবেচনা করা যেতে পারে, কিন্তু সেবির তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো প্রমাণ হিসাবে নয়। প্রসঙ্গত, এর আগে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্টও গিয়েছিল আদানি গোষ্ঠীর পক্ষেই। ওই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ভারতের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কার্যকারিতা খতিয়ে দেখতে বলেছিল সেই কমিটিকে। গত মে মাসে শীর্ষ আদালতের কাছে পেশ করা রিপোর্টে কমিটি দাবি করেছিল, না আদানি গোষ্ঠী তাদের শেয়ারের দামে কোনও কারচুপি করেছে, না সেবির দিক থেকে কাজে কোনও ব্যর্থতা আছে। অন্যদিকে আদানি গোষ্ঠী প্রথম থেকেই হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টকে অস্বীকার করে এসেছে। এক বিবৃতিতে আদানি গোষ্ঠী দাবি করেছিল, একটি মিথ্যা ধারণা তৈরি করার জন্য বেছে বেছে কারচুপি করে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এটি কোনও নির্দিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে অবাঞ্ছিত আক্রমণই শুধু নয়, ভারতের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত আক্রমণ। ভারতের প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা, সততা, উৎকর্ষের উপরে এবং ভারতের বিকাশ ও আকাঙ্ক্ষার উপরে আক্রমণ।     
উল্লেখ করা যেতে পারে, হিন্ডেনবার্গ ওই রিপোর্টে শুধু মরিশাসেই আদানি গোষ্ঠীর ৩৮টি শিখণ্ডী কোম্পানির তালিকা পেশ করেছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, এগুলি চালান গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানি। পরিভাষায় যাকে ‘স্টক ম্যানিপুলেশন’ বলা হয়, তা নির্লজ্জভাবে করা হয়েছে আদানিদের তরফে। আদানি গোষ্ঠীর সংস্থাগুলি ঋণে ডুবে রয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ ব্যবহার করে মুনাফা তুললেও আসলে আদানি গোষ্ঠীর সংস্থাগুলির আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আরও জানিয়েছিল, যদি তাদের রিপোর্ট কেউ বিশ্বাসও না করেন, তাহলেও আদানিদের নিজস্ব হিসাবেই প্রমাণিত— শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত তাদের ৭টি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য আসলে ৮৫ শতাংশ কম। আরও একটি অভিযোগে হিন্ডেনবার্গ বলেছিল, আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলির শেয়ারের মালিকানা প্রোমোটারের হাতেই। ভারতের শেয়ার বাজারের নিয়ম অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানির অন্তত ২৫ শতাংশ শেয়ার প্রোমোটারের মালিকানার বাইরে থাকবে। আদানি এন্টারপ্রাইজেস, আদানি ট্রান্সমিশন, আদানি পাওয়ার, আদানি টোটাল গ্যাস, আদানি উইলমারের শেয়ারের মালিকানা এই নিয়ম লঙ্ঘন করে আদানিদের হাতেই ৭২ শতাংশ থেকে ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত রয়ে গিয়েছে। এর বাইরে তথাকথিত ‘পাবলিক’ শেয়ারহোল্ডাররা আসলে মরিশাসে তৈরি করা শিখণ্ডী কোম্পানি, যা আদানিরাই চালান। এইসব শিখণ্ডী অর্থলগ্নি সংস্থা শুধুমাত্র আদানিদের কোম্পানিতেই বিনিয়োগ করে। অর্থাৎ আদানিরা পাবলিক শেয়ার বলে যা বাজারে ছাড়ছে, তা আসলে তাদেরই ঘুরপথে কেনা। রিপোর্টে এই সঙ্গেই দেখানো হয়েছিল, এলারা, মন্টেরোসা, নিউ লিয়াইনা নামের শিখণ্ডী সংস্থাগুলি আদানির কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে। এদের প্রত্যকের ক্ষেত্রেই বিপুল কর ফাঁকির অভিযোগ। অথচ এদের মধ্যে কোনও কোনওটির মালিক আদানিদেরই আত্মীয়। সুপ্রিম কোর্টের এদিনের রায়ের পরে এ‍‌ই সব অভিযোগই ধামাচাপা পড়তে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

Comments :0

Login to leave a comment