Bangla Bachao Yatra

সঙ্ঘের পরীক্ষাগারে তৃণমূলের অঙ্ক ভাঙতে ‘বাংলা বাঁচাও’য়ের ডাক

রাজ্য

বাংলা বাঁচাও যাত্রার সমর্থনে মিছিল দিনহাটায়।

চন্দন দাস

বাংলায় কথা বলার ‘অপরাধ’-এ ১০৩জন শ্রমিককে মারধর করা হয়েছিল হরিয়ানায়। গত আগস্টে। নিজেদের উপার্জনের প্রায় আড়াই লক্ষ টাকায় বাস ভাড়া করে সেই তুফানগঞ্জবাসী যুবকরা ফিরে এসেছিলেন। 
‘প্রাণ বাঁচলে ফের কাজ মিলবে। এই রাজ্যে কাজ নেই। অন্য রাজ্যে যাওয়া যাবে।’ এই ছিল প্রত্যাবর্তনের যুক্তি। 
ঘোকসাডাঙার লতাপাতা পঞ্চায়েতের নিশিকান্ত দাশ নোটিস পেয়েছিলেন আসাম থেকে। কিন্তু সেই নোটিস হিন্দিতে লেখা নয়। ইংরাজিতেও নয়। অহমিয়া ভাষায়। তাঁর ‘অপরাধ’? আসামের বিজেপি সরকারের অভিযোগ, নিশিকান্ত নাকি ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। তাই গত জুলাইয়ে তাঁকে এনআরসি’র নোটিস পাঠানো হয়েছে। 
হরিয়ানায় পরিযায়ীদের বাংলায় কথা বলা মানে ‘বাংলাদেশি।’ আর পশ্চিমবঙ্গে নোটিস আসবে আসামের স্থানীয় ভাষায়!
দুই ক্ষেত্রেই রাজ্যের তৃণমূল সরকার নীরব। দুই ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থল বিজেপি-শাসিত রাজ্য। দুই ক্ষেত্রেই আক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গের গরিব গ্রামবাসীরা।  
ধনঞ্জয় রাভা লোকসংস্কৃতি শিল্পী। সংগঠকও লোকশিল্পীদের। কোচিবহারের পালটে যেতে থাকার বিবরণ দিতে গিয়ে রাভা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী বদল দেখলেন জেলার এই ক’ বছরে? রাভার বললেন,‘‘তুলির মালা এখন গলায় গলায়, ছড়াছড়ি। তুলসির মালা আগে পড়তেন কয়েকজন। ধর্মপ্রাণ মানুষ তখনও ঘরে ঘরে ছিলেন। এখন নিজের পরিচিতি স্পষ্ট বোঝাতে গলায় গলায় তুলসির মালা। ‘সনাতনী’ হিসাবে নিজেকে জাহির করার স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে না। সঙ্ঘ বেড়েছে। তাদেরই কাণ্ড। পাশাপাশি বেড়েছে মুসলমানদের মধ্যে ফেজ টুপি পড়ার চলও। সবাই যেন নিজের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।’’ আর কিছু? রাভার বিবরণে আরও আছে—‘‘মোড়ে মোড়ে ডিয়ার লটারির গুমটি আর পাড়ায় পাড়ায় নতুন মন্দির হয়েছে। পুজো দিতে আর অনেকটা হাঁটতে হয় না। ঘরের কাছেই মন্দির হয়ে গেছে। খালি কাজের জন্য দূরে, অন্য রাজ্যে যেতে হয়।’’
প্রসঙ্গত, মন্দিরকে হিন্দুর ঘরের পাশে আনো—এই কর্মসূচি সঙ্ঘের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে অন্যতম ঘোষণা।
আসাম সীমান্তের কোচবিহারের রাভেয়া গ্রামের বাসিন্দা ধনঞ্জয় রাভাদের বদলে যেতে দেখা কোচবিহার শুধু একটি জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা বদল নয়। মানুষের নিজের মতামত নির্ভয়ে প্রকাশ করার অধিকার বিপন্ন। অভয়ার বিচারের দাবিতে নাগরিকদের মিছিলেও হামলা চালানোর দৃষ্টান্ত এই জেলায় স্থাপন করেছে তৃণমূল। দুর্নীতি প্রতিটি পর্যায়ে। কাজের অভাব জেলায়। গত কয়েক বছরে কোচবিহারের অনেক পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে ভিন রাজ্যে। জেলায় তামাক, ধানে লোকসান ধারাবাহিক। শুধু কোচবিহারে নয়, রাজ্যের প্রতিটি জেলাতেই এই পরিস্থিতি।
এমন নৈরাশ্যের কারাগার-পর্বে পশ্চিমবঙ্গ আরএসএস-এর পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। কোচবিহার তার আরশিনগর।
আর এখনই এই নিরাশা ভেঙে উত্তরণের লক্ষ্যে, সিপিআই(এম)’র ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’। শুরু তুফানগঞ্জ থেকে, আগামী ২৯নভেম্বর। 
সেই যাত্রা শুরুর আগে একটি সভা হবে। কিন্তু লালঝান্ডার পার্টি তুফানগঞ্জের এসএসএ মাঠ কিংবা কলেজ সংলগ্ন ময়দানের অনুমোদন পায়নি। তৃণমূলকে কোলে পিঠে করে রাখা প্রশাসন মূল শহরের বাইরে একটি মাঠের অনুমোদন দিয়েছে। কেন? তুফানগঞ্জের সিপিআই(এম) নেতা অসীম সাহার কথায়,‘‘পার্টির সভা শুনলে অনেকেই আসতে চায়। যাঁরা তৃণমূলের দৌরাত্যেব র আতঙ্কে থাকেন এমন অনেক নাগরিক শহরের মধ্যে সভা হলে একবার হাঁটতে হাঁটতে এসে ঘুরে যেতে পারেন। শহরের বাইরে যে মাঠ দেওয়া হয়েছে, সেই মাঠে কাউকে যেতে হলে তৃণমূলের চোখ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।’’ তৃণমূল মাপতে চায় বামপন্থীদের সমর্থন। 
এই তুফানগঞ্জে ২০১৬-তেও আরএসএস পরিচালিত হচ্ছিল একটি ভাড়া বাড়ি থেকে। ২০১৮ নাগাদ তাদের জমি হয়েছে, সেই জমিতে নতুন ভবনও হয়েছে। তুফানগঞ্জে সঙ্ঘ পরিচালিত স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেহাল সরকারি স্কুলের থেকে বেশি হয়েছে। সেই স্কুলের মধ্যে ছুটির দিনে সঙ্ঘের শাখার কার্যক্রম হয়। তুফানগঞ্জে মাথা তুলেছে সঙ্ঘের নতুন ভবন লাগোয়া ভারতমাতার মন্দির। সঙ্ঘ প্রকাশ্যে কুচকাওয়াজ করে ইউনিফর্ম পড়ে। তবে বামপন্থীরা রেগার কাজ, আবাস যোজনার টাকার মতো বিভিন্ন দাবিতে প্রশাসনের অফিসে ডেপুটেশন দিতে গেলে নানা হুমকি, বাধায় কার্পণ্যে নেই তৃণমূলের। 
এমন সহায়তা সঙ্ঘ পশ্চিমবঙ্গে আগে কখনও পায়নি। তাই উত্তরবঙ্গে আরএসএস’র বিস্তার রীতিমতো আলোচনার বিষয় সঙ্ঘের জাতীয় পর্যায়ের সভায়। ২০২৩-এর মার্চে উত্তরবঙ্গে সঙ্ঘের শাখা ছিল ৪৯৩টি। ২০২৫-এর নভেম্বরে তা পৌঁছেছে ৫৬০-এ। ৩৪৫টি স্থানে তাদের উপস্থিতি ছিল ২০২৩-এ। তা এসে পৌঁছেছে ৪৬০-এ। দক্ষিণ এবং মধ্য বঙ্গেও হিন্দুত্ববাদের প্রচার নিয়ে সঙ্ঘের তৎপরতা বেড়েছে। কিন্তু উত্তরবঙ্গে তার মাত্রা বেশি বিপজ্জনক। 
তুফানগঞ্জ আসনে গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতেছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন প্রণব কুমার দে। তুফানগঞ্জে হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘের তৎপরতা বৃদ্ধির কারণ কী? তাঁর মতামত জানার জন্য ছিল এই প্রশ্ন। প্রণব বাইপাস করে বললেন,‘‘আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না।’’ কিন্তু ফজল করিম মিয়া উত্তর দিলেন। ২০১৬ থেকে ২০২১, তিনিই ছিলেন তুফানগঞ্জের তৃণমূলী বিধায়ক। সঙ্ঘের কথা উল্লেখ না করেও তৃণমূলের এই নেতা বললেন,‘‘বিজেপি জিতেছে, কারণ আমাদের দলের কিছু লোক বিজেপি’র হয়ে কাজ করেছিল, বিজেপি’কে ভোট দিয়েছিল। সব বক্সি জানে।’’ 
বক্সি? আপনি কী সুব্রত বক্সির কথা বলছেন? তৃণমূলের কোচবিহার জেলার কোর কমিটির সদস্য ফজল করিম মিয়া এবারও সটান,‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সুব্রত বক্সি।’’ কিন্তু তিনি তো মমতা ব্যানার্জির খাস লোক..? এবার ফজল করিম মিয়ার কথায়,‘‘জানি তো। দিদি যা চাইবেন, তাই হবে এবারও।’’
অর্থাৎ সেই বাইনারি। সঙ্ঘের বাড়বাড়ন্তে গত সাত-আট বছর ধরে জেগে ওঠা সেই বাইনারির পাটিগণিত ফজল করিমের মাথায় তুরুপের তাস। বললেন,‘‘এই অবস্থায় মুসলমানরা তৃণমূলের সঙ্গেই থাকবে।’’  
এমন বোঝাপড়ায় সেখ জাভেদ মিয়াদাদের কী লাভ হয়েছে? মমতা ব্যানার্জি দশ হাজার মাদ্রাসার অনুমদনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০১১-তে। দিয়েছেন মাত্র ২৩৫টিতে। তারই একটির শিক্ষক জাভেদ। তাঁর অভিজ্ঞতা আসলে তাঁর অসহায়তা। বললেন,‘‘আমাদের বেতন যা ছিল তাই আছে। মাসে ৬হাজার। আমাদের কোনও কথাই সরকার কানে তোলেনি। এর মধ্যে প্রায় ২০০জন অবসর নিয়েছেন। ফলে ওই ২৩৫টি মাদ্রাসার ২৩৫০জন শিক্ষক আর নেই।’’ ওই অবসরপ্রাপ্তরা কী পেলেন? মিয়াদাদের জবাবে প্রবল বিদ্রুপ,‘‘কানাকড়ি পাননি।’’

Comments :0

Login to leave a comment