মীনাক্ষী মুখার্জি
বাংলা বাঁচাও। কেন? বাংলা কি ভালো নেই? কেন ভালো নেই? রাজ্যের উত্তরের জেলাগুলিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে গেল। বিপর্যস্ত মানুষ, হাহাকার পরিস্থিতি। ঘরের উঠোনে বাড়ির বয়স্ক মহিলা নাতির মৃতদেহের অপেক্ষা করছেন। একই পরিবারের তিনজন ভেসে গেছে বন্যার জলে। সাড়ে ছয় মাসের শিশু মাকে হারিয়েছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাবা। সরকার, প্রশাসনের লোকজন এসেছিল। পাঁচ লক্ষ টাকা দেবে ‘ডেডবডি’ পাওয়া গেলে। কিন্তু ওই ফাঁকা ঘরের দাওয়ায় বসে ঠাকুমা, জ্বর গায়ে সাড়ে ছয় মাসের শিশু কী খুঁজছে? নিজের আত্মীয়? শেষ জীবনের অসহায় সম্বল? বড় হয়ে উঠতে মায়ের যত্ন, অভিভাবক? না কি পাঁচ লক্ষ টাকা! বাঁধ ভেঙে গেছে। বন্যার জলে জঙ্গল, জনপদ, গ্রাম, মানুষ, গবাদি পশু সব ভেসে গেছে। বাদ নেই কিছু। আস্তে আস্তে জল নামলেও পলি সরেনি। গবাদি পশু মরে পড়ে আছে। পচা গন্ধ। বন্যপ্রাণী হাতি, বুনো শুয়োর নিজেদের স্বাভাবিক বসবাসের জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। তারা মানুষের বাড়ি ঘর ভেঙে দিয়েছে। বিপর্যস্ত মানুষ পেটের টানে কাজে বেরোলে বুনো শুয়োর তার পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে।
এইরকম অবস্থায় ত্রাণ বিলি করতে গিয়ে, বন্যা বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে মানুষের চোখে রাগ অসহায়তা, প্রশ্ন এবং বুনিয়াদি দাবির মিশেলে তৈরি হওয়া ইমোশনের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। পরিলক্ষিত হয়েছিল জনপ্রতিনিধিদের উপর রাগ আক্রোশ, প্রশাসনের উপর আস্থাহীনতা। যা আমাদের কাছে অর্থাৎ বামপন্থীদের কাছে বুনিয়াদি দাবি। যেন ধরিয়ে ঝাঁকিয়ে দিল- “চিড়ে মুড়ি ত্রিপল লাগবে না। বাঁধ উঁচু করুন, মজবুত করুন। তাড়াতাড়ি বাঁধের ব্যবস্থা করুন। ডাক্তার পাঠান, হেলথ সেন্টার বসুক। বাঁধ নির্মাণের টাকা যেন তছরুপ না হয়। আমাদের নিজস্ব জমি নেই, আমাদের যে ঘর ভেঙেছে সেই ঘর প্রশাসন বানিয়ে দিতে চাইলে, আমরা বাড়ি কোথায় বানাবো? জমি দিন। জমির কাগজ দিন। চাষের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি বিমা দিন, তার ব্যবস্থা করুন। বন্যার ফলে পলি পড়ে জমির চরিত্র পালটে গেছে, এর পর কোনও ফসল চাষ করবো? নদী থেকে বালি পাথর পাচার হয়ে যাচ্ছে, পুলিশ প্রশাসন দেখছে না কেন? একশো দিনের কাজ বন্ধ, বাইরে খাটতে যাই। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমিয়ে ছিলাম। সোনার হার গড়েছিলাম। জলে ভেসে গেছে। এখন কী করবো? কী করে মেয়ের বিয়ে দেবো?” এমন প্রশ্ন, হাজারও প্রশ্ন। ত্রাণ শিবিরে এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি বলে দিলে - “এখানে পনেরো কিলোমিটারে কোনও স্কুল নেই। বাচ্চাদের পড়াতে হবে। স্কুল চালু করুন।” মুখ্যমন্ত্রী দিতে চেয়েছিলেন পাঁচ লক্ষ টাকা। বিলি করতে গিয়েছিলেন কম্বল, খিচুড়ি। কিন্তু বাংলা চাইলো স্কুল, শিক্ষা। এটাই বাংলা। এই বাংলাতেই আমরা জন্মেছি, বড় হয়েছি। বুঝতে শিখেছি। প্রশ্ন করতে শিখেছি, গড়তে শিখেছি। প্রতিবাদ করতে শিখেছি।
বাংলা বুনিয়াদি প্রশ্ন করছে, প্রস্তাব রাখছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে কোথায় ফাঁক আছে। বাংলার বেঁচে থাকার বুনিয়াদি শর্তগুলো উধাও হয়ে গেছে। লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার অর্জিত অধিকার রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই আজ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজ সমস্ত ক্ষেত্রে বিপর্যস্ত বাংলাকে বাঁচাতে বাংলার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে রাস্তায়। রক্ষা করতে হবে অর্জিত অধিকার। পুনর্গঠন করতে হবে বাংলাকে। রক্ষা করতে হবে বাংলার কৃষ্টি সংস্কৃতি, পাহাড় জঙ্গল, নদী, বাংলার ঐতিহ্য ,বর্তমান, ভবিষ্যৎ।
আগামী ২৯ নভেম্বর থেকে বাংলার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ লাল ঝান্ডার নেতৃত্বে বাংলা বাঁচাও যাত্রা আরম্ভ করবে। তুফানগঞ্জ থেকে কামারহাটি। মানুষের ভোটের অধিকার বাঁচাতে সমবেত হবে বাংলা। এসআইআর’র আতঙ্ক, উদ্বিগ্নতা গ্রাস করছে সাধারণ গরিব মানুষকে। বিজেপি-তৃণমূল দুই দলই আরএসএস’র পরিকল্পনায় মানুষের উদ্বিগ্নতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। আমাদের পার্টি তাদের এই উদ্দেশ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিপিআই(এম) পার্টির দাবি কোনও বৈধ ভোটার বাদ যাবে না। মৃত ভুয়ো ভোটার ভোটার লিস্টে রাখা যাবে না।
বাঁচাতে হবে স্কুল। বাংলার সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা আজ ধ্বংসের মুখে। ৩৮২২টি স্কুল মার্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তালিকা প্রকাশ করেছে সরকার। পিএবি রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ৬৬৭৪৪টি প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে ৫১৪৯টি স্কুলে মাত্র একজন করে শিক্ষক। ৬৪২৪টি আপার প্রাইমারি স্কুলের মধ্যে ৮৯১টি স্কুলে একজন করে শিক্ষক। ১১৫১৫টি প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়া ৩০-এর কম। ৩৬৬৯টি স্কুলে পড়ুয়া ১৫ জনের কম। ৭৪৭টি প্রাইমারি স্কুলে একজনও পড়ুয়া নেই। ১৪৭৫টি আপার প্রাইমারি স্কুলে পড়ুয়া ৩০ জনের কম। ৭২০টি স্কুলে ১৫ জনের কম পড়ুয়া। ২৫৯টি স্কুলে একজনও পড়ুয়া নেই। স্কুল ছুটের হার ৮.৫% থেকে বেড়ে ১৭.৮% হয়েছে। এমতাবস্থায় শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নে দুর্নীতি অন্যতম উপাদান। শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমছে। শিক্ষা কিনতে হচ্ছে। স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়ুয়ারা শ্রমিকে, পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে।
পরিযায়ী শ্রমিক রাজ্যের একটি জ্বলন্ত সমস্যা। নিজের রাজ্যে কাজ না পেয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হচ্ছে বাংলার যৌবনকে। কোনও তথ্য নেই সরকারে কাছে। কোনও পরিকল্পনা নেই সরকারের। তাদের কাজের মজুরি, ভবিষ্যৎ সুরক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা নেই। বাংলায় কথা বলার জন্য ভিন রাজ্যে আক্রান্ত হতে হচ্ছে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিককে। রাজ্যে কাজ নেই। কারখানা বন্ধ। ২০০০-এর বেশি কারখানা বাংলা থেকে ঠিকানা বদল করে আলাদা রাজ্যে চলে গেছে। ২১০০০- এর বেশি কারখানার গেটে তালা পড়েছে। সরকার নীরব। সরকারের প্রশ্রয়ে চলছে তোলাবাজি সিন্ডিকেট রাজ। সরকারই শ্রমিকের পেটে লাথি মারছে। আর এই কাজে বাংলার সরকারকে সাহায্য করছে বিজেপি । কেন্দ্রীয় সরকারের ৪টি শ্রম কোড বিল শ্রমিকের অধিকারকে কর্পোরেটের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।
সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। খরচের জোগান দিতে গজিয়ে উঠেছে মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানি। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রোজগার করা যাচ্ছে না। লাগামহীন সুদের বিনিময়ে মাইক্রো ফিনান্সের জালে রাজ্যের কোটি কোটি মহিলা। শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক কয়েকটি প্রকল্প মানুষকে খুব বেশি সুরাহা দিতে পারছে না। প্রয়োজন সুচিন্তিত পরিকল্পনার। রাজ্যের মহিলারা মাইক্রো ফিনান্সের জালে আটকে পড়ছে, তাদের জাল থেকে বের করতে হবে। ১০০ দিনের কাজ না থাকায় রাজ্যের মানুষ আরও বিপদে পড়েছে। দুর্নীতি রাজ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাস, মিড ডে মিল, ১০০ দিনের কাজ সমস্ত ক্ষেত্রে দুর্নীতি। সহজ ও পরিষ্কার কথায় লুট চালাচ্ছে তৃনমূল কংগ্রেসের সরকার। তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সারা রাজ্যের মেহনতি সাধারণ মানুষকে।
নারী নিরাপত্তা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যা অভাবনীয়। মহিলা নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, পাচার, বাল্য বিবাহ মারাত্মক জায়গায় পৌঁছেছে। প্রতি ১০০ জন মেয়ের মধ্যে ৪২ জনের কম বয়সে, বাল্য অবস্থায় বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এনসিআরবি-২০২২ রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলায় শুধু পনের কারণে ৬৩৭ জন মহিলা খুন হয়েছেন। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে এমন ভাবা যায়? ওই একই রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৫৫টি নারী আমাদের রাজ্য থেকে পাচার হয়েছে। যাদের কোনো খোঁজ নেই। শুধুমাত্র মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুট ছাত্রীর হার ৭.৪%। এনসিআরবি--২০২৪ অনুযায়ী রাজ্যে নারী ও শিশু পাচারের সংখ্যা ৫৮৯২। ধর্ষণ পশ্চিমবঙ্গে ২৫১৫। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ষণ আরজি করের মতো ২০২৫ পর্যন্ত ২৫ জন। কোথায় যাচ্ছি আমরা? অপরাধ হচ্ছে। সমস্ত অপরাধ অভিযোগ হিসাবে নথিভুক্ত হয় না। নথিভুক্ত অভিযোগের ১০০টির মধ্যে ৬৫টি কেসে অপরাধী সাজা পায় না। অপরাধীরা আমাদের সামনে বুক বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সরকার গুন্ডারাজকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী সুরক্ষা, প্রাকৃতিক সম্পদ সমস্ত কিছুই এই সরকারের আমলে চরমভাবে অবহেলিত। তাই আজ রাজ্য বাঁচাতে চাইলে রাস্তায় প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। রাজ্য বাঁচাতে, চা বাগান বাঁচাতে, বিড়ি শ্রমিক বাঁচাতে, শিল্প বাঁচাতে, কৃষি বাঁচাতে, নদী, প্রকৃতি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য শিক্ষা বাঁচাতে, ডিয়ার লটারির হাত থেকে গরিব মানুষকে বাঁচাতে, মাইক্রো ফিনান্সের হাত থেকে বাংলার পরিবার গুলিকে বাঁচাতে, গণপরিবহণ বাঁচাতে, জল জমি জঙ্গলের অধিকার বাঁচাতে বাংলা বাঁচাও যাত্রা। ২৯ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তুফানগঞ্জ থেকে কামারহাটি, উত্তর থেকে দক্ষিণ, রাজ্য জুড়ে বাংলা বাঁচাও যাত্রায় পথে থাকবে সিপিআই(এম)। বাংলার গণতন্ত্রপ্রিয়, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, মেহনতি মানুষ এই যাত্রায় সোচ্চারে সামনে থাকবে। আসুন আপনিও এই যাত্রার অংশ হয়ে নতুন বাংলা গড়ার লক্ষ্যে পথ হাঁটুন।
Comments :0