Nomination

মনোনয়ন রক্ষা করতে জঙ্গলেই তিনদিন

রাজ্য

Nomination



সুদীপ্ত বসু: লাউদহ (দুর্গাপুর) 


তিনদিনের জঙ্গলবাস। ঝোপঝাড়, পোকামাকড়ের সঙ্গেই জঙ্গলে কাটাতে হয়েছে তিনদিন। ২০ তারিখ বিকালে জঙ্গল ছেড়ে ফের গ্রামে মানতা হেমব্রম, জঙ্গলরাজের কবল থেকে পঞ্চায়েতকে মুক্ত করার প্রচারে। 
মনোনয়নের নথি বিকৃত করার অভিযোগে হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এদিন বিকালে তা জেনেছে লাউদহও। শুনেছেন মানতা হেমব্রম, শুনেছেন হেরালাল হাজরা। 
প্রবল দাবদাহের বিরতিতে বিকালে তখন অঝোরে বৃষ্টি। মানতা হেমব্রমদের কথায়, ‘বৃষ্টি স্বস্তি আনেনি, মঙ্গলবার দুপুর তিনটে পেরোনোর পরে আমাদের মিলেছিল আসল স্বস্তি। আর পিছনে তাকানোর সময় নেই, এবার হটাতেই হবে এদের পঞ্চায়েত থেকে’।
জঙ্গলে থেকেই রক্ষা করতে হয়েছে মনোনয়ন। অদম্য জেদের  সেই কাহিনি।
২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের লাউদহ থেকে জেমুয়া, কোথাও মনোনয়নপত্রই জমা দিতে পারেননি বিরোধী প্রার্থীরা। এবার বদলেছে চিত্র। বদলে যাওয়া দৃশ্যপটে প্রতিটি ঘটনার কোলাজই যেন- ‘সাহসের পদাবলী’।
রেগার কাজ বন্ধ, গত বছরের বকেয়া মজুরিও মেলেনি। মাঠে কাজ নেই, দিনমজুরির কাজ জোগাড় করতেও নাভিশ্বাস উঠছে, গ্রামজুড়ে আকালের ছবি। সুদিন কেবল বিস্তীর্ণ তল্লাটে পাথর খাদান, বালি-কয়লা পাচারের কারবারীদেরই। সেই তল্লাটেই  লাউদহ পঞ্চায়েতে সিপিআই(এম)’র প্রার্থী হয়েছেন শুকতি মুর্মু, মানতা হেমব্রম, পাশের নাগরকোঁদা থেকে সারথী মুর্মু। মনোনয়ন পেশের পর থেকেই হুমকি, বাড়িতে চড়াও তো স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে এরাজ্যে। সারথী মুর্মুকে বাড়ি বয়ে এসে পাঁচ লক্ষ টাকার অফার, প্রত্যাহার না করলে ছেলে- মেয়ের কিছু হলে দায় থাকবে না, এমন হিমশীতল হুমকির মুখেও পড়তে হয়েছে। কিন্তু তাঁরাও অনড়।


পরিস্থিতি এমন গড়ায় মানতা হেমব্রম, সারথীর স্বামী কমল মুর্মু ও শুকতি মুর্মুর স্বামী বাবুসের মুর্মুকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলে থাকতে হয়েছে পার্টি কর্মীদের। তিলাবনী গ্রাম জঙ্গলঘেরা, বিস্তীর্ণ জঙ্গলখণ্ড। এদিন সিপিআই(এম) কর্মী পিয়ার আলি খান বলছিলেন, ‘ওদের দু’জনের স্বামীকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। আদিবাসী মহিলা তো, স্বামীকে দিয়ে প্রত্যাহারের চেষ্টা করছিল। কমল মুর্মুর চাকরিও কেড়ে নিয়েছে ওরা। ঝাঁঝরা কোলিয়ারিতে কাজ করতো। তাই বাধ্য হয়ে আমরা অন্য কৌশল নিই’।
কী সেই কৌশল? ১৮ তারিখ সকাল থেকে তিলাবনী গ্রামকে ঘিরে রাখা সেই জঙ্গলে চলে যান তাঁরা। জঙ্গলেই পড়ে থাকা সারাদিন। সেখান থেকেই নজরদারি চালানো গ্রামে বাইকবাহিনী ঢুকছে কি না। রাতের দিকে আবার ফিরে আসা গ্রামে। আদিবাসী পাড়ায় রাতে বাইকবাহিনী ঢোকার সাহস নেই। সকাল হতেই পাড়ি জঙ্গলে, সেখানেই পোকামাকড়ের সঙ্গে থাকা, কোনোমতে সময় কাটানো। গ্রামের মানুষই জঙ্গলে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁদের। এরপর ২০ তারিখে বেলা তিনটে বাজতেই তাঁরা বেরিয়ে আসেন জঙ্গল থেকে। একজনকেও প্রত্যাহার করাতে পারেনি তৃণমূলী বাহিনী।
পিয়ার আলি খান, উত্তম মণ্ডলের কথায়, ‘একবার ভাবুন আমরা যদি জঙ্গলে এত কষ্টে থাকলাম শুধুমাত্র প্রার্থীপদ বাঁচানোর জন্য, তাহলে ভোটের লড়াই কেমন হবে, এক ইঞ্চি জমিও তৃণমূল বাহিনীকে দেওয়া হবে না’।


সিপিআই(এম) প্রার্থীদের যখন লড়াই করে মনোনয়ন জমা দেওয়া, আরও যুদ্ধ করে তা টিকিয়ে রাখতে হয়েছে সেই সময়েই পিছনের দরজা খালি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েই ‘অযোগ্য প্রার্থীর’ ভরসায় থাকতে হচ্ছে তৃণমূলকে। টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন- তৃণমূলের স্বাভাবিক সাংগঠনিক অভ্যাস। এবার মনোনয়নেও কারচুপি। কমিশন থেকে বিডিও- নিয়োগ দুর্নীতির মতোএখানেও কাজ করছে তৃণমূলী এজেন্ট চক্র!
দুর্গাপুর—ফরিদপুর পঞ্চায়েত সমিতির তিনজন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র যা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৩-১৪-১৫ এই তিনটি সমিতির আসনে তৃণমূলের প্রার্থীদের জমা দেওয়া মনোনয়নে ‘সাক্ষীদের স্বাক্ষর ও ঠিকানা’ অংশটি অসম্পূর্ণ। কোনও নাম লেখা নেই, সই নেই, ঠিকানাও লেখা নেই। অসম্পূর্ণ এই মনোনয়নপত্রই দাখিল করা হয়। প্রতাপপুর এলাকার এই তিনজন প্রার্থী হলেন শ্রীমতি হেমব্রম, মনিকা সিং এবং ভারতী বাগদী। পার্টি সংগঠক সুব্রত পালের কথায়, আমরা স্ক্রুটিনির সময় চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। বিডিও তৃণমূলের দালালের সুরে বললেন- সব ঠিক আছে, ওসব আপনাদের ভাবতে হবে না। সেই অসম্পূর্ণ মনোনয়ন ওয়েবসাইটেও আপলোড করা হয়েছে। সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পঙ্কজ রায় সরকার বলেন,‘ ঐ তিনটি মনোনয়নই বেআইনি। আমার নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে তিনজনের প্রার্থীপদ বাতিলের দাবি জানিয়েছি’।
এই ব্লকে ১২টা বালিঘাট। ১৬ থেকে ১৮ চাকার লরি। গড়ে ৫০ টন ভিজে বালি। রাত দশটা থেকে ভোট ছটা পর্যন্ত দাপাদাপি। কোটি কোটি টাকার কারবার মাসে। স্বাভাবিকভাবেই দুষ্কৃতী রমরমা। পঞ্চায়েতে প্রকল্প, গণতন্ত্র সব কিছুই ব্যাকসিটে। কাঁচা টাকার জোরেই পঞ্চায়েত এখন লুটের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। পঞ্চায়েত সদস্য মানে লরি পিছু বালি থেকে মাসে সবথেকে ৫-৬ লক্ষ টাকা আয়। তাই নব্য ধনীদের এত লম্ফঝম্প! 


অথচ এই লাউদহের কুলবনি গ্রামে পানীয় জলের ভয়াবহ সঙ্কট। ড্রেনের জলের যে তোড় তা থেকে জল সংগ্রহ করে পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করতে হচ্ছে গ্রামবাসীদের। কে তুলবে এই প্রশ্ন? শাসকের পঞ্চায়েত বালি পাচারে ব্যস্ত। রতনপুর ঘাটের জন্য ডাক ওঠে ২০ কোটি টাকা। সেই বালি তুলতে তুলতে জলস্তর নেমে গেছে। পাশের বালিজুড়ি গ্রামে ভোরে এসে লাইন দিয়ে জল তুলতে হচ্ছে গ্রামবাসীদের! কে কথা বলবে? সারথী মুর্মুরা লাল ঝান্ডা হাতেই সে কথা তুলছেন প্রচারে।
বুধবার সকালে এই ব্লকেরই ইছাপুরের বনসোল গ্রামে এসে দাঁড়াতেই স্পষ্ট, কেন ভোটকেই ভয় পাচ্ছে এখন শাসক তৃণমূল! গত বছরের একশো দিনের কাজে বকেয়া টাকা মেলেনি, এবছর তো কাজই নেই। ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পাঁচশো টাকা পাই। আদিবাসী, এক হাজার টাকা তো পাওয়ার কথা। দুয়ারের সরকারের শিবিরে তিনবার গেছি, সার্টিফিকেট জমা দিয়েছি। মেলেনি। এই গ্রামে কোনও আদিবাসী মহিলাই ১০০০ টাকা পায় না। তৃণমূলে বলে যা দিচ্ছি ওটাই নে, ভিক্ষা দিচ্ছে নাকি সরকার?’, প্রশ্ন জবা টুডুর। 
সঙ্কট আর অবাধ্যতার এই জমিতেই তাই পিছনের দরজাতেই ভরসা রাখতে হচ্ছে শাসককে। 
প্রতাপপুর এলাকার বাসিন্দা, পেশায় রাজমিস্ত্রী, সিপিআই(এম)’র পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী হেরালাল হাজরা। তাঁর বিরুদ্ধেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সেই বেআইনি মনোনয়নে প্রার্থী হওয়া ভারতী বাগদি। হেরালালের কথায়, ‘ওদের টাকা আছে, এসব করতে পারে। তবে পিছনের দরজা দিয়ে ভোট জিততে পারবে না এবার’।

Comments :0

Login to leave a comment