তপন বিশ্বাস: ইসলামপুর
সন্ত্রাসের মুক্তাঞ্চল কি একেই বলে! জেসিবি’কে পুলিশি হেপাজতে রাখা হলেও চোপড়াতে তৃণমূলের এমন ত্রাসের রাজত্ব চলছে যে লক্ষ্মীপুরের নির্যাতিতা যুবতীকে দিয়ে জোর করে জেসিবি’র পক্ষেই সওয়াল করালো তৃণমূলের বাহিনী। তাঁকে প্রকাশ্যে গ্রামের রাস্তায় ফেলে পেটানোর ভিডিও যে ব্যক্তি মোবাইল ক্যামেরায় তুলে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়েছিলেন তাঁর বিরুদ্ধেই পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন নির্যাতিতা।
ব্যাখ্যার অতীত এমন আচরণ কেন করলেন চোপড়ার এই নির্যাতিতা মহিলা? চোপড়ার মানুষের কথা শুনলে অবশ্য সহজেই ব্যাখ্যা মিলে যাচ্ছে। যুবক যুবতীদের লাঠি হাতে জেসিবি’র পেটানোর দৃশ্য সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়ার পরেই গ্রামে তজিমুল ওরফে জেসিবি’র বাহিনী গ্রামে ত্রাস সৃষ্টি করে যাতে কেউ মুখ না খোলে। মুখ খুললে জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। ভিডিও যে ভাইরাল করেছে তার খোঁজে গ্রামে তল্লাশি চালায় তৃণমূলী বাহিনী। সোমবার রাতেই তৃণমূলের এমন জবরদস্তির ব্যবস্থাপনায় নির্যাতিতা মহিলাকে দিয়ে বলানো হয় যে ‘মীমাংসা হয়ে গেছে। কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়া ওই ভিডিও ভাইরাল করা হয়েছে, যে করেছে আমি তার বিরুদ্ধেই পুলিশের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছি।’ একই কথা বলানো হয়েছে তাঁর শাশুড়িকে দিয়ে।
স্পষ্টতই, শুক্রবারের নির্যাতনের অপরাধ ঢাকতে সোমবার দ্বিতীয়বার এভাবেই নির্যাতন করা হয়েছে গ্রামের নির্যাতিতা মহিলাকে।
ঠিক এই ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল ইসলাম। আগেরদিনই তিনি নির্যাতিতা মহিলাকে ‘দুশ্চরিত্রবান, সমাজকে খারাপ করছে’ বলার পাশাপাশি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকরা বেশি বেশি করে খোঁচাচ্ছেন। ওই মহিলা এবং তার স্বামী তো কোনও অভিযোগ করেনি।’
সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে সোশাল মিডিয়ার হাত ধরে উঠে আসা ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’ সমাজের আনাচে কানাচে ঘটে চলা অপরাধের চিত্র প্রকাশ্যে এনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইকে যে শক্তিশালী করতে পারে সেটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। পাপারাৎজি কারবার নয়, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার হরণ নয়, প্রকাশ্যে সংগঠিত অপরাধের চিত্র তুলে ধরা প্রশংসনীয় কাজ। অথচ সেকাজের জন্যই গ্রামের এক বাসিন্দাকে পুলিশকে দিয়ে হয়রান করতে নেমেছে তৃণমূল। যোগীরাজের অনুকরণে থমকে গিয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও। মঙ্গলবার তিনি দিল্লি থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে শিলিগুড়িতে গেস্ট হাউসে আসেন। রাজ্যপালের ঘোষিত কর্মসূচি ছিল চোপড়াতে গিয়ে নির্যাতিতার সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু নির্যাতিতার নতুন বয়ান শুনে তিনি আর চোপড়ামুখো হননি। দিল্লি ফিরে গিয়েছেন আবার বাগডোগরা থেকেই। যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নির্যাতিতা এখন একলা থাকতে চান বলে শুনেছি। ভবিষ্যতে তিনি যে কোনও সময়ে রাজভবনে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেন।’
এই রকম ঘটনার পরে রীতিই হলো জাতীয় এবং রাজ্য স্তরের মানবাধিকার ও মহিলা কমিশন উদ্যোগী হয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সবরকমের ত্রাসমুক্ত পরিবেশে নির্যাতিতাকে রেখে গোটা ঘটনার সঠিক তদন্তের ব্যবস্থা করবে। এখনও পর্যন্ত যার কোনও লক্ষ্মণই দেখা যায়নি। শুধু দীঘলগাঁও নয়, চোপড়ার লক্ষ্মীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের মোহনগছ গ্রামেও কিছুদিন আগে সালিশির নামে মহিলাকে মারধরের ঘটনার অভিযোগ রয়েছে জেসিবি’র নামে। কিন্তু সেখানেও এখন একটানা সন্ত্রাস চলছে তৃণমূলের। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিধায়ক ঘনিষ্ঠ জেসিবি’র শাগরেদ গির আলম। চোপড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ, গোটা চোপড়ায় সন্ত্রাস চলছে। জেসিবি পুলিশি হেপাজতে আছে ঠিকই, তবে ওর ঘনিষ্ঠ গির আলম সহ দুষ্কৃতীরা এমনকি কাঠালবাড়ি গ্রামের সেইসব গুন্ডা যারা গতবছর পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় মনসুর আলমকে খুন করেছিলো তারাও এলাকায় সন্ত্রাস চালাচ্ছে। চোপড়া থেকে দাসপাড়া ঘিরনিগাও মারধর করে টাকা আদায় করা এসব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এলাকার চা বাগান বেদখল, জমি দখল, বালি চুরি, টাকা আদায়, সবই চলছে। পুলিশ প্রশাসন সব জেনেও চুপ করে রয়েছে।
সিপিআই(এম)’র উত্তর দিনাজপুর জেলা সম্পাদক আনোয়ারুল হক বলেছেন, লক্ষ্মীপুর আতঙ্কগ্রস্ত। তৃণমূল ভয়ভীতির বাতাবরণ তৈরি করেছে। জেসিবি বাহিনীর অন্যান্যরা নির্যাতিতার বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছে, তাই তারা ভয়ে অন্য কথা বলছে। আমরা দাবি করছি, সন্ত্রাসের অবসান ঘটিয়ে ভয়মুক্ত করতে হবে এলাকাকে। দীঘলগাওয়ের সালিশি সভায় জেসিবি ছাড়াও ওর যে সঙ্গীরা অত্যাচার করেছে তাদেরও গ্রেপ্তার করতে হবে।
ব্লক কংগ্রেস সভাপতি মশিরউদ্দিন বলেছেন, জেসিবি গ্রেপ্তার হয়েছে কিন্তু বুলডোজার, রোলার, ক্রেন, ট্রাক্টররা তো এখনও বাইরে। এই বাহিনী চোপড়ার বিধায়কের নেতৃত্বে এলাকা সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস সমর্থক তিনজনকে খুন করেছে ওরা জেসিবি’র নেতৃত্বে। পুলিশ তৃণমূলের দলীয় বাহিনীর মতো কাজ করছে। তাদের কাছে ন্যায় বিচার পাওয়া দূরের কথা, এলাকার মানুষ ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
Comments :0