Bhangor

ভাঙড়ে গুলিতে মৃত দুই আইএসএফ কর্মী, ফের জনতার প্রতিরোধে বন্দি আরাবুল

রাজ্য

কাশীপুর থানার পুলিশ শোনপুকুরে এসে আইএসএফ ও সিপিআই(এম) কর্মীদের আশ্বাস দিয়েছিল, যে বিডিও অফিসে এসে মনোনয়ন জমা দিয়ে যান, কোনও অসুবিধা হবে না।
প্রার্থীদের সঙ্গেই আসছিলেন পেশায় রঙের মিস্ত্রি মহিউদ্দিন মোল্লা। আইএসএফ কর্মী হিসাবেই পরিচিত এলাকায়। বিজয়গঞ্জ বাজার সংলগ্ন মেলা মাঠের কাছে তাঁদেরকে ছেড়ে দিয়ে পুলিশ সরে যায়। মেলা মাঠের আগে নিমতোড়িয়া মোড়ের সামনে আগে থেকেই জড়ো হওয়া তৃণমূলী দুষ্কৃতীরা আইএসএফ-কে আসতেই দেখেই গুলি চালায়। মহিউদ্দিন মোল্লার (২৪) মাথায় লাগে, ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন। মৃত্যু হয় তাঁর। গুলিবিদ্ধ হয়েই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় আরও একজন আইএসএফ কর্মীর। মৃতের নাম সেলিম মোল্লা (২৫)। চালতাবেড়িয়া পঞ্চায়েতের বাসিন্দা এই যুবক। রাতে আরজিকর হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। 
অন্যদিকে তৃণমূলের তরফে এদিন দাবি করা হয়েছে রশিদ মোল্লা নামে তাঁদের একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তাঁর বাড়ি ক্যানিংয়ের জীবনতলা এলাকায়। যদিও জীবনতলার বাসিন্দার ভাঙড়ে মৃত্যু হলো কেন তার সদুত্তর তৃণমূল দিতে পারেনি। রাতে তৃণমূলের দাবি তাদের আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে, বহিরাগত বলে নাম ও ঠিকানা বলা হয়নি শাসকের তরফে।  
গত তিনদিনে একাধিকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ভাঙড়ে। খোদ ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক শওকত মোল্লা জীবনতলা, বাসন্তী থেকে দুষ্কৃতী বাহিনী নিয়ে এসে হামলা চালায়। লক্ষ্য একটাই, যাতে মনোনয়ন জমা দিতে না পারে সিপিআই(এম) ও আইএসএফ! 
খোদ মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত ভাঙড়ে তৃণমূলীদের সশস্ত্র, রক্তক্ষয়ী হামলা, সন্ত্রাসকে প্রকারান্তরে যেন বৈধতা দিয়েছেন। এদিন সাংবাদিকদের সামনে তিনি বলেন, ‘যারা বিরোধী আছে ওখানে, নতুন জিতেছে (পড়ুন আইএসএফ) তারাই প্রথম গন্ডগোল করেছে পরশুদিন (পড়ুন মঙ্গলবার)। ওখানে ভাঙচুর, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। আমাদের তরফে কালকে (পড়ুন বুধবার) একটা প্রতিবাদ হয়েছে। যেটা সত্যি আমি বলব।’ অর্থাৎ বুধবার ভাঙড়-১-এ তাণ্ডবলীলা চলেছে, গুলি, বোমার বৃষ্টি হয়েছে, একজন বিরোধী প্রার্থীকেও মনোনয়ন দিতে দেয়নি শওকত, আরাবুল বাহিনী সেই ঘটনাকেই সামান্য ‘প্রতিবাদ হয়েছে’ বলে মনে করেন খোদ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। ভাঙড়ের পরিস্থিতি আসলে কী তা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যেই স্পষ্ট।
তবে মুদ্রার অন্য পিঠও আছে। তাতে আছে দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া গ্রামের মানুষের অদম্য জেদের মরিয়া লড়াইয়ের ছবি। 
প্রতিরোধী মেজাজের অনন্য ছবি এদিন ফের দেখল ভাঙড়-২নম্বর ব্লক। 
দুপুরে আইএসএফ কর্মীর রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখেছেন আইএসএফ-সিপিআই(এম) কর্মীরা। দুপুর সাড়ে তিনটে পর্যন্ত শওকত, আরাবুলের সশস্ত্র বাহিনী ঘিরে রেখেছ বিজয়গঞ্জে ভাঙড়-২নম্বর ব্লক অফিস।
দুপুর চারটের পর থেকে বদলে গেছে পরিস্থিতি। মরিয়া হয়েই মানুষ ফের বিডিও অফিসে, মনোনয়ন দাখিলে। রাত ৯টা ১৫মিনিট। 
ব্লক অফিসের দোতলায় তখন আরাবুল ইসলাম সহ তাঁর দলীয় দুষ্কৃতী বাহিনীকে আটকে রেখেছেন ক্ষিপ্ত জনগণ। আদালতের নির্দেশেই বিডিও’র উপস্থিতিতে ব্লক অফিসের একতলায় তখনও চলছে সিপিআই(এম) ও আইএসএফ প্রার্থীদের মনোনয়ন পেশের পর্ব। আর ব্লক অফিসের বাইরে পাহারা দিচ্ছেন হাজারো মানুষ যাতে হামলা না চালাতে পারে সশস্ত্র তৃণমূলী বাহিনী। ভিতরে তালাবন্ধ হয়ে আটকে আরাবুল ইসলাম। বাইরে বেরোতে পারছেন না। পুলিশও হাত তুলে দিয়েছে।
ভাঙড়- ২নম্বর ব্লকের অফিসের দোতলায় এতদিন ধরে হচ্ছিল মনোনয়ন পর্ব। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে পরিস্থিতির চাপে মনোনয়ন প্রক্রিয়া একতলায় নামিয়ে আনা হয়। তার আগে এদিনই হাইকোর্ট নির্দিষ্ট ভাঙড়-২নম্বর ব্লকে আইএসএফ প্রার্থীদের মনোনয়ন আটকে দেওয়ার প্রসঙ্গে কাশীপুর থানা, ভাঙড় থানাকে নির্দেশ দেয় পুলিশকে নিরাপত্তার আয়োজন করেই মনোনয়ন পেশে সাহায্য করতে হবে আইএসএফ’র তিনজন প্রার্থীকে। এমনকি কলকাতা পুলিশ এলাকায় হেস্টিংস থানাকেও সঙ্গে নিতে হবে।
তার আগে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ভাঙড়- ১ ও ভাঙড়- ২ ব্লক দপ্তরের দখল নেয় তৃণমূল। বাসন্তী হাইওয়ে রোডে মোটা লাঠি, বাঁশ, গাছের ডাল হাতে নিয়ে মুখ ঢেকে মিছিল করে তৃণমূলীরা।  ব্লক দপ্তরের সামনে ১৪৪ ধারা প্রহসনে পরিণত হয়। ব্যাপক বোমাবাজি, গুলি চলে। একাধিক গাড়ি, বাইক ভাঙচুর হয়। কয়েকশো দলীয় কর্মী ব্লক দপ্তরের ভিতরে মনোনয়ন শুরুর আগে থেকেই ঢুকে পড়ে। ঠুঁটো জগন্নাথের মতোই ব্লক দপ্তরের বাইরে ছিল পুলিশ। সকালে সিপিআই(এম) প্রার্থীরা ভাঙড়-২ ব্লকে মনোনয়ন জমা দিতে গেলে তাঁদেরকে ব্লক দপ্তরে জেনারেটর ঘরে বন্দি করে রাখে তৃণমূলীরা। 
এদিকে ভাঙড়-২ ব্লক দপ্তরে আরাবুল ইসলাম ঢোকার পর সঙ্গে সঙ্গে সেই গেট আটকে দেয়। এমনকি সংবাদ মাধ্যমকেও ভিতরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। ব্লক দপ্তরের অদূরে বিজয়গঞ্জ বাজার সংলগ্ন মাঠের দখল নেয় তৃণমূলের সশস্ত্র বাহিনী। নির্বিচারে বোমা, গুলি ছোঁড়ে। 
সকাল থেকে প্রথমে সিপিআই(এম) প্রার্থীরা ফের এদিন ভাঙড়-২নম্বর ব্লকে মনোনয়ন দেওয়ার চেষ্টা চালায় যাবতীয় বাধা এড়িয়েই। ততক্ষণে তৃণমূলী বাহিনী তাণ্ডব শুরু করে দেয়। আটকে পড়েন আইএসএফ প্রার্থীরা। কিন্তু কেউ বাড়ি ফিরে যাননি। আদালতের নির্দেশের পরেও চলে তৃণমূলী বাধা। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে তিনটে পেরিয়ে গেছে। বিরোধীদের মনোনয়ন আটকে দেওয়া গেছে ভেবে শওকত মোল্লার বাহিনীর এরপর ভাঙড় ছাড়ে। এদিকে আদালতের নির্দেশ বাধ্যবাধকতায় পুলিশ ও বিডিও এবার ফের বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। সেই সময়তেই রীতিমতো মাথা ওপরে দুহাত তুলে লাইন দিয়ে একের পর এক আইএসএফ প্রার্থী ঢোকে মনোনয়নে। বিডিও অফিসের ভিতরে নিজের ঘরে আসেন আরাবুল ইসলাম। 
এদিকে আইএসএফ ও সিপিআই(এম) প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে জানতে পেরে হাজারের বেশি মানুষ চলে আসেন। তাঁর গোটা এলাকা ঘিরে নেয়। ব্লক অফিস ঘিরে পাহারা দিতে থাকে। ভিতরে তখন অবরুদ্ধ আরাবুল ইসলামও। আর একতলায় চলছে মনোনয়ন পর্ব। ক্ষিপ্ত জনগণের প্রতিরোধী চেহারা দেখে চম্পট দিয়েছে তৃণমূলী বাহিনী।
পিঠে কালশিটে দাগ, জামা ছিঁড়ে গেছে, তারপরেও নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই ভাঙড়ের চালতাবেড়িয়ায় পুলিশের সামনেই আইএসএফ-সিপিআই(এম) প্রার্থীরা চিৎকার করে বলছেন, সকাল আটটায় থেকে বেরিয়েছি, মনোয়ন না দিয়ে ফিরবো না। ভাঙড়ের ২ নম্বরে তিনটি স্তরে সিংহভাগ আসনে মনোনয়ন জমা দেওয়া হয়েছে।  
তার আগে সকালে তৃণমূলী হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আইএসএফ কর্মী মণিরুল মোল্লা, আসাদুল মোল্লাসহ বেশ কয়েকজন। বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করায় গুরুতর জখম হয়েছেন সাফিরুল মোল্লা নামে আরও এক আইএসএফ কর্মী। নিহত মহিউদ্দিন মোল্লার বাড়ি ভাঙড়-২ ব্লকের জয়পুর গ্রামে।
এদিকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ক্যানিং-১, ক্যানিং-২, বজবজ-১, বজবজ-২, মন্দিরবাজার, কাকদ্বীপ ব্লক দপ্তরেরও দখল নেয় তৃণমূলী বাহিনী। সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ী বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, বিরোধীদের মনোনয়নে বাধা দিতে জেলা জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে তৃণমূলের সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা। আর মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর ভাইপো দুজনেই জেলায় এদিন উপস্থিত থেকে সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবকে উৎসাহিত করেছেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় বিক্ষোভ, মিছিল, মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানো কর্মসূচি হবে।

Comments :0

Login to leave a comment