TMC

ভাঙড়ে জলাভূমি, কৃষিজমির মালিক মুখ্যমন্ত্রীর ভাই থেকে জেলবন্দি পার্থ

রাজ্য

সুদীপ্ত বসু: ভাঙড়
 

করোনা পর্বে লকডাউনের মধ্যেই ভাঙড়ে রাতারাতি জমির মালিক হয়ে গিয়েছি‍‌লেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই! 
কী আশ্চর্য! রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা মতো সেক্টর সিক্স (বানতলা) ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপের জন্য ভাঙড়-১ নম্বর ব্লকের যে যে মৌজার জমি অধিগ্রহণ করার কথা, সেই মৌজাগুলিতেই আগাম জমি কিনে ফেলেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ভাই থেকে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতিতে জেলে থাকা তৃণমূলের প্রাক্তন মহাসচিব এবং প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জিও। সরকারের পরিকল্পনা আগাম বুঝেই কি তবে কলকাতার লাগোয়া ভাঙড়ের বিস্তীর্ণ কৃষিজমি, জলাভূমি কেনা বা দখল করা শুরু করে দিয়েছেন শাসক তৃণমূলের নেতারা? 
মেগাসিটির জন্য প্রস্তাবিত মৌজা আন্দুলগেড়িতেই ১০ কাঠা ২ ছটাক ২.৫ বর্গফুট জমি ‘কিনেছেন’ মুখ্যমন্ত্রীর ভাই সমীর ব্যানার্জি ওরফে কার্তিক ব্যানার্জি। সরকারি তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জুলাই মাসে অর্থাৎ তৃণমূল তৃতীয়বারের জন্য সরকারে আসার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক ব্যানার্জি এই আন্দুলগেড়ি মৌজায় জমি কেনেন। অবশ্য ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতা কর্পোরেশনের ভোটের সময়ে কার্তিক ব্যানার্জির স্ত্রীর হলফনামায় তাঁর স্বামীর সম্পত্তির হিসাব দেওয়া হলেও ভাঙড়ের তাড়দহ পঞ্চায়েতের এই জমির উল্লেখ করা হয়নি তাতে! 
ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের তথ্য বলছে, কার্তিক ব্যানার্জি এই জমির রেজিস্ট্রি করেছেন ২০২১ সালের ৩০ জুলাই। সেই বছরের ডিসেম্বরে তাঁর স্ত্রী কলকাতা কর্পোরেশনের ভোটে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের ওয়ার্ড থেকেই তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছিলেন, নির্বাচনী হলফনামায় যদিও স্বামীর এই সম্পত্তির উল্লেখ ছিল না। সরকারি তথ্যই বলছে, ভাঙড়ের এই তাড়দহ পঞ্চায়েত এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা ও জমি মাফিয়া গৌতম মণ্ডল এখানে অ্যাটর্নি সেলার। ‘বায়ার’ হলেন কার্তিক ব্যানার্জি। ওই প্লটের নম্বর ০০৭৩৫, খতিয়ান নম্বর ০০৪২২। 
শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির তদন্তের মধ্যেই গত বছর এপ্রিল মাসে রাতের অন্ধকারে নথি পোড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল ভাঙড়ের এই আন্দুলগেড়ি মৌজাতেই। সিবিআই আধিকারিকরা সেখানে হানাও দেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সেই নথি পোড়ানোর জমির পাশেই মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের জমি! ডায়মন্ডহারবারের বিষ্ণুপুর থেকে যাদবপুর লোকসভার কেন্দ্রের ভাঙড়-কালীঘাটের ব্যানার্জির পরিবারের সম্পত্তির বিস্তার সর্বত্রই!
আগাম জমি কিনে নাও (বাজার মূল্যের চার ভাগের এক ভাগ দামে) বা গায়ের জোরে ভয় দেখিয়ে, পুলিশ লেলিয়ে জমি দখল করো। এরপর সরকার তার প্রকল্পের জন্য জমি নিতে এলে সরকারের সঙ্গে দরকষাকষিতে যাবে, বর্ধিত মূল্যের মুনাফা লুটবে কেবল জমি মাফিয়ারা। বঞ্চিত হবেন কৃষক, পাট্টাদাররা।
জমি কেলেঙ্কারির এই চেহারাই নগ্নভাবে ধরা দিয়েছে ভাঙড়ে। ‘সেক্টর সিক্স (বানতলা) ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ’— সরকারের এই ঘোষণায় কার্যত যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে তৃণমূলী বাহিনী, জমির দালালরা। শাসক দলের এই কারবার আদৌ প্রশাসনের অগোচরে হচ্ছে না। স্থানীয় থানা, প্রশাসন, ব্লক ভূমি দপ্তর সবাই যদিও মুখে কুলুপ এঁটেছে। আর দিনেদুপুরে চোখের সামনেই লুট হচ্ছে বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি, জলাশয়, পাট্টার জমি।
তাড়দহ পঞ্চায়েতের মাখালতলা গ্রাম। আদিবাসী-প্রধান গ্রাম। প্রায় ৯৫টি পরিবার। সিংহভাগই দিনমজুর। সেই মাখালতলাতেই গিয়ে দেখা গেল, শুধু এই গ্রামেই ২০০ বিঘার বেশি জমি দখল করে ফেলেছেন তৃণমূলী পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ও জমির কারবারি রাকেশ রায় চৌধুরি। গ্রামেরই বাসিন্দা রাম সর্দার। তাঁর জমি দখল করে তাঁর চোখের সামনে তা ঘিরে পাঁচিল তোলার কাজ চলছে। দু’বিঘার বেশি জমি। জমি দিতে চাননি রাম সর্দার। তার জন্য মার খেতে হয়েছে। তাঁর ছেলে ভোলা সর্দারকেও রাকেশের বাহিনী পিটিয়েছে। তাতেও আত্মসমর্পণ করেননি প্রৌঢ় রাম সর্দার। থানাতেও অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কেএলসি থানার আধিকারিক পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘‘তৃণমূল নেতা রাকেশ রায় চৌধুরির সঙ্গে কথা বলে মিটিয়ে নিন, টাকা তো দেবেই, জমি ছেড়ে দিন।’’ নাম মাত্র টাকা দিয়ে এরপর দখল করে নেওয়া হয় জমি। ‘‘আদিবাসী ঘরগুলিতে কাগজ নিয়ে ঘুরছে তৃণমূল, টিপ সই দিয়ে জলাভূমি দখল করছে, টিপ সই দিলে নগদ কিছু টাকা গরিব মানুষগুলোর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। সামান্য মাছ চাষ করতো, তাও বন্ধ। গ্রামেও কোন কাজ নেই, শুধু তৃণমূল নেতারা জমির ব্যবসা করে কোটিপতি হচ্ছে।’’ বলছিলেন জমি হারানো পরিবারের সদস্য দেবালা সর্দার। 
শত হুমকি, হামলা, মারধর, থানা থেকে পুলিশের শাসানির পরেও টাকা নেননি পবিত্র মাহাতো। ‘‘আমার আড়াই বিঘা দখল করে নিয়েছে হেমন্ত মণ্ডলরা। জমির দালাল সবাই তৃণমূল। রাকেশ রায়চৌধুরির লোক এরা। মাখালতলার মহিলার রাস্তায় নেমে বিক্ষোভও দেখিয়েছিল তৃণমূলের জমি হাঙরদের বিরুদ্ধে। আমাকে হামলার সময়ে গ্রামের বাসিন্দারাই বাঁচিয়েছিল। সেদিন বিক্ষোভের মুখে পড়ে তৃণমূলের নেতারা পালিয়ে যায়। আমার জমির কাগজ আমার হাতে, অথচ ওরা সেই জমি দখল করে পাঁচিল তুলে দিচ্ছে। কেউ স্বেচ্ছায় দেয়নি। মারধর করে জমি কাড়া হচ্ছে, আমাকে ঘরছাড়াও থাকতে হয়েছিল নিজের জমি রক্ষার জন্য।’’ গত পঞ্চায়েত ভোটে এখান থেকেই সিপিআই(এম)’র জেলা পরিষদের প্রার্থী হয়েছিলেন ভাস্কর নস্কর। তাঁর কথায়, ‘‘এখানে যা চলছে, তা ভাবতেও পারবেন না। পাট্টার জমি পর্যন্ত লুট করে নেওয়া হচ্ছে। সন্দেশখালিতেও দেড় হাজার বিঘা জমি লুট হয়নি। ভারতে কোথায় হয়েছে মাত্র কয়েক বছরে এত পরিমাণ জমি লুট?’’
ভাঙড়-১ নম্বর ব্লক হলেও এটি জয়নগর লোকসভা ও ক্যানিং-পূর্ব বিধানসভার মধ্যে পড়ে। অভিষেকের ডান হাত সওকত মোল্লার সন্ত্রাসে অবরুদ্ধ গোটা তল্লাট। তার মধ্যে প্রতিবাদও হচ্ছে। তারদহ অঞ্চলের ঝাউখালিতে আদিবাসীরা ইতিমধ্যে লুটের জমির পাঁচিল ভেঙে দিয়েছেন। ফের জোটবদ্ধ হচ্ছে মানুষজন। 
এই ঝাউখালিতেই বিলাসবহুল বাগান বাড়ি বানিয়েছেন তৃণমূল নেতা, জমি হাঙর গৌতম মণ্ডল। তার বিলাসবহুল বাগানবাড়িতে একাধিক তৃণমূল নেতা এবং গত বিধানসভা ভোটে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন, টলিউডের এমন অভিনেত্রীও আসতেন বলে দাবি গ্রামবাসীদের। এই গৌতম মণ্ডলের অফিসেই দেখা যেত কালীঘাটের কাকুকে। ঝাউখালিতেই ‘অপা’ অর্থাৎ অর্পিতা মুখার্জি এবং পার্থ চ্যাটার্জির নামেও জমি রয়েছে।
সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সদস্য তুষার ঘোষের কথায়, ‘‘এই তারদহ কাপাসআটি মৌজায় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রায় চার বিঘা জমি খাস হয়। তারপর তা বিলি করা হয়, পাট্টা বণ্টনও হয়। কিছু জমি আইনি জটিলতায় আটকে ছিল, যদিও জমির দখল ছিল কৃষকের হাতে। মমতা ব্যানার্জির সরকারের জমি নীতি আসলে কী, তা ভাঙড়েই স্পষ্ট। রামসার সাইটের অন্তর্গত জলাভূমিও বাদ দিচ্ছে না। আদিবাসীদের জমি হস্তান্তর করা যায় না, তাও কেনাবেচা করছে।’’

 

Comments :0

Login to leave a comment