FLOOD BENGAL

এই বন্যার দায় কার?

সম্পাদকীয় বিভাগ

দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন সংক্ষেপে ডিভিসি স্বাধীন ভারতের প্রথম বহুমুখী নদী উপত্যকা প্রকল্প। ১৯৪৮ সালের ৭ জুলাই ভারতীয় গণপরিষদের একটি আইন বলে (Act No. XIV of 1948) এই কর্পোরেশন তৈরি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি ভ্যালি অথরিটির আদলে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন গড়ে ওঠে। প্রথম দিকে ডিভিসি’র মূল উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ, পরিবেশ সংরক্ষণ, বনসৃজন এবং এই প্রকল্পের আওতাধীন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি। বিগত কয়েক দশক ধরে অবশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনই ডিভিসিতে অত্যধিক গুরুত্ব পেয়ে আসছে। নিম্ন দামোদর উপত্যকায় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও হুগলী জেলার সম্পূর্ণ এবং পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, হাওড়া জেলার কিছু অংশ ডিভিসি প্রকল্পের আওতাধীন। ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে এই সমগ্র অঞ্চলের আয়তন ২৪,২৩৫ বর্গকিলোমিটার। সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ছিল এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু সেই লক্ষ্য থেকে অনেকটাই সরে এসেছে ডিভিসি। এই প্রকল্পের অধীনে ১৯৫৩ সালে তিলাইয়াতে দামোদরের উপনদী বরাকর নদীর উপর একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৫৫ সালে কোনারে দামোদরের অপর উপনদী কোনার নদীর উপর দ্বিতীয় বাঁধটি নির্মিত হয়। ১৯৫৭ সালে মাইথনে বরাকর নদীর উপর এবং ১৯৫৯ সালে পাঞ্চেতে দামোদর নদীর উপর আরও দুটি বাঁধ নির্মিত হয়। এই চারটি বাঁধই ডিভিসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন প্রধান বাঁধ। ১৯৫৫ সালে দুর্গাপুরে দামোদর নদের উপর নির্মিত হয় দুর্গাপুর বাঁধ। এই বাঁধ থেকে নদীর দু’ধারে অবস্থিত অন্যান্য খাল ও নদীগুলিতে জল সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ১৯৭৮ সালে বিহার সরকার (অধুনা ঝাড়খণ্ড) ডিভিসি’র নিয়ন্ত্রণের বাইরে তেনুঘাটে একটি বাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধগুলি নির্মাণের পর প্রায় ৭০-৭৫ বছর অতিক্রান্ত। এই দীর্ঘ বছর ধরে সব বাঁধের জলাধারগুলির নাব্যতা কমেছে পলির আস্তরণে। একইভাবে নদীগুলির নাব্যতাও কমেছে। কিন্তু এই জলাধারগুলি ও নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য কোনও নিয়মিত ড্রেজিং-এর ব্যবস্থা নেই। দুর্গাপুর বাঁধ ও জলাধার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন। ২০১০-১১ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার দুর্গপুরের ডেজিং-এর জন্য ৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তন হয়। ক্ষমতায় আসে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমুল। সেই অর্থ বেমালুম অন্য খাতে ব্যয় করে দেওয়া হয়। সেদিন দুর্গাপুরের ড্রেজিং-এর কাজ হলে, প্রতি বছর বন্যা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হতে পারতো। কেন একাজ করা হলো না? কি উত্তর দেবেন মুখ্যমন্ত্রী? দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন গঠনের সময় থেকে ডিভিসি আইন অনুযায়ী ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি রয়েছেন পরিচালন কমিটিতে। তাহলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কী ভূমিকা নিয়েছে সেখানে? জলাধার নদীর নাব্যতা বাড়াবার জন্য ড্রেজিং-এর কথা বলেছেন? রাজ্যের শাসক দলের ২৯ জন সাংসদ লোকসভাতে আছেন, রাজ্যসভায় আছেন আরও ১২ জন। এরা কতবার সংসদের উভয় কক্ষে কতবার এই নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন? ভাইপোকে সিবিআই বা ইডি ডাকলেই তো মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর দরবারে চলে যান। ডিভিসি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কতবার তিনি প্রধানমন্ত্রীর দরবারে হাজির হয়েছেন? বেআইনিভাবে তৃণমূলের নেতাদের প্রত্যক্ষ মদতে এই সব নদী থেকেই প্রতিদিন বালি পাচার হচ্ছে, ফলে নদীখাতের চেহারাই যাচ্ছে পালটে। একারণে বন্যার বিপদ আরও বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী তার দায় এড়াতে পারেন না। 
পশ্চিমবঙ্গের ভয়াবহ আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিশেষত আর জি করকাণ্ডের প্রতিবাদে যে গণবিক্ষোভের ঢেউ উঠছে, তার থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর জন্যই সীমান্তে লরি আটকানো, ডিভিসি পরিচালন বোর্ড থেকে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার করে চিরায়ত চমক তৈরি করার চেষ্টা করে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এসব বন্ধ করে সরকারি ত্রাণ পাঠান, ত্রাণ সামগ্রী-অর্থ লুট বন্ধ করুন, ডিভিসি’র অন্তর্গত এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আলোচনায় বসুন আর দুর্গাপুর বাঁধ ও জলাশয়ের ড্রেজিং-রক্ষণাবেক্ষণে আপনার সরকারের দায়িত্ব পালন করুন।

Comments :0

Login to leave a comment