Women’s Cricket World Cup 2025

মধ্যরাতে ভারতে নতুন ভোর আনলো মেয়েরা

খেলা

বিশ্বকাপ ভারতের। আরব সাগরের পারে রচনা হল নতুন ইতিহাস। ভারতের মহিলা ক্রিকেটারদের মাথায় এবার বিশ্বজয়ের মুকুট। 
রবিবার মুম্বাইয়ে বৃষ্টি দু’ঘন্টা পিছিয়ে দিয়েছিল বিশ্বকাপ ফাইনাল। শেষ পর্যন্ত টসের সময় যখন ভারত অধিনায়ক হরমনপ্রীত কাউর এগিয়ে এলেন তখন নবি মুম্বইয়ের ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে প্রবল জনগর্জন। বছর দুয়েক আগে এই নভেম্বরেই, রোহিত শর্মাদের জন্য এরকমই জনসমর্থন ছিল। তবে, সেদিন না হলেও এদিন হল। প্রথমে ব্যাট করে ৭ উইকেট হারিয়ে ভারত তোলে ২৯৮ রান। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ২৪৬ রানে আটকে গেল প্রোটিয়াদের ইনিংস। ৫২ রানে জিতে অধরা মাধুরীর স্বাদ পেল ভারতের মেয়েরা। ব্যাটে বলে স্মরণীয় ইনিংস উপহার দিলেন শেফালি ভর্মা ও দীপ্তি শর্মা। 
টস হেরে ব্যাট করতে নেমে দুরন্ত শুরু করে ভারতের দুই ওপেনার। বৃষ্টিভেজা মুম্বইয়ে কিছুটা ধীর লয়ে ইনিংস শুরু করেছিলেন স্মৃতি। তবে, অপর প্রান্তে প্রথম থেকেই বিধ্বংসী ছিলেন শেফালি। দক্ষিণ আফ্রিকার কোনও বোলারদেরই রেয়াত করলেন না। আয়াবঙ্গা খাকাকে স্কোয়ারকাটে চার মেরে শুরু করেছিলেন, যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন সেই খেলাই চালালেন ২১ বছরের ভারতীয় ওপেনার। দল থেকে বাদ পড়ার পর প্রতীকা রাওয়ালের চোটে হঠাৎ সুযোগ আসে সেমিফাইনালে। সেই ম্যাচে শুরু করেও দ্রুত ফিরতে হয়েছিল, এদিন কাজে লাগালেন। নিয়মিত রান রোটেট করলেন দু’জনে। ধীরে রানের গতি বাড়ান স্মৃতিও। ১৮ ওভারেই দুই ওপেনারের ব্যাটে দলের শতরান পার হয়ে যায় স্কোর বোর্ডে। দলের ১০৪ রানের মাথায় ফেরেন স্মৃতি। হাতছাড়া করলেন চলতি বিশ্বকাপের তৃতীয় অর্ধশতরান। ফাইনালের মঞ্চে ৪৯ রান এল ভারতীয় দলের সহ অধিনায়কের ব্যাট থেকে। মোট ৪৩৪ রান করলেন প্রতিযোগিতায়। এক বিশ্বকাপে ভারতীয়দের মধ্যে সর্বাধিক। ছাপিয়ে গেলেন প্রাক্তন অধিনায়ক মিতালী রাজকে (৪০৯)। এবারের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বাধিক রানের মালকিন হলেন স্মৃতি। তাঁর আগে থাকলেন প্রোটিয়া অধিনায়ক লরা উলভার্ট (৫৭১)।
স্মৃতি ফিরলেও আক্রমণ থামাননি শেফালি। জেমাইমা রড্রিগেজের সঙ্গে জুটি বেঁধে দলের স্কোর বোর্ড সচল রাখলেন। একদিনের ক্রিকেটে পঞ্চম অর্ধশতরান সম্পূর্ণ করেন শেফালি। মাঝে ক্যাচ পড়ে জীবনদান পাওয়া ছাড়া ঝকঝকে ইনিংস। কে বলবে, এই শেফালিই গত তিন বছরে একদিনের ক্রিকেটে একটাও পঞ্চাশ পাননি! অর্ধশতরানের পর পেশিতে টান ধরায় কিছুটা অসুবিধায় পড়েন তিনি। দৌড়াতে সমস্যা হচ্ছিল। ফলে চার-ছয়ের দিকেই ঝুঁকলেন। তাই একটু তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই ফিরতে হল। তবে তাঁর আক্ষেপ থেকে যাবে, সামান্য কটা রানের জন্য শতরান হাতছাড়া হওয়ায়। কিন্তু ৭৮ বলে ৮৭ রানের যে ইনিংসটা খেলে গেলেন, সেটা রীতিমতো বাঁধিয়ে রাখার মতো ঝকঝকে। আয়াবঙ্গার বলে ক্যাচ দেওয়ার আগে তিনি ৭টি বাউন্ডারি ও দুটি ওভার বাউন্ডারির চোখ ধাঁধানো ইনিংস খেলে গিয়েছেন। তবে, মহিলাদের একদিনের বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের সর্বাধিক রান এল শেফালির ব্যাট থেকে। তাঁর ৮৭ রানের ইনিংস ভেঙে দিল পুনম রাউতের ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা ৮৬ রানের রেকর্ড। 
শেফালি ফেরার পরই আচমকাই রানের গতি কিছুটা কমে যায়। বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারলেন না শেষ ম্যাচে শতরানকারী জেমাইমা (২৪)। ব্যর্থ হলেন অধিনায়ক হরমনপ্রীতও (২০)। এরপর মাটি কামড়ে ২২ গজের একপ্রান্ত আটকে রাখলেন দীপ্তি। আমনজ্যোৎ কাউর (১২) আউট হওয়ার পর জুটি বাঁধলেন রিচা ঘোষের সঙ্গে। ফের এদিন ফিনিশার ইনিংস খেললেন বাংলার মেয়ে। তাঁর ব্যাটে কিছুটা বাড়ল রানের গতিও। গ্রুপ পর্বের দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে আট নম্বরে নেমে ৯৪ রান এসেছিল রিচার ব্যাটে। তারপরও কেন ফাইনালে তাঁকে পাঠানো হল সাত নম্বরে? কেন তুলে আনা হল না উপরের দিকে, সেই প্রশ্ন থাকবে। এদিন রিচার ঝোড়ো ব্যাটে এল ২৪ বলে ৩৪ রানের দাপুটে ইনিংস। মারলেন ৩টি চার ও ২টি ছয়। রিচা ফেরার পর দীপ্তি আরেকটু ঝুঁকি নিলে হয়ত ৩০০ রান পার হয়ে যেত ভারতের। কিন্তু তা আর হয়নি। দীপ্তি শেষ বলে রান আউট হলেন ৫৮ বলে ৫৮ রান করে।
প্রায় ৩০০ রান তাড়া করতে নেমে ধীরে চলো নীতিতে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকাও। তবে, সময়ের তাজমিন ব্রিটসকে নিয়ে দলের ইংনিস গড়তে শুরু করেন অধিনায়ক উলভার্ট। ৯ ওভারে পঞ্চাশ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন দু’জনে। এরপরই ব্রিটস রেনুকা ঠাকুরের বল পুশ করে রান নেওয়ার সময়ই প্রোটিবাদের প্রথম ধাক্কা দিলেন আমনজ্যোৎ। মিডঅন থেকে তাঁর থ্রো ভেঙে দেয় উইকেট। ব্রিটস (২৩) রান আউট হতেই ফের গর্জে উঠল স্টেডিয়াম। তিনে নামা অ্যানি বস্ককে খাতা খুলতে দিলেননা শ্রী চরাণী। তবে, সুন লুসকে নিয়ে ফের ইনিংস গড়তে শুরু করেন প্রোটিয়া অধিনায়ক। নিজের চলতি বিশ্বকাপে নিজের চতুর্থ অর্ধশতরানও পুর্ণ করেন উলভার্ট। তৃতীয় উইকেটের জুটি যখন স্টেডিয়ামকে খানিক চুপ করিয়ে দিয়েছিল, তখন শেফালির হাতে বল তুলে দিলেন অধিনায়ক হরমনপ্রীত। ১৯৮৩ সালে কপিল দেবকে যে ভরসা যুগিয়েছিলেন মহিন্দার অমরনাথ এদিন তাই করলেন ‘হরিয়ানা কি ছোড়ি’। দ্বিতীয় বলেই একক দক্ষতায় (কট অ্যান্ড বোল্ড) তুলে নিলেন লুসকে (২৫)। নিজের দ্বিতীয় ওভারে এসে ফের ধাক্কা দিলেন প্রোটিয়াদের। এবার তুলে নিলেন মারিজান কাপকে (৪)। পরপর দু’উইকেট হারিয়ে কিছুটা চাপে পড়ে প্রোটিয়ারা। উইকেট রক্ষক সিনালো জাফতাকেও (১৬) দ্রুত সাঝঘরে পাঠালেন দীপ্তি। চাপে পড়া দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে হঠাৎ গতি বাড়ান অ্যানারি ডার্কসেন। ৩২ ওভারে রাধা যাদবকে জোড়া ছয় মারেন তিনি। এরপরই ফের জাঁকিয়ে বসেন প্রোটিয়া অধিনায়ক। ম্যাচে তৃতীয় অর্ধশতরানের জুটি গড়েন তিনি। ৬১ রানের জুটি ভাঙেন দীপ্তি। ডার্কসেনকে (৩৫) তুলে নেন তিনি। 
একদিকে উইকেট পড়লেও অন্য প্রান্তে মাটি কামড়ে পড়েছিলেন উলভার্ট। চলতি বিশ্বকাপের তৃতীয় ও মহিলা আন্তর্জাতিক একদিনের ক্রিকেটের ১১ তম শতরান পূর্ণ করেন প্রোটিয়া অধিনায়ক। একই সঙ্গে এক বিশ্বকাপে সর্বাধিক রানের মালকিনও হলেন তিনি। টপকে গেলেন অস্ট্রেলিয়ার অ্যালিসা হিলিকে (৫০৯)।  তবে শতরানের পরই বিচ্যুতি। দীপ্তির বলে তুলে মারতে গিয়েই ধরা পড়লেন অমোনজ্যোতের হাতে। তিনবারের চেষ্টায় বল তালুবন্দি করে নেন তিনি। এককথায়, তালুবন্দি করে নেন বিশ্বকাপও। উলভার্ট ফেরেন ১০১ রানে। ওই ওভারেই ক্লো ট্রায়ানকেও (৯) ফেরান দীপ্তি। শেষ দিকে নাদিন দে ক্লার্ক কিছুটা চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি (১৮)। সেই দীপ্তির বলেই তাঁর ক্যাচ ধরলেন অধিনায়ক হরমনপ্রীত। ২৪৬ রানে আটকে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। ৫ উইকেট তুলে নিলেন দীপ্তি। প্রথমবার সেই আরব সাগরের তীরেই প্রথম বিশ্বজয়ের সাধ পেলেন হরমনপ্রীতরা। 
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ভারত ২৯৮/৭
শেফালি ৮৭, দীপ্তি ৫৮
আয়াবঙ্গা ৩/৫৮
দক্ষিণ আফ্রিকা ২৪৬
উলভার্ট ১০১, ডার্কসেন ৩৫
দীপ্তি ৫/৩৯
 

Comments :0

Login to leave a comment