prakash karat

হিন্দুত্ব-কর্পোরেট মিশেলে গুণগত পরিবর্তন এসেছে বললেন প্রকাশ কারাত

জাতীয় রাজ্য

prakash karat

প্রসূন ভট্টাচার্য: হাওড়া


হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে কর্পোরেট স্বার্থের মিশেলে দেশের সামনে স্বাধীনতার পরবর্তীকালের সবচেয়ে বড় বিপদ নিয়ে এসেছে মোদী সরকার। বৃহস্পতিবার সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের দশম সম্মেলনের বিশেষ অধিবেশনে এই কথা বলে সতর্ক করেছেন সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত। তিনি বলেছেন, শুধুমাত্র জীবনজীবিকার দুর্দশা মোচনের দাবিতে গণসংগ্রাম সফল হবে না, এর জন্য হিন্দুত্ববাদের সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালাতে হবে। কারণ হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে কর্পোরেট শক্তি একত্রিত হয়েছে। কর্পোরেট স্বার্থবাহী আগ্রাসী নয়া উদারনীতির মোকাবিলা করতে হলে একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের বিরুদ্ধেও লড়াই চালাতে হবে। দুটি লড়াই একসঙ্গে চালাতে হবে।


   হাওড়ার শরৎ সদনে সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের দশম সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় একটি বিশেষ অধিবেশন হয় চারটি বিষয়ের ওপরে সেমিনার অনুষ্ঠিত করে। ‘হিন্দুত্ব-কর্পোরেট আঁতাত এবং বামপন্থীদের ভূমিকা’ বিষয়ের ওপরে ভাষণ দিয়ে প্রকাশ কারাত কীভাবে এই আঁতাত গড়ে উঠেছে, তার পরিণতি কী হতে পারে এবং তা রুখতে কী করতে হবে তার উল্লেখ করেছেন খেতমজুর আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সামনে। তিনি বলেছেন, মোদী সরকার আরএসএসেরও প্রতিনিধিত্ব করছে, কর্পোরেট শক্তিরও প্রতিনিধিত্ব করছে। শুরু থেকেই আরএসএস কখনো পুঁজিবাদবিরোধী ছিল না, তাদের তৈরি জনসঙ্ঘও বরাবরই বেসরকারিকরণ এবং মুক্ত বাজারের কথা বলে এসেছে। নরসিমা রাওয়ের সরকারের নয়া উদারনীতিকে সমর্থন করে আদবানি বলেছিলেন যে ‘আপনি অবশেষে আমাদের নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন’। আরএসএস কখনোই নেহরুর রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থনৈতিক নীতি বা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পক্ষে ছিল না। ইউপিএ সরকার নয়া উদারনীতি রূপায়ণ করলেও তা পূর্ণ উদ্যমে নিয়ে যেতে পারেনি, তাদের দোদুল্যমানতা ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে মোদী সরকারে আসার পরে খোলাখুলি বেসরকারিকরণ ও কর্পোরেটদের ছাড়, জমি, প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দেওয়ার কাজ করেছেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পরে এই পদক্ষেপ আরও চড়া হয়েছে।

এই কারণের উল্লেখ করে কারাত বলেছেন, আগে অনেকে মনে করতেন যে বৃহৎ পুঁজি হিন্দুত্বকে মেনে নেবে না, এটা তাঁদের ব্যবসার পক্ষেও সুবিধাজনক হবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, বৃহৎ বুর্জোয়াদের কোনও অংশই মোদী সরকারে অসন্তুষ্ট নেই, মোদী তাদের প্রিয়, মোদীর সমর্থনে তারা চিয়ার লিডারদের মতো ভূমিকা পালন করছে। কারণ দুই শক্তিরই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রয়োজন। এরফলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। আরএসএস’এর হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে দমনমূলক ব্যবস্থা চাই। আবার কর্পোরেট শক্তির কাছেও মানুষের প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করে, অধিকার কেড়ে নিলেই সেটা বাণিজ্যবান্ধব পরিবেশ হয়। এই কারণে এরা পরস্পর হাত মিলিয়েছে। সংবিধানের চেহারা পালটে দিতে চাইছে নিজ নিজ স্বার্থপূরণের লক্ষ্যে। 
এই আঁতাতের বিরুদ্ধে লড়াইতেও দুটি কর্তব্য স্থির করতে বলেছেন প্রকাশ কারাত। তিনি বলেছেন, যদি একইসঙ্গে জীবনজীবিকার দাবিতে কর্পোরেট আগ্রাসনের বিরুদ্ধের লড়াই এবং হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই না চালানো যায় তাহলে কোনোটাই সফল হবে না। উত্তর প্রদেশের যে খেতমজুর নিজের অর্থনৈতিক দুর্দশার অভিযোগ করছেন, তিনিই মোদীর নেতৃত্বে শক্তিশালী ভারত গঠনের জন্য বিজেপি’কে সমর্থন করছেন। আদিবাসী, দলিত, যারা লাল ঝান্ডা হাতে আপনাদের সংগঠনের নেতৃত্বে জীবন-জীবিকার লড়াইতে আসছেন, তাঁরাও ভোটের সময় প্যান-হিন্দু পরিচিতিতে ঢুকে পড়ছেন এবং বিজেপি’কে সমর্থন করে ফেলছেন। কাজেই হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া কর্পোরেট আগ্রাসন মোকাবিলা করা যাবে না।


   এই প্রসঙ্গেই তিনি সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের মতো সমস্ত গণসংগঠনগুলির সক্রিয়তার আবেদন করে বলেন, হিন্দুত্ব ও কর্পোরেট আঁতাতের বিরুদ্ধে লড়াইতে বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নিশ্চয়ই দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু আরএসএস যেমন হিন্দুত্বের মতাদর্শ প্রচারে নিরন্তর সমাজের সর্বস্তরের নানা সংগঠনকে ব্যবহার করে, তেমনই এর মোকাবিলাতেও সমাজের সর্বস্তরে নানা সংগঠনের প্রয়াস জরুরি। কোনও অংশের মানুষকে কীভাবে বোঝানো সম্ভব হবে, কোন ভাষায় তাঁদের কাছে বক্তব্য তুলে ধরতে হবে তা একেক সংগঠনকেই ঠিক করতে হবে। 
  এই বিশেষ অধিবেশনে এছাড়াও ‘খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান’ বিষয়ে বলেছেন অধ্যাপক মধুরা স্বামীনাথন, ‘গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্কট’ বিষয়ে বলেছেন অধ্যাপক আর রামকুমার এবং ‘ভারতের সংবিধানের ওপরে আক্রমণ’ বিষয়ে বলেছেন আইনজীবী সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের সভাপতি এ বিজয় রাঘবন।


  গ্রামীণ গরিবের দুর্দশার অর্থনৈতিক কারণ স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মধুরা স্বামীনাথন এবং আর রামকুমার। স্বামীনাথন বলেছেন, ‘কোভিড পরবর্তী সব স্বাভাবিক বলে দেখানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় সরকার এবং সেই সঙ্গে গণবণ্টনে, একশোদিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ কমাচ্ছে। কিন্তু কিছুই স্বাভাবিক হয়নি, গ্রামে কাজের সুযোগ এবং মজুরি দুটোই কমেছে।’ এরসঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তা মানে মানুষের হাত বাড়িয়ে খাদ্য পাওয়ার এবং তা নেওয়ার অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করা। সেটা ক্রমশ কমছে বলেই ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান নামছে।’ রামকুমার বলেন, ‘গ্রামের মানুষ একই শ্রেণির নয়, সেখানে বৈষম্য আছে এবং জমির মালিকানাই তার সবচেয়ে বড় কারণ। যে সিলিং বহির্ভূত জমি এবং চাষযোগ্য খাস জমি সরকারের হাতে আছে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা হচ্ছে না কেন? উলটো পথে হেঁটে বিজেপি তার বদলে ভূমি সংস্কার আইনকেই দুর্বল করছে।’ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, খেতমজুর সহ সমস্ত অংশের শ্রমজীবী মানুষের অধিকারে ওপর আক্রমণ প্রতিহত করতে গেলে ভারতের বর্তমান সংবিধানকে রক্ষা করতে হবে। কারণ, স্বাধীনতা সংগ্রামের ফসল এই সংবিধানই শ্রমজীবী মানুষ সহ সাধারণ ভারতীয়দের এই নাগরিক অধিকারগুলি দিয়েছে। সেই সংবিধানের ওপরেই আক্রমণ নামিয়ে আনছে দক্ষিণপন্থী শক্তি। একে প্রতিহত করতেই হবে।

ছবি: অমিত কর

Comments :0

Login to leave a comment