স্বর্ণেন্দু দত্ত: অযোধ্যা
রামপথ জুড়ে উৎসবের পরিবেশ তৈরি। ব্যবস্থাপনায় সরকারই। ফৈজাবাদ-অযোধ্যার মূল সড়কের নামই এখন ‘রামপথ’। সেই সড়কের উপরেই খটিক সমাজ পঞ্চায়েতী মন্দিরের গেট। গেটের উপরে বানানো মূর্তি রাম-লক্ষ্মণকে শবরী জাম খাওয়াচ্ছেন। গেটের উপরে লেখা শবরী দ্বার। রামায়ণে শবরীর গল্প সকলেরই জানা। প্রভূকে টক জামটা দেবেন না বলে নিজের খাওয়া ফলই দিয়েছিলেন। রামও সেই ‘উচ্ছিষ্ট’ খেয়েছিলেন। এই নিয়ে ‘ভক্ত-ভগবান’ এর আবেগমথিত গল্প প্রচলিত। রামের মহত্ত্ব, করুণা বোঝাতেও এই গল্প ব্যবহৃত হয়।
অযোধ্যার সড়ক জুড়ে এখন অজস্র হোর্ডিংয়ে শবরী। অবশ্যই মোদীর সঙ্গে। রামচরিতমানস থেকে উদ্ধৃতি, ‘কন্দ মূল ফল সুরস অতি দিয়ে রাম কহুঁ আনি।/ প্রেম সহিত প্রভু খায়ে বারম্বার বখানি।’ এই হোর্ডিংগুলি মোটেই ভক্ত-ভগবানের প্রেম বোঝাতে নয়। খটিক বা সোনকর জাতের লোকেরা মনে করেন তাঁরা শবরীর বংশধর। উত্তর প্রদেশে খটিকরা তফসিলি জাতিভুক্ত, চলতি কথায় দলিত। কোনও কোনও রাজ্যে ওবিসি-ও। এদের কাছে রামকে ব্যবহার করে ‘আমি তোমাদের লোক’ সাজার চেষ্টা করছেন মোদী। একইভাবে নিষাদ রাজার গঙ্গা পার করে দেওয়ার গল্পকে কাজে লাগিয়ে নিষাদদেরও ধরে রাখার চেষ্টা আছে। সেই চেষ্টার অংশ হিসাবে শবরীর মতোই রামমন্দিরের উদ্বোধন উপলক্ষে হোডিংয়ে নিষাদ রাজের গল্পও আছে যথেষ্ট পরিমাণ। এই হোর্ডিংগুলি লাগিয়েছেন বিজেপি’র সাংসদ-বিধায়করা।
শবরীর মূর্তি বসানো খটিক মন্দিরের গেটের সামনে টেবিল সাজিয়ে চা বিলি করছিলেন দুই-তিন যুবক। কিন্তু খুবই সামান্য আয়োজন। সবাইকে দিতেও চাইছিলেন না। প্রশ্ন করে উত্তর মিলল, প্রশাসনকে দেখাতে চাইছি আমাদের সমাজের মন্দিরটা সচল আছে! কথা বলে মোদ্দা কথা বোঝা গেল। শবরী গেটের পিছনেই বিশাল ফাঁকা জমি মন্দিরের। তার ধারেই রাস্তার পাশে দোতলা বড় মন্দির খটিকদের। জীর্ণ মন্দিরের ভেতরের দেওয়ালেও শবরীর কাহিনী উৎকীর্ণ। মন্দিরের চারপাশ দেখিয়ে শিব্বু সোনকর বললেন, ৫৬ বিস্বা জমি আছে মন্দিরের। কমবেশি ৮০ হাজার বর্গফুট। সঙ্গে থাকা মাঝবয়সি ব্যক্তি গলার স্বর নামিয়ে বললেন, ‘জমিতে নজর পড়েছে মন্দির নির্মাণ ট্রাস্টের। বেশ কিছুদিন ধরেই নেওয়ার চেষ্টা করছে। এবারেও পার্কিংয়ের নাম করে চেয়েছিল। দিলেই দখল হয়ে যাবে, আর ফেরত পাওয়া যাবে না। জনমভূমির এত কাছে, সহজে এই জমি ছাড়বে না ট্রাস্ট।’
অযোধ্যা জুড়ে অভিযোগ, ফাঁকা জায়গা বা জীর্ণ মন্দির দেখলেই দখল নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে রামমন্দির নির্মাণ ট্রাস্ট। রামের ‘ভব্য’ মন্দির বানানোর নামে গোটা অযোধ্যা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে সঙ্ঘ, অভিযোগ করলেন অন্য একটি মন্দিরের হয়ে মামলাকারী এক আইনজীবী। তাঁর কথায়, ‘সুপ্রিম কোর্ট ২.৭৭ একর জমি দিয়েছিল মন্দির বানানোর জন্য। এরপরে অধিগৃহীত ৭০ একর জমির পুরোটাই মোদী সরকার দিয়ে দিয়েছে ট্রাস্টকে। তাতেও এদের হচ্ছে না। এখনই ১০০ একরের বেশি ছাড়িয়ে গেছে রাম মন্দির পরিসরের জায়গা। অথচ মন্দির ২.৭৭ একরের থেকেও কম জমিতে হয়েছে।’ ব্যারিকেডের ভেতরে যত মন্দির ছিল সব ভেঙে সমতল করে দেওয়া হয়েছে। দশরথ মহল মন্দিরের পূজারির মতে ৩০-৪০টা মন্দির ‘সমতল’ করে দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ‘জন্মস্থান’ নামের মন্দিরও আছে ৩০০ বছরের পুরনো। এছাড়াও ব্যারিকেডের বাইরে থাকা ফকিরে রাম বা কৌশল্যা ভবনের মতো মন্দিরের দখলও নেওয়া হয়েছে। সেগুলিও কিনে নিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এইসব নিয়ে আদালতে মামলাও হয়। এরমধ্যে ফকিরে রাম মন্দির বাঁচাতে শঙ্করাচার্য অভিমুক্তেশ্বরানন্দও এসেছিলেন। যাঁর সঙ্গে এখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের চূড়ান্ত সংঘাত বেঁধেছে। কিন্তু সে মন্দিরও বাঁচানো যায়নি। এরপরে অঙ্গদ টিলার জমি নিয়ে হনুমানগড়ির সঙ্গে সংঘাত হয়েছে ট্রাস্টের। যথারীতি ট্রাস্টের পক্ষেই কাজ করছে প্রশাসন, এমনই অভিযোগ হনুমানগড়ির সাধুদের। জমিতে হনুমানগড়ির দখলের সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন সেটাকে নজুল জমি ঘোষণা করে দিয়েছে। ফলে এই জমি ট্রাস্টকেই দিয়ে দেওয়া হবে বলে তাঁদের সন্দেহ।
মন্দির ভাঙা অবশ্য নতুন কিছু না বলেই মনে করিয়ে দিয়েছেন এলাকার পুরানো বাসিন্দারা। ১৯৯১ সালে বিজেপি’র সরকারের সময়েও এই রামজন্মভূমি পরিসরেই সাক্ষী গোপাল মন্দির, চূড়াকরণ মন্দির, সুমিত্রা ভবন ইত্যাদি এক ডজন মন্দির ভেঙেছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-বজরঙ দল। নেতৃত্বে ছিলেন বিনয় কাটিহার। ফকিরে রাম বাঁচাতে আবেদন করেছিলেন সন্তোষ দুবে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসে অভিযুক্ত হিসাবে সিবিআই চার্জশিটে দুবের নাম ছিল। বললেন, ‘‘এর আগে কাশী বিশ্বনাথ করিডোরের নামে মোদী বেনারসেও হাজারো মন্দির ভেঙেছে। এখন অযোধ্যাতেও সেই কাজ করছে। বাবর, আওরঙ্গজেবও এত মন্দির ভাঙতে পারেনি!’’ ফকিরে রাম মন্দির বাঁচানোর চেষ্টায় আদালতে মামলাকারী এক আইনজীবী বললেন, ‘‘অযোধ্যা আর রামের থাকবে না। এটা সঙ্ঘের হেডকোয়ার্টার হবে। সব এরা কিনে নেবে। কোনও ছোট মন্দির বাঁচবে না, এটা মিলিয়ে নেবেন।’’ রামমন্দির লাগোয়া রত্নসিংহাসন-রাজগদ্দি অনেক পুরানো মন্দির। সেই মন্দিরের এক সাধু জানালেন, রঙমহল, কৈকেয়ী কোপ, রামগুলেলা সহ রামকোটের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গার আধা ডজন মন্দির নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে ট্রাস্ট। এইসব মন্দির তুলনায় ক্ষমতাশালী। তাহলে বাইরের ছোট মন্দিরগুলির কী করার আছে। আর রাস্তা চওড়া করতে তো হাজারো মন্দির ভাঙা পড়েছে, সেটা বাদই দিন।
সেই আতঙ্ক চেপে বসেছে খটিক সমাজের মন্দিরেও। ট্রাস্ট্রের সদস্যদের এবং প্রশাসনের লাগাতার চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত সোনকররা নিজেদের জাতের মধ্যে যারা আরএসএসের মধ্যে আছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন মন্দির বাঁচানোর জন্য। খটিক মন্দিরের একটি ট্রাস্ট আছে। সেই ট্রাস্টের এক সদস্য জানালেন, ‘‘আমাদের সমাজের (জাতের) যারা আরএসএসে আছে তাদের দিয়ে শেষ পর্যন্ত মন্দির নির্মাণ ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক চম্পত রায়কে বলা হয়। তাতেও কিছু হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ভোটের কথাই বলতে হয়। উত্তর প্রদেশেই শুধু নয়, অন্য রাজ্যেও খটিক সমাজের ভোট আছে। মন্দিরের জমি এভাবে দখল নিলে কিন্তু পুরো সমাজ বিজেপি’র বিরুদ্ধে চলে যাবে।’’ এই ওষুধেই কাজ হয়েছে আপাতত। কিন্তু ভোটের পরে কী হবে? দুশ্চিন্তায় খটিকরা।
অযোধ্যায় অজস্র মন্দির ভেঙে ফেলা এবং দখল নেওয়া প্রসঙ্গে সমাজকর্মী অশোক তিওয়ারি বললেন, রামকে বিজেপি ব্যবহার করে। যখন যখন রাজনীতি করার প্রয়োজন হয়, আচারের মতো রোদে দেয় গরম করতে। বিজেপি’র রাজনীতির প্রয়োজনে একটাই রাম আর একটাই মন্দির। বাকি মন্দিরের রামের কোনও গুরুত্ব নেই।
সেই রাজনীতির প্রয়োজনেই অযোধ্যার সড়কে প্রচারে শবরী, আর তাঁর মন্দির দখল ঠেকাতে মরিয়া ‘বংশজ’রা।
Comments :0