বিশ্বজিৎ দাস: গুয়াহাটি
মণিপুরে এখন যা চলছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানাবে। কুকি ও মেইতেই গোষ্ঠীর মধ্যে রীতিমতো খুনের প্রতিযোগিতা চলছে। মঙ্গলবার রাতে কাঙপকপি জেলার খামেনলক এলাকায় দু’পক্ষের গুলির লড়াইয়ে কমপক্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। নিহতদের মধ্যে লাইসরাম নাওথৌবি দেবী নামের বত্রিশ বছরের এক যুবতীও রয়েছেন। এছাড়া ২৫ জনের বেশি জখম হয়েছেন। যেখানে হিংসা হয়েছে, সেই এলাকা কুকি নিবিড় হলেও নিহতরা সকলেই মেইতেই গোষ্ঠীর। মেইতেইদের বিভিন্ন সংগঠন থেকে দাবি করা হচ্ছে, কুকি উগ্রপন্থীদের আক্রমণে তাদের গোষ্ঠীর সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। আবার কুকিদের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে, মেইতেই উগ্রপন্থী সংগঠন আরামবাই টেঙল ও মেইতেই লিপানের সদস্যরা কুকি গ্রামে হামলা চালায়। প্রাণ বাঁচাতে কুকি স্বেচ্ছাসেবকরা পালটা জবাব দেয়। মৃতরা সকলেই মেইতেই উগ্রপন্থী সংগঠন সদস্য।
তবে খামেনলকের পাশের গ্রাম খপিঙবাঙের গ্রাম প্রধান থাঙমিনলাল চাঙলই ও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পূর্ব ইম্ফল ও কাঙপকপি জেলার সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রামে দুই গোষ্ঠীর হামলা পালটা হামলা চলছে। ওইদিন ভোর পাঁচটা কাঙপকপি জেলার সাইকুল বিধানসভা এলাকার খামেমলক, আইজেজাঙ, চুল্লুফাই, খপিবাঙ ইত্যাদি গ্রামে হামলা চালায় আরামবাই টেঙলের শতাধিক সদস্য। প্রায় পঁচিশটি বাড়ি, একটি ক্যাথলিক গির্জা, একটি কমিউনিটি হল ও ইউজেবি নামের মিশনারি পরিচালিত একটি স্কুলে আগুন ধরিয়ে দেয় হামলাকারীরা। তখন কুকি স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিরোধ গড়ে তুললে আরামবাইর সদস্যরা পিছু হটে।
তবে যাওয়ার সময় রাতে ফের হামলা করবে বলে হুমকি দিয়ে যায়। আরামবাইর হুমকিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে কুকি গ্রামে। সন্ধ্যার আগে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। রাত দশটা নাগাদ আরামবাইর নেতৃত্বে প্রায় সহস্রাধিক মেইতেই জনতা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কুকি গ্রাম দখল করার চেষ্টা করে। পাহাড় এবং সমতল দু’দিক থেকে তারা গ্রাম দখল করে ফেলে। এদিকে গ্রাম রক্ষা করতে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল কুকি স্বেচ্ছাসেবকরা। রাত প্রায় একটা পর্যন্ত দু’পক্ষের গুলির লড়াই চলে।
গভীর রাতে ছুটে আসেন গোর্খা রাইফেলসের জওয়ানরা। তখন গুলির লড়াই বন্ধ হলেও ততক্ষণে কয়েকটি লাশ পড়ে যায়। হতাহতদের উদ্ধার করে প্রথমে সাইকুল প্রাথমিক হাসপাতালে ভর্তি করান জওয়ানরা। গুরুতর আহতদের ইম্ফল জেএনআইএমএস হাসপাতাল ও একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জেএনআইএমএস হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ড. প্রবীণ কুমার সিং জানান, তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি দশ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আরও তিনজনের মৃত্যু ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এই ঘটনার পর কাঙপকপি ও পূর্ব ইম্ফল জেলায় কারফিউ শিথিলের সময় চার ঘণ্টা কমানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
গত দেড় মাস ধরে হিংসায় জ্বলছে মণিপুর। সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত ১১৫ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা চারশোর বেশি। গত ২৯ মে ইম্ফলে এসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন পনেরো দিনের মধ্যে রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনবেন তিনি। তাঁর প্রতিশ্রুতির পনেরো দিন কেটে গেলেও শান্তি ফিরে আসার বদলে আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে উত্তর-পূর্বের ছোট্ট রাজ্যটি।
এদিকে, কেন্দ্রের তৈরি শান্তি কমিটি থেকে একের পর এক বিশিষ্টজনেরা পদত্যাগ করছেন। রাজ্যের জনপ্রিয় মণিপুরি অভিনেতা ও পরিচালক মাখনমনি মামসাবা বুধবার শান্তি কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি জানান, তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করে শান্তি কমিটিতে তাঁকে রাখা হয়েছে। তিনি এই কমিটিতে থাকবেন না। রাজ্যের বিশিষ্ট নাট্যকার তথা থিয়েটার অভিনেতা রতন থিয়ামও শান্তি কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে থিয়াম শান্তি কমিটি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, তাঁর ৭৫ বছরের জীবনে এমন নৃশংসতা কোনোদিন দেখেননি। যা এখন তাঁর রাজ্যে ঘটছে।
এরচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এত নৃশংসতা দেখেও এখনও নীরব প্রধানমন্ত্রী মোদী। উল্লেখ্য, এর আগে দুটি কুকি সংগঠন ও একটি মেইতেই সংগঠন শান্তি কমিটি থেকে বেরিয়ে এসেছে।
এদিকে, কুকি উগ্রপন্থীদের সমর্থনে বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতায় আসার খবর প্রকাশ্যে আসার পর দলের শীর্ষ নেতারা মুখ খুলছেন না। বিজেপি-কে ক্ষমতায় আনতে আসামের মুখ্যমন্ত্রী তথা নেডা চেয়ারম্যান হিমন্তবিশ্ব শর্মা ও আরএসএস’র জাতীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য রাম মাধবের সঙ্গে কুকি উগ্রপন্থীদের চুক্তি হয়েছিল বলে অমিত শাহকে পাঠানো এসএস হাওকিপ নামের এক উগ্রপন্থী নেতার চিঠি মঙ্গলবার সামনে এসেছে। উগ্রপন্থীদের সঙ্গে বিজেপি’র গোপন আঁতাতের কারণেই মণিপুরে হিংসা থামছে না বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা।
Comments :0