চলতি বছরের ১৭ মার্চ কলকাতার গার্ডেনরিচের ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে একটি নির্মীয়মান বহুতল ভেঙে পড়ে। সেই ঘটনায় মোট ১৩ জন প্রাণ হারান। শুক্রবার আলিপুর আদালতে সেই ঘটনার চার্জশিট দায়ের করেছে কলকাতা পুলিশ। আদালতে পুলিশ জানিয়েছে, ৮৯ দিন ধরে তদন্ত চালানো হয়েছে। তারপরেই ৭০০ পাতার চার্জশিট পেশ করা হয়েছে নির্মীয়মান বহুতলটির জমির মালিক, প্রোমোটার এবং ঠিকাদার সহ মোট ৬ জনের বিরুদ্ধে। চার্জশিটে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুন, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, ইচ্ছাকৃত ভাবে সরকারি নির্দেশ অমান্য করার মতো ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
এই চার্জশিটকে দেখিয়ে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা ফের শুরু করেছেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। কর্পোরেশনের বিল্ডিং বিভাগ সহ অন্যান্য বিভাগের আধিকারিদের বক্তব্য এমনই।
প্রসঙ্গত, ঘটনার পরেপরেই মেয়র ফিরহাদ হাকিম মিডিয়াকে বলেছিলেন, বেআইনি নির্মাণ সামাজিক ব্যধি। আমি দূর করতে পারছি না।
এই অংশের বক্তব্য, শহর জুড়ে লাগামছাড়া হারে বেড়েছে বেআইনি নির্মাণ। এবং নির্মাণের বাড়বাড়ন্তের পিছনে রয়েছে তৃণমূল কাউন্সিলর, বিধায়ক সহ শাসকদলের গোটা সংগঠন। রেটচার্ট বেধে দিয়ে সমস্ত নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে কাটমানি সংগ্রহ করে তৃণমূল কাউন্সিলররা। সেই টাকার ভাগ যায় স্থানীয় থানায়। থানার মধ্যস্থতায় বিধায়কদের হাত ঘুরে টাকা পৌঁছয় কর্পোরেশনের মূল ভবনেও। তাই গার্ডেনরিচ কান্ড শুধুমাত্র একজন অসাধু ঠিকাদার কিংবা প্রোমোটারের দোষে হয়নি। এর পিছনে তৃণমূলের দূর্নীতিতন্ত্র কাজ করেছে। এখন ঘটনা ধাপাচাপা দিতে প্রমোটার, ঠিকাদার, নির্মাণ শ্রমিক সহ অন্যান্যদের মূল আসামী করা হচ্ছে।
কলকাতা কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারদের অভিযোগ, বরো এবং ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট ও সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে দীর্ঘদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে নিয়োগ হচ্ছে না। তারফলে একজন সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারকে একাধিক ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বেআইনি নির্মাণ রোখার প্রাথমিক দায়িত্ব সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারদের। কলকাতা কর্পোরেশনের ওয়ার্ডগুলির আয়তন, বিশেষ করে সংযুক্ত অঞ্চলের ওয়ার্ডগুলির আয়তন বিশাল। ইচ্ছাকৃত ভাবেই এই পদে লোক নিয়োগ করা হচ্ছে না, যাতে বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকে। একইসঙ্গে বেআইনি নির্মাণ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিলেও তৃণমূল কাউন্সিলরদের চাপ সামলাতে হয় আধিকারিকদের। মেলেনা কোনও স্তরের প্রশাসনিক সাহায্য।
কর্পোরেশনের আধিকারিকদের বক্তব্য, বামফ্রন্টের সময়কালে বেআইনি নির্মাণ রুখতে গার্ড পোস্টিং এবং কর্পোরেশনের নিজস্ব সার্জেন্ট মোতায়েন করা হত। বর্তমানে বেআইনি নির্মাণ রোখার মূল দায়িত্ব থানার। তৃণমূল আমলে শহরের থানাগুলি কিভাবে পরিচালিত হয় তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে ২০২১ সালের কর্পোরেশন নির্বাচনে। সেই ভোটে তৃণমূল ৭২ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল, যা পঞ্চায়েতের ভোট লুটকেও ছাপিয়ে যায়।
আধিকারিকদের ক্ষোভ, স্কোয়ারফিট মেপে বেআইনি নির্মাণের থেকে টাকা নেওয়ার জন্য একাধিক তৃণমূল কাউন্সিলর ও বিধায়কের নামের আগে পরে স্কোয়ারফিট উপাধি যোগ হয়েছে। কর্পোরেশনের ২ এবং ৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলর, ও পরবর্তীকালে রাজ্য সভার প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেন এই বিষয়ে পথিকৃত। তারপরেও বেআইনি নির্মাণের ফলে ১৩ জন মানুষের মৃত্যু হলেও কোনও তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস দেখাতে পারল না কলকাতা পুলিশ।
Comments :0