আমেরিকার বিপরীতে বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি অনেক বছর ধরেই সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার মাথা ব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ। এই অবস্থায় যেভাবেই হোক চীনকে ঠেকানোই আমেরিকার লক্ষ্য। কিন্তু চলতি শতাব্দীর গোড়া থেকে মার্কিন অর্থনীতির আধিপত্য এবং সামরিক দাপট ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকায় এককভাবে চীনকে সামাল দেওয়া আমেরিকার পক্ষে অসম্ভব ও ঝুঁকিবহুল হয়ে দাঁড়ায়। তাদের পশ্চিমী অর্থনৈতিক জোটসঙ্গী ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং সামরিক জোট সঙ্গী ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির অর্থনীতিও হাজারো সঙ্কটে জর্জরিত।
এই অবস্থায় আগের মতো শক্তি ও ভরসা নিয়ে আমেরিকার পাশে দাঁড়ানোও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে রুশ জুজুর আতঙ্ক বাড়ছে গোটা ইউরোপ জুড়ে। তাই ইউরোপের যত বেশি সংখ্যক দেশকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সদস্য করে সবদিক থেকে ঘিরে ফেলে রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে তারা মরিয়া। পশ্চিম ইউরোপের চাপে আমেরিকাকে বাধ্য হতে হয় বিপুল ঝুঁকি নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সার্বিক সংঘাতে নামতে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের আসল রহস্য লুকিয়ে আছে এই জায়গাতেই।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ যে আসলে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমী দুনিয়ার আধিপত্য রক্ষার লড়াই তা ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অর্থ, অস্ত্র সহ সমস্ত রকমের সাহায্য আসছে আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে। ইউক্রেন কার্যত মার্কিন ও ইউরোপিয়ান জোটের হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভাড়া খাটছে।
আমেরিকা ভেবেছিল সার্বিক অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টি করে রাশিয়ার অর্থনীতি বিপর্যস্ত করে যুদ্ধে পরাস্ত করতে। এটাও ভেবেছিল আর্থিক সঙ্কটে বিপর্যস্ত হয়ে রাশিয়া আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। চীন, গণতান্ত্রিক কোরিয়া, ইরান সহ বেশ কিছু দেশ রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
অন্যদিকে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি করে চীনের বিরুদ্ধে এশিয়ায় ন্যাটো-ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের মতো নতুন অর্থনৈতিক ও সামরিক জোট গড়ে তুলতে অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যে ভারত রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন চাপ সত্ত্বেও ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থা নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে পুরানো সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করছে সেই ভারতই আবার চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই লক্ষ্যে চার দেশের জোট কোয়াডকে অর্থনৈতিক জোট থেকে সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক জোটে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চলছে।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ যত প্রলম্বিত হচ্ছে ততই আমেরিকার চীনাতঙ্ক বাড়ছে। মার্কিন উদ্বেগ আরও বেড়েছে গণতান্ত্রিক কোরিয়ার রাষ্ট্রপতির সম্প্রতি রুশ সফরের ফলে। তিন পরমাণু শক্তিধর দেশ চীন, রাশিয়া, গণতান্ত্রিক কোরিয়া একদিকে। ভারতের সঙ্গে শত্রুতা এবং চীনের সঙ্গে মিত্রতার সুবাধে আর এক পরমাণু শক্তিধর দেশ নিঃসন্দেহে চীন-রাশিয়ার সঙ্গেই থাকবে। এই অবস্থায় এক চীন নীতি অনুযায়ী তাইওয়ানকে চীনের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে আমেরিকা যদি তাইওয়ানের হয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে তাহলে আমেরিকার পাশে কারা থাকবে সেটা নিয়ে আমেরিকা রীতিমতো দুঃশ্চিন্তায়। বিশেষ করে এক্ষেত্রে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শক্তি ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হওয়া জরুরি।
বস্তুত ভারত যদি সক্রিয়ভাবে চীনের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে আমেরিকার সঙ্গী না হয়ে যদি রাশিয়া-ইউক্রেনের মতো ধরি মাছ না ছুঁই পানির অবস্থান নেয় তাহলে চীনের সঙ্গে লড়াই আমেরিকার পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। ইউক্রেন প্রশ্নে ইউরোপ যতটা সক্রিয় চীন-তাইওয়ান প্রশ্নে ততটা সক্রিয় নাও হতে পারে। তাছাড়া এক সঙ্গে দু’টো ফ্রন্টে সামরিক সংঘাত চালানোর সামর্থ্য ইউরোপ-আমেরিকার আছে কিনা সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। এই অবস্থায় তাইওয়ান প্রশ্নে আমেরিকা ভারতের স্পষ্ট অবস্থান জানতে চায়। সেটা জেনে চীনের বিরুদ্ধে, কতদূর পর্যন্ত যাবে সেটা আমেরিকা ঠিক করবে। এখন দেখা যাক ‘বিশ্বগুরু’ আমেরিকা কী বার্তা দেন।
Comments :0