মধুসূদন চ্যাটার্জি- বাঁকুড়া
কাজ চাই। লুটেরাদের দিন শেষ, এখন থেকে শুরু হচ্ছে গরীব খেটে খাওয়াদের দিন। লড়ায়ের দিন, এ লড়াই চলবে। শনিবার বাঁকুড়া জেলার পশ্চিম থেকে উত্তর হয়ে পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত এই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল। এ হল যৌবনের আওয়াজ। কোথাও কথার ফুলঝুরি নেই। ইনসাফ যাত্রার সোজাসাপটা আওয়াজ, ধুঁকছে গ্রাম শহরের যুবক, যুবতিরা। খেলা, মেলা সহ যাবতীয় সরকারি রসিকতা আর সহ্য হচ্ছেনা। বাড়ির বাবা, মা সহ বাকিরা তাকিয়ে আছে লেখাপড়া শেখা যুবক, যুবতিদের মুখের দিকে। কবে মিলবে একটা কাজ। সংসার গুলো তো একে একে তলিয়ে যাচ্ছে কে খবর রাখে তার। এই নিদারুন যন্ত্রণায় যাঁরা একদিন- প্রতিদিন আরও ক্ষয়ে যাচ্ছে। দেওয়ালে আক্ষরিক অর্থেই পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষগুলোর কাছে এই ইনসাফ যাত্রা একটা সঞ্জীবনী। আমরা বুঝতে পারছি, কি করতে হবে। সেই বার্তাই শীতের সকালে দিল ইনসাফ যাত্রা। শনিবার সকালে শালতোড়ার লেদমোড়ে স্পষ্ট একথা শোনালেন কমল মন্ডল। তাঁর বক্তব্য ছেলে লেখাপড়া শিখে বসে আছে। কখন ঘর থেকে বের হয় কখন আসে জানিনা, কারণ বেকারত্বের আত্মজ্বালা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। উদাস হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেরায়। তাঁর আশঙ্কা আমি কি ছেলেটা হারিয়ে ফেলব? কাজ করে বাবার হাতে পয়সা তুলে দিতে চায়, কিন্ত এমনই সরকার রয়েছে আমাদের দেশে রাজ্যে যে এই যুবক, যুবতিগুলোর দিকে একবারের জন্যও ভাবছেনা। একটা প্রজন্ম শেষ হয়ে যাবে? কমল মন্ডলের ছেলে কোনটি দেখা হলনা। কিন্তু শালতোড়ার ইসসাফ যাত্রার মিছিলে সেও ডিওয়াইএফআই’র পতাকা হাতে নিয়ে পদযাত্রায় সামিল হয়েছে।
কমল মন্ডল, ফনিভূষণ মন্ডল, জয়ন্ত হালদাররা জানান, তাঁদের ছেলেরা জানিয়েছে ঘরে বসে থেকে কি করব? রাস্তায় নামতে হবে। কাজ চাইতে হবে। যতদিন না কাজ দিচ্ছে ততদিন গলার শির বের করে চিৎকার করে বলতেই হবে আমাদের কাজ দাও। বাংলার অন্যতম পাথর ক্র্যাসার, খাদানের জায়গা এই শালতোড়া। ২০২১ সাল থেকে খাদান, ক্র্যাসার বন্ধ হয়ে আছে। কেন সরকার বন্ধ করল তার কোন ব্যাখ্যা নেই। মুখ্যমন্ত্রী তিনবার বাঁকুড়ায় প্রশাসনিক সভা করতে এসে জেলা থেকে রাজ্য স্তরের সচিবদের জানিয়েছিলেন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য। আজ পর্যন্ত কি আলোচনা শেষ হলনা? এই কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধীক্ষনে দাঁড়িয়ে আছেন। সব রসদ তাঁদের শেষ। পালিয়ে বেরাতে হচ্ছে বহু শিক্ষিত যুবককে। যাঁরা এই ক্র্যাসার, খাদান করেছিলেন। শ্রমিক পল্লীগুলিতে অন্ধকার নেমে এসেছে। গ্রামের পর গ্রামের যুবকরা বাইরে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে চলে গেছেন। সেখানে নামমাত্র মজুরীতে কাজ করে শারিরীক অসুস্থতা নিয়ে ঘরে ফিরছেন শ্রমিক। এখানে এসে দেখছেন কোন কাজ নেই। সেই মানুষগুলোও এদিন শীতের সকালে শালতোড়ায় ইনসাফ যাত্রার মিছিলে এসেছিলেন।
পদযাত্রা এর পর গঙ্গাজলঘাটিতে যায়। সেখানেও বহু মানুষ অপেক্ষা করছিলেন পদযাত্রীদের জন্য। সঙ্কট এখানেও একই রকম। গরীবের ঘরে কাজ নেই। রেগার কাজ করা খেতমজুর মজুরী পাননি। ধান যেটুকু হয়েছে তা কাটার পর খেতমজুর কি করবেন? নিরব পঞ্চায়েত। মানুষ লড়তে চাইছেন। ধারাবাহিক লড়াই।
এদিন গঙ্গাজলঘাটির মানুষ পদযাত্রীদের দুপুরে খাওয়ান। একে একে ভরসার হাতগুলো পদযাত্রীদের সঙ্গে হাত মেলায়। অঙ্গীকার নিয়ে জানান, আমরা আছি। দুপুরে বাঁকুড়া শহরে ঢোকে পদযাত্রা। পাঁচবাঘা মোড় থেকে শুরু হয় এই পদযাত্রা। লালবাজার পর্যন্ত যায়। বাঁকুড়া শহরের প্রতিটি মোড়ে অসংখ্য মানুষ পদযাত্রীদের দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন বেলা বারটা থেকেই। সারা রাস্তাজুড়ে মানুষ উপস্থিত থেকে এই ইনসাফ যাত্রাকে স্বাগত জানান। বিকালে ইসসাফ যাত্রা বেলিয়াতোড়ে প্রবেশ করে। বেলিয়াতোড় থেকে ডাকবাংলে পর্যন্ত মিছিল হয়। অসংখ্য মানুষ এদিন বেলিয়াতোড়েও হাজির হয়েছিলেন। সন্ধ্যায় ইনসাফ যাত্রা ঢোকে সোনামুখী শহরে। মানুষের ঢল নামে সোনামুখীতে। হাজার হাজার মানুষ শুনতে চায় পদযাত্রীদের কথা। সোনামুখী শহরে খালি কালো মাথা। কৃষিতে উন্নত সোনামুখী ব্লকের খেতমজুরদের কাজ নেই। যন্ত্রে ধান কাটা হচ্ছে, লাগানো হবে আলুও। কি করব আমরা? এই উৎকন্ঠা নিয়েই ইনসাফ যাত্রায় এসেছিলেন সোনামুখীর কামারগোড়ের বাদল দাস, নৈমুদ্দিন শেখেরা। শীতের রাত পর্যন্ত মানুষ বসেছিলেন। একাধিক মানুষ জানান, এরকম একটা ধারাবাহিক লড়ায়ের বার্তা প্রয়োজন ছিল। রাতে এই পদযাত্রা ঢোকে মল্লভূমের রাজধানী ঐতিহাসিক শহর বিষ্ণুপুরে। বিকাল থেকেই বিষ্ণুপুরের মানুষ অপেক্ষা করতে থাকেন। এদিন পদযাত্রার বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য রাখেন ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্পাদিকা মিনাক্ষী মুখার্জি, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিমগ্নরাজ ভট্টাচার্য্য, ধ্রুবজ্যোতি সাহা, ছাত্র নেতা প্রতিকুর রহমান, প্রাক্তন যুব নেতা অমিয় পাত্র, জামির মোল্লা সহ নেতৃবৃন্দ।
Comments :0