রামানন্দ মৌর্য
স্কুল শিক্ষক
স্কুলে পড়ার সময় থেকে যুক্ত ছিলাম আরএসএস-র সঙ্গে। সঙ্ঘ শিক্ষাবর্গে গিয়েছি। সেই সব ক্লাসে বোঝানো হতো ‘মুসলিমরা আক্রমণকারী’, ‘দেশভাগ হয়েছে ওদের পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত’। শিবাজী, মহারানা প্রতাপ এদের সম্পর্কেই জানানো হতো। তখন ওদের সব কথা বিশ্বাস হতো। ওটাকেই দুনিয়া মনে হতো। পড়াশোনা ছেড়ে নাগপুরে ট্রেনিং নিতে যেতে দেয়নি বাড়ির লোকজন। তাই কোনও বড় পদাধিকারী হতে পারিনি। তবে অযোধ্যায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর পরে বজরঙ দল তৈরি হলে স্থানীয় স্তরের নেতা বানানো হয়েছিল আমাকে। সেই সময়ে আমি ছিলাম একটা কট্টর হিন্দুত্ববাদী।
ভিপি সিং মণ্ডল কমিশনের ঘোষণা করার পরে আরএসএস তার তীব্র বিরোধিতা শুরু করে। আমি পিছড়ে জাতির লোক। তখন বুঝতে পারি, আরএসএস আসলে বর্ণহিন্দুদের স্বার্থ রক্ষাই চায়। সংগঠনের ভেতরে নেতাদের সঙ্গে সঙ্ঘাত বেধে গিয়েছিল আমার। আরএসএস-ভিএইচপি-বিজেপি’র প্রতি মোহ কেটে গেলেও হিন্দুত্বের প্রতি আস্থা ছিল। তাই ১৯৯০ সালের করসেবায় গিয়েছিলাম। ’৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙতেও গিয়েছিলাম। ঘটনার দিন বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে যেতে এক ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। সব ভাঙচুর চলছিল। আমিও দশ-বিশ ইট তুলে ফেলেছিলাম। মই বেয়েই গম্বুজের উপরে চড়েছিলাম। বাবা এসে গিয়েছিল, লাঠি নিয়ে আমাকে তাড়া করে সরায়। পাঁচটার মধ্যে সব ভেঙে পড়ে। কারফিউ লাগিয়ে দেওয়া হয়। ১৫দিন কারফিউ ছিল। কিন্তু আমি ৭ ডিসেম্বরও গিয়েছিলাম ওখানে। ১১-১২টা নাগাদ। দেখলাম মন্দির বানানো হচ্ছে। বাহিনী পুরো ঘিরে রেখেছিল, তার মধ্যেই কাজ চলছিল মন্দিরের।
আসলে শাহ বানু মামলার রায় বদলে হিন্দুত্ববাদীদের হাতিয়ার তুলে দিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। শাহ বানু মামলার পরে আমরা প্রথম ‘তুষ্টিকরণ’ শব্দটা শুনেছিলাম। যা এখন সবসময় বলে বিজেপি। আমাদের কাছে তখন মনে হয়েছিল, মুসলমানদের জন্য কংগ্রেস আইন বদলে দিল! আরএসএস-র বিচারধারার লোক কংগ্রেসের মধ্যে ভর্তি ছিল। বিধায়ক বীর বাহাদুর সিংকে ৯০ সালে আবার প্রার্থী করা হলে তিনি প্রচারে গিয়ে বলেন, ‘হামকো ভোট না দিও, রামজীকে বিরোধ হো যায়েগা!’ মুলায়াম সিং তখন কমজোর নেতা ছিলেন। কিন্তু একদিকে মণ্ডল কমিশন, অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনায় সরাসরি মুসলিমদের পক্ষ নেওয়ায় মুসলিমদের সমর্থনও পেয়ে গিয়েছিলেন। সেই প্রথম কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিমরা মুলায়ামকে ভোট দিয়েছিল। কংগ্রেস না রামের থাকল, না রহিমের। ইন্দিরা গান্ধী-রাজীব গান্ধী আসলে হিন্দু কার্ড খেলতে গিয়েছিলেন।
মণ্ডল কমিশনের পরে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পুরো বিচ্ছিন্নতাও ছিল না। রামমন্দির আন্দোলনে সমর্থন ছিল। ১৯৯৩ সালে আমি এমএ করতে লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। ইতিহাসে এমএ-তে ভর্তি হই। আধুনিক ইতিহাসের চারটি বিপ্লব পড়ানো হতো। আমেরিকার বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব আর চীনের বিপ্লব। রেনেসাঁয় পড়লাম পুরানো যে সামন্তবাদী মানসিকতা ছিল সব নষ্ট হয়ে যায়, এক নতুন বিচারধারার জন্ম হয়। ক্রুসেড পড়লাম। ইউরোপে ধর্ম রাজনীতি পৃথক হয়ে যাওয়া, পোপের ক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে পড়লাম। ইংল্যান্ডের রক্তহীন বিপ্লবের কথা পড়লাম। তখন ভাবলাম, আরে! ইউরোপ তো আমাদের থেকে চার-পাঁচশো বছর আগে থেকেই রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা করে ফেলেছে। ওরা ক্রুশেডের বিরোধিতা করছে। আমরা এখানে এখন ক্রুসেড করছি। আমরা তো মহামূর্খ! ওখানে কবেই রেনেসাঁ হয়ে গেছে আর আমরা এখানে রামজনমভূম আন্দোলন করছি! আমরা তো হাজার বছর পিছনে চলে গেলাম। তখনই পুরোপুরি আত্মোপলব্ধি হলো, সঙ্ঘ বাহিনী আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্ণৌয়ে বামপন্থীদের জনচেতনা গোষ্ঠী ছিল, তাদের সঙ্গে জুড়ে গেলাম। আরএসএস-বিজেপি-ভিএইচপি সব ছেড়ে দিলাম।
এক সময়ে আরএসএস-র কর্মী ছিলাম বলেই আমি বুঝতে পারি এরা ধর্মের নামে কীভাবে, কেন উন্মাদনা তৈরি করছে। সঙ্ঘের স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়- আমার জীবন বদলে দিয়েছে শিক্ষা। কেন্দ্রে মোদীর সরকার আর রাজ্যে যোগীর সরকারের আমলে তাই শিক্ষাই সবথেকে বেশি আক্রান্ত। নানা ভাবে শিক্ষার উপরে আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। ওদের তৈরি ইতিহাস, ওদের তৈরি বিজ্ঞান শেখানো হচ্ছে। মানুষকে মুর্খ বানিয়ে রাখার একটা বিরাট যন্ত্র এরা বানিয়ে ফেলতে চাইছে। যাতে মগজটাই নষ্ট হয়ে যায়। রামমন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে সেই কাজটাই চলছে। অযোধ্যার রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিসর এখন পুরোপুরি এদের নিয়ন্ত্রণে। বিরোধীদের কোনও অস্তিত্বই নেই। অথচ ভেতরে ভেতরে সেই মণ্ডলের মতো পরিস্থিতি আছে। বিহারে জাতভিত্তিক গণনার রেশ এখানেও আছে। কিন্তু কোনও আলোচনা নেই। উত্তর প্রদেশের বিরোধী দলগুলি সেই কথা বলছে না। বিহারে যেভাবে নীতীশ কুমার, তেজস্বীরা বলছেন। কিন্তু আরএসএস-বিজেপি সতর্ক হয়ে গেছে। নতুন করে যেন আর মণ্ডলের মতো পরিস্থিতি তৈরি না হয়। তারা এই মন্দিরকে ব্যবহার করে ‘সবাই হিন্দু’ পরিচয়ে সবটা ভাসিয়ে নিতে চাইছে। সামাজিক শোষণ, নিপীড়ন শুধু নয়, তারা গরিবও। সবাইকে বলছে তুমি আগে হিন্দু, সেটা নিয়েই গর্ব করো। রামমন্দির নিয়ে গর্ব করো। বাকি সব ভুলে যাও।
Comments :0