School

শাসকের ভোট সন্ত্রাসের সাক্ষী রাজ্যের ২০০ বিধ্বস্ত বিদ্যালয়

রাজ্য

অক্ষত নেই স্কুলবাড়ির ১৮টি দরজা। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ৪৪টি কাচ আর কাঠের জানালা। ৮৮টি বেঞ্চ থেকে বাথরুমের ৮টি দরজার আর কোনও অস্তিত্ব নেই। সীমানা পাঁচিল থেকে ক্লাসরুমের দেওয়ালের ক্ষতি হয়েছে মারাত্মক।
কোনও যুদ্ধবিধস্ত এলাকায় বোমারু বিমান থেকে এই হামলা হয়নি। সামরিক ট্যাঙ্ক এসেও গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়নি আস্ত এক স্কুলবাড়িকে। এই ঘটনার সাক্ষী এই রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন। যে স্কুলবাড়ির উপর এই হামলা হয়েছে, সেখানে ছিল রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশিক্ষিত বাহিনী দিয়ে ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা বলয়। তার মধ্যেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করে স্কুল শিক্ষা দপ্তরের প্রাথমিক ধারণা, প্রায় ১ লক্ষ ৬৩ হাজার টাকা ব্যয় হবে এই স্কুলবাড়ির পুনর্নির্মাণে। 


ভোট গণনার সঙ্গে রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ডিসিআরসি (ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার কাম রিসিভিং সেন্টার বা ভোটসামগ্রীর বিতরণ কেন্দ্র ও তা জমা নেওয়ার কেন্দ্র) হয়েছিল ভাঙড় ২ নম্বর ব্লকের কাঁঠালিয়া হাই স্কুলে। ভোট গণনার পর গোটা স্কুলবাড়ি এখন এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। শাসকের ভোট সন্ত্রাসের নগ্ন ছবি স্কুল শিক্ষা দপ্তর হয়ে জমা পড়েছে নবান্নে স্বরাষ্ট্র দপ্তরে। ওই দপ্তরের এক আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘এই রিপোর্ট আদালতে জমা পড়লে ফের সরকারকে কঠিন বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হতে পারে।’’


শুধু ভাঙড় নয়, গোটা রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই ভোট গ্রহণ কেন্দ্র কীভাবে শাসক দলের লুটের কেন্দ্র হয়েছিল, তার জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে আছে সরকার পরিচালিত বিভিন্ন স্কুল। সাধারণভাবে পঞ্চায়েত ভোটে গ্রামের ভিতরে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিকেই ভোটকেন্দ্র হিসাবে বেছে নেয় রাজ্য নির্বাচন কমিশন। ভোটের পর সেই স্কুলবাড়ির বিধ্বস্ত চেহারা দেখে শিউরে ওঠার মতো অবস্থা। নিরাপত্তাকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রগুলিকে শাসক দল যে অবাধ লুটের ক্ষেত্র বানিয়েছিল, তার নমুনা হয়ে আছে এই স্কুলগুলির বেশ কিছু। দক্ষিণ ২৪ পরগনারই জয়নগর ২ নম্বর ব্লকের বড়তলা এফপি স্কুলে তিনটি বুথ হয়েছিল। শাসকের লুটের পর ওই স্কুলে ছেলেমেয়েদের কোথায় পড়ানো হবে, সেটাই এখন চিন্তা শিক্ষকদের। ক্ষয়ক্ষতির অঙ্ক পৌঁছেছে ৭৫ হাজার টাকায়। 


স্কুলবাড়িতে তাণ্ডবের কথা শুনে শিউরে উঠেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘এমনিতেই প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাকে ডকে তুলে দেওয়া হয়েছে। পড়াশোনা বন্ধ করে ছুটিতে, ছুটিতে ছয়লাপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তারপরে ভোটের তাণ্ডবে যদি এই হাল হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, তাহলে স্কুলবাড়িতে ভোটকেন্দ্র না করার আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।’’ 
গোটা রাজ্যে প্রায় ২০০-র বেশি স্কুলবাড়ি এখন আর আগের অবস্থায় নেই। চেয়ার, টেবিল, ছাত্র-ছাত্রীদের বসার বেঞ্চ, মাথার উপর সিলিং ফ্যান, বাথরুমের দরজা, জানালা, ওয়াশ বেসিন পর্যন্ত লুট করে নিয়ে গেছে দুষ্কৃতীরা। প্রাথমিক হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৬ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকা ছাপিয়ে গিয়েছে। রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দপ্তরের এক আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘অনেক জেলা থেকে স্কুলবাড়ির ক্ষতির তালিকা চেপে দেওয়া হয়েছে। জেলাস্তরে ক্ষয়ক্ষতি ম্যানেজ করে নেবে বলে জানানো হয়নি। ফলে জেলা থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলবাড়ির সংখ্যা আরও বাড়বে।’’ 


শুধু মুর্শিদাবাদ জেলা থেকেই প্রায় ১৩৫টির বেশি স্কুলবাড়ির ক্ষতির হিসাব নবান্নে এসেছে। ক্ষতির তালিকায় আছে বোমায় বিধ্বস্ত হয়েছে প্রাথমিক স্কুল। মুর্শিদাবাদের নওদা ব্লকের আমতলা হাই স্কুলে বুথ হয়েছিল। স্কুলের ফার্নিচার ও বিদ্যুৎ সরঞ্জাম লুট হওয়ার পর প্রাথমিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। ব্লকের শিবনগর মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রে ভোটের দিন বুথ দখলের তাণ্ডবে ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার টাকা ছাপিয়ে গিয়েছে। শুধু নওদা ব্লকেই ৩০টি শিক্ষাকেন্দ্র ভোট লুটেরাদের তাণ্ডবের শিকার হয়েছে। লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, এমএসকে (মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র) থেকে হাই স্কুলে ক্ষতির পরিমাণ। কোচবিহারের দিনহাটার দু’টি ব্লকের বুথে বুথেও কীভাবে সন্ত্রাস হয়েছে, তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে বিদ্যালয়ে।
বাদ যায়নি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। হাওড়ার সাঁকরাইল ব্লকের গণনা কেন্দ্র হয়েছিল ধূলাগোড়ের এক বেসরকারি ইঞ্জনিয়ারিং কলেজে। এই গণনা কেন্দ্রে সিপিআই(এম)’র প্রার্থীদের গণনায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য লুট করা হয়েছিল ব্যালট। পরিস্থিতি এতটাই হাতের বাইরে চলে যায় যে, রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে ওই গণনা কেন্দ্রে ১৫টি বুথে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া বাতিল করে রাখতে হয়েছে। গণনা কেন্দ্রে ভোট গণনায় যুক্ত সরকারি কর্মচারীরা পর্যন্ত তৃণমূলের তাণ্ডবে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিলেন। এলাকার তৃণমূল বিধায়ক প্রিয়া পালের নেতৃত্বে সেদিন গণনা কেন্দ্রে সিপিআই(এম)’র নিশ্চিত জয় আটকাতে তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। এই অভিযোগের সত্যতা উঠে এসেছে সরকারি তথ্যেই। সাঁকরাইল ব্লকের এই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পঠনপাঠন সামগ্রীর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬০ হাজার টাকা। 


দু’দিন আগে রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দপ্তরের কমিশনার জেলাশাসকদের কাছে একটি চিঠি পাঠান। তার আগে দপ্তর থেকে জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক (শিক্ষা) ও জেলা স্কুল পরিদর্শক (ডিআই)-দের নিয়ে একটি ভিডিও কনফারেন্স করে পঞ্চায়েত ভোট পর্বে স্কুল বাড়িতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার বিস্তারিত তালিকা চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। তার ভিত্তিতে গত শুক্রবার রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরে ভোটকেন্দ্র হিসাবে যেসব স্কুলবাড়ি ক্ষতি হয়েছে, তার তালিকা এসে পৌঁছেছে। এখন সরকার ঠিক করেছে, সরকারি তহবিলের টাকা থেকে শাসক দলের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলবাড়িগুলি মেরামতি করে পঠনযোগ্য করে তোলা হবে।

 

 

Comments :0

Login to leave a comment