দীপশুভ্র সান্যাল: জলপাইগুড়ি
ডুয়ার্সের লাটাগুড়ি–গরুমারা অরণ্যের কোলে অবস্থিত জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র মূর্তি। বাম আমলে রাজ্যের পর্যটন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে মূর্তি এক নতুন পিকনিক ও ভ্রমণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। গরুমারা অরণ্যের মাঝে, নদী , পাখিদের কলতান আর নিস্তব্ধ সবুজে ঘেরা এই অঞ্চলে বহু পুরনো বাংলা ছবির শুটিংও হয়েছে। তপন সিংহের ‘অরণ্যের গল্প’, ‘জঙ্গলমহল’র মতো চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন আজও মূর্তিকে বিশেষ স্মৃতিমণ্ডিত করে রেখেছে। নৈঃশব্দ্য, অরণ্যের ঘনতা, নদীর স্বচ্ছতা এই প্রাকৃতিক মাধুর্যেই প্রতিবছর শীত নামলেই ছুটে আসেন হাজারো পর্যটক।
কিন্তু এ বছর ছবিটা একেবারেই অন্য। বড়দিনের ছুটি ঘনিয়ে এলেও মূর্তি প্রায় পর্যটকশূন্য। স্থানীয় ব্যবসায়ী মহলের কপালে চিন্তার ভাঁজ। কেন এমন পর্যটন শূন্য তা স্পষ্ট করে বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁরা। পর্যটকেরা এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে যে বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে, তাতে কয়েকটি কারণ সামনে এসেছে। উত্তরবঙ্গ জুড়ে কিছুদিন আগে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেই বন্যায় নদীর চর, বনভূমির কিছু অংশ এবং আশপাশের অবকাঠামোর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া পর্যটকদের মনে সংশয় তৈরি করেছে। অনেকে ভাবছেন, আগের মতো বন, নদীর সৌন্দর্য কি ফেরত এসেছে? এই মানসিক অনিশ্চয়তাই হয়তো অনেক পর্যটক ডুয়ার্সমুখী হতে ভয় পাচ্ছেন।
পাশাপাশি, চলতি সময়ে এসআইআর বা রাস্তা–সেতু সংস্কারের কাজও পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে বলে মত স্থানীয়দের। কলকাতা থেকে আগত পর্যটক তপতী দত্ত জানান, মূর্তির নৈসর্গিক সৌন্দর্য তাঁকে অভিভূত করলেও বর্তমানে চলতে থাকা কাজ অনেকের কাছে অসুবিধার কারণ বলে ধরা পড়ছে। স্থানীয় দোকানি সুজিতা রায় জানান, “এখনও লোক নেই। স্কুলের পরীক্ষা শেষ হলে হয়তো কিছুটা ভিড় বাড়বে।” পর্যটন শূন্যের ফলে অর্থনীতি ও স্থানীয় ব্যবসার ওপর একটি সরাসরি প্রভাব পড়ছে।
মূর্তি এলাকার সৌন্দর্যের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ হল এখানকার সরকারি ও বেসরকারি রিসর্টগুলি। গরুমারা ইকো ভিলেজ, কালিপুর ইকো ভিলেজের মতো বনদপ্তর পরিচালিত আবাসন ছাড়াও রিভারউড ফরেস্ট রিট্রিট, বনানি রিসর্ট, অরণ্য ইকো রিসর্ট, ত্রিমূর্তি রিসর্টসহ অসংখ্য বেসরকারি কটেজ ও রিসর্ট প্রতি বছর পর্যটকদের টানে। নদীর ধারে কাঠের কটেজে রাত কাটানো অথবা জঙ্গলের গভীর নৈঃশব্দ্য উপভোগ করা মূর্তি এদিক থেকেও ডুয়ার্সে বিশেষ স্থান দখল করে। তবু এ বছর অধিকাংশ রিসর্টেই বুকিং কম, যা ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ আরও বাড়াচ্ছে।
এত সব প্রতিকূলতার মাঝেও হতাশ নন স্থানীয়রা। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস, বড়দিন ও নববর্ষের ছুটিতে ফের ভিড় বাড়বে, প্রাণ ফিরে পাবে মূর্তি। অরণ্যের সিনেমার স্মৃতি, নদীর মন্থর স্রোত আর প্রকৃতির নিসর্গ মিলিয়ে মূর্তি আবারও পর্যটকদের প্রিয় ঠিকানা হয়ে উঠুক এটাই তাঁদের প্রত্যাশা।
Comments :0