কেবল তাই নয়, ওষুধের দাম গত দশ বছরে লাগামছাড়া হারে বেড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের দাম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ঠুঁটো হয়েছে। সিপিআই(এম) বলেছে, নির্বাচনী বন্ডে যে টাকা দেওবা হয়েছে বিভিন্ন সংস্থা তা উসুল করেছে জনতার ঘাড় ভেঙে। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম মনে করিয়েছেন যে গোয়েঙ্কা গোষ্ঠী বিপুল টাকার বন্ড কিনেছে। আর তাদের নিয়ন্ত্রণে কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকার বিদ্যুৎ পরিবহণ ব্যবস্থা। দেশের মধ্যে অন্যতম চড়া এখানে বিদ্যুতের মাসুল।
তথ্য অনুযায়ী, এই ৩৫টি সংস্থা হয় ইন্ডিয়ান ড্রাগ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন(আইডিএমএ), অথবা ইন্ডিয়ান ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যালায়েন্স(আইপিএ)’র মত বাণিজ্যিক মঞ্চের সদস্য। আইডিএমএ এবং আইপিএ আবার কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন নীতিকে প্রভাবিত করে থাকে।
এই প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘অন্যায়ের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে বন্ডকে ব্যবহার করে। নিম্নমানের ওষুধ তৈরির অভিযোগ উঠেছিল যে কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে, তারাই কোটি কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়নি। নকল ওষুধ তৈরির অভিযোগ রয়েছে, এমন সংস্থাও বন্ড কিনেছে। তদন্ত হয়নি। এটা দেশের জন্য গভীর বিপদের।’’
অর্থাৎ, ওষুধ সংস্থাগুলি রাজনৈতিক মঞ্চে টাকা ঢালে, এবং তার বদলে বিভিন্ন সরকারি নীতি তাঁদের অনুকূলে যায়।
নির্বাচনী বন্ড কেনা ৫টি সর্ববৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা হয় আইডিএমএ কিংবা আইপিএ অথবা উভয় সংগঠনের সদস্য। তালিকার শীর্ষে রয়েছে ডক্টর রেড্ডি’জ ল্যাবরেটরি। তারা কিনেছে ৮০ কোটি টাকার বন্ড। ন্যাটকো ফার্মা কিনেছে ৬৯.২৫ কোটি টাকার বন্ড। এই দুই সংস্থাই আইডিএমএ এবং আইপিএ’র সদস্য।
এছাড়াও টরেন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস কিনেছে ৭৭.৫ কোটি টাকার বন্ড। হেটেরো গ্রুপ কিনেছে ৬০ কোটি টাকার বন্ড। এই ৩টি সংস্থা কেবলমাত্র আইডিএমএ’র সদস্য।
৩৫টি সংস্থার মিলিত বন্ড ক্রয়ের পরিমাণ ৭৯৯.৬৬ কোটি, যা ২০২৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ওষুধ শিল্পের বিকাশের জন্য যে টাকা বরাদ্দ করেছিল, তার অর্ধেকেরও বেশি।
২০২৪ সালের ১২ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলে, ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর দাম ঢেলে সাজানোর জন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে। সেই কমিটি ২০১৩ সালে লাগু হওয়া ওষুধের দাম নির্ধারক নির্দেশিকা বা ড্রাগ প্রাইসিং কন্ট্রোল অর্ডার বা ডিপিসিও’র পূনর্মূল্যায়ন করবে বলা হয়। ২০১৩ সালের নির্দেশিকা ৩০০টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম বেধে দেয়। এখন কেন্দ্রের মনে হয়েছে, সেই নির্দেশিকা এবং ওষুধের তালিকার নতুন মূল্যায়ন প্রয়োজন।
মূল্যায়নের জন্য গঠিত কমিটিতে ৩জন সরকারি আধিকারিকের পাশাপাশি বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে থাকবেন আইডিএমএ এবং আইপিএ’র ২জন প্রতিনিধি।
ওষুধের দামবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের সংগঠক ও অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক(এআইডিএএন)’র সহ আহ্বায়ক মালিনী আইসোলা বলছেন, ‘‘স্বাধীন দেশের ইতিহাসে কখনও এই ধরণের ঘটনা ঘটেনি। এতদিন সুলভে ওষুধ পাওয়ার দাবিতে আন্দোলন করা নাগরিক আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে একাসনে রাখা হত ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার প্রতিনিধিদের। সরকার সবার কথা শুনত। এখন সরকার আমাদের কথা কেবলমাত্র শুনবে, আর বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় উপস্থিত থাকবে ওষুধ প্রস্তুতকারকরা। সেই কারণে সরকারি বৈঠকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে ওষুধ প্রস্তুতকারী সংগঠনগুলির প্রতিনিধিদের।’’
মালিনীর কথায়, এটা সরাসরি স্বার্থের সংঘাত।
নাগরিক আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, কোভিডের সময় থেকে দেখা গিয়েছে, ওষুধ কোম্পানিগুলিকে নিয়ন্ত্রণে যথাযত ভূমিকা নেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার।
এআইডিএএন’র অপর সংগঠক সিদ্ধার্থ দাস বলছেন, ‘‘কোভিডের সময় কয়েকটি পরীক্ষামূলক ওষুধকে যথাযত টেস্ট ছাড়াই ছাড়পত্র দিয়েছিল কেন্দ্র। যেমন গ্লেনমার্কের ফ্যাভিপিরাভির। দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে সন্তোষজনক ফলাফল না এলেও আইটোলিজুমাবের তৃতীয় পর্যায়ের ট্র্যায়াল হয়নি অজ্ঞাত কারণে। পরবর্তীকালে ওষুধ ব্যবহারের ফলে সমস্যা দেখা দিলেও সরকার প্রোডাকশন বন্ধের নির্দেশ দেয়নি। সংস্থাগুলি মুনাফার পাহাড় চড়েছে।
সিদ্ধার্থ দাসের কথায়, ‘‘কোভিডের সময় সাধারণ মানুষের কথা ভেবে আমরা দাম কমানোর আবেদন করি। তাতে কাজ হয়নি। সরকারও কোনও ভূমিকা নেয়নি। কেবলমাত্র রেমডেসভির বিক্রেতা সংস্থাগুলিকে আবেদন করে স্বেচ্ছায় দাম কমাতে। এর কারণ সম্পর্কে আমরা তখন বেশ কিছু আশঙ্কা করেছিলাম। কিন্তু কোনও প্রমাণ ছিল না।’’
নির্বাচনী বন্ডের হাঁড়ি হাটে ভেঙে যাওয়ার ফলে সেই অজ্ঞাত কারণ এবার স্পষ্ট হচ্ছে দেশবাসীর কাছে।
Comments :0