বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনা। খেলোয়ার জীবনের ট্রফির বাগানে সব থেকে মুল্যবান ট্রফিটি বসাতে পেরেছেন মেসি। মেসির ট্রফি জয়। ডি মারিয়া, মার্টিনেজদের নাচ কাতারের লুসেইল স্টেডিয়ামে বসে উপভোগ করেছেন আর্জেন্টিনার বহু নাগরিক। ১২০ মিনিট। তারপর পেনাল্টি। প্রতিটা মুহূর্তে নীল সাদা দর্শকদের নাচ, গান, উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছে টিভির পর্দায়। বুয়েনাস আয়ার্সের রাস্তায় আজ নীল সাদা পতাকার দখলে।
আর্জেন্টিনা চরম সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে চে, মারাদোনা, মেসির দেশ।
প্রায় ১০০ বছর আগে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ ছিল আর্জেন্টিনা। সেই দেশ গত কয়েক দশকে পর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া ঋণের শর্ত মেটাতে দেউলিয়া হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। দেশের রাজনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলির মতো। বিশ্বায়নের অর্থনীতি সঙ্কট বাড়িয়েছে, বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে কঠিন হয়েছে জীবনমান। চলতি বছরেই মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ১০০ শতাংশে পৌঁছেছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের মধ্যে সঞ্চয় কমেছে। যারা তাদের সম্পদ ইউরো বা ডলারে বিনিয়োগ করতে পারে বা পেরেছে তারা ভালো আছে। ফলে আমজনতার প্রতিরোধও বেড়েছে, সরকার বিরোধী মিছিল জায়গা করে নিয়েছে শহরের রাস্তায়।
আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি আলবার্তো ফার্নান্দেজকে বামঘেঁষা মনে করে রাজনৈতিক মহল। চেষ্টা চালাচ্ছেন দেশকে সঙ্কটের বাইরে বের করে আনার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক নীতি থেকে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করছেন। জনকল্যাণ খাতে খরচ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়েই।
দেশের প্রধান পণ্য সয়া, মাংস এবং গমের মতো কৃষি পণ্যের রপ্তানি সীমাবদ্ধ করেছে ফার্নান্দেজ প্রশাসন। রপ্তানিতে কর বসিয়েছেন যাতে দেশের বাজারে খাদ্যপণ্যের অভাব না হয়। মুদ্রাব্যবস্থা এবং অর্থনীতি, দুই-ই স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু দক্ষিণপন্থীরা যথেষ্ট শক্তিশালী। সংসদে প্রভাব বেশি। সরাসরি সরকারের এমন পদক্ষেপের বিরোধিতা করছেন। কারণ বড় ব্যবসার অবাধ রপ্তানির সুযোগ কমছে। দক্ষিণপন্থীরা বলছেন, এই পদক্ষেপগুলি কেবল আরও বাড়িয়ে তুলেছে আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক দুর্দশা।
সংবাদ প্রতিষ্ঠান পলিটিকোর তথ্য অনুযায়ী, বুয়েনস আয়ার্সের রাস্তায় এবং অন্যত্র, গৃহহীন লোকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে আগেই। নতুন সরকার এখনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।
কিন্তু এই সব কিছুর পরেও ১৮ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার নাগরিকদের কাছে রূপকথার রাত। বুয়েনস আয়ার্সে যেন এই রাত বড়দিনের রাত। আর্জেন্টিনার আকাশের আরও একটা তারা যেন যুক্ত হলো। সবাই সব কিছু ভুলে গিয়েছে। একটা বিশ্বকাপ যেন সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়ে গিয়েছে। কেউ কাঁদছেন। কেউ আবার আনন্দে নাচছেন।
৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিটনা। আগের বার মেক্সিকো বিশ্বাকপে জয়ী হয়েছিল দিয়াগো মারাদোনার নেতৃত্বে। আর ঠিক সেই ভাবে মেসিদের মতো ‘ফিরে আসার’ স্বপ্ন দেখছে আলবার্তো ফার্নান্দেজের দেশ। সাধারণ মানুষ আশা করতে শুরু করেছেন যে অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটবে। ফের বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশের সঙ্গে সব দিক দিয়ে পাল্লা দেবে ‘চে’র দেশ।
তবে তাদের এই স্বপ্ন দেখার পিছনে রয়েছেন আরও এক বামপন্থী রাষ্ট্রপতি, লুলা দা সিলভা। প্রতিবেশি ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং লাতিন আমেরিকার অর্থনৈতিক জোট ‘মার্কোসুর’-এর মধ্যে দীর্ঘ বিলম্বিত বাণিজ্য চুক্তি অনুমোদিত হতে পারে। অর্থনীতিবিদদের একাংশের মত, এই সমঝোতা হলে বিনিয়োগ বাড়বে। ব্রাজিলের নতুন রাষ্ট্রপতি লুলা দা সিলভার আমাজন রক্ষার প্রতিশ্রুতিতে সম্ভাবনা বেড়েছে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলির নিজস্ব সমন্বয় বাড়ার সম্ভাবনা বেড়েছে।
অর্থনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি রাজনৈতিক সমস্যাও রয়েছে দেশে। রাষ্ট্রপতি বামপন্থী হলেও সংসদে এখনও শক্তিশালী দক্ষিণপন্থীরা। যার জেরে সরকার ফেলার চক্রান্ত চলছে অনবরত।
উপরাষ্ট্রপতি ক্রিস্টিনা কির্চনারের ছয় বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। জনপ্রিয় এই নেত্রীর বিরুদ্ধে সংসদের তৎপরতায় আনা হয়েছিল দুর্নীতির অভিযোগ। উচ্চ আদালতে আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কাজ চালাতে পারবেন কির্চনার। কিন্তু সরকারের ওপর চাপ তো তৈরি হলোই।
টালমাটাল পরিস্থিতিতেই লড়াই করার বাঁচার রসদ খুঁজছে ৪.৫৮ কোটি নাগরিকের দেশ আর্জেন্টিনা। কাল যাদের আকাশে যুক্ত হয়েছে নতুন একটি তারা।
Comments :0