স্বর্ণেন্দু দত্ত: অযোধ্যা
রামমন্দিরের প্রধান গেটের সামনে সোমবার গভীর রাতে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছেন বাবু ভিজি। বেঙ্গালুরু থেকে তিন দিন আগে এসেছেন। মন্দির-ধরমশালার চত্বরে কাটিয়েছেন দুই দিন। ‘‘বলেছিল, প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরে সাধারণ লোককে ঢুকতে দেবে, কিন্তু দিল না। তাই এখানেই বসে আছি।’’ সোমবার রাত সাড়ে এগারোটা। ছোট্ট এই শহরের তখন গভীর ঘুমে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু অযোধ্যার রাস্তাজুড়ে অষ্টমীর কলকাতার ভিড়। দূর দূর থেকে লোকজন গাড়ি, বাইক-স্কুটিতে চলে এসেছেন। আশা ছিল, ভিআইপিরা চলে যাওয়ায় দর্শন মিলবে মন্দির-মূর্তির।
গত কয়েক মাস ধরে রামমন্দির নিয়ে যেভাবে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, সোশাল মিডিয়ায় প্রচার তুঙ্গে তোলা হয়েছে, তাতে সরকার এবং আরএসএস-বিজেপি তাদের উদ্দেশ্যপূরণের প্রথম ধাপে অন্তত ভালোরকম সফল। সেটা হলো মন্দিরকে ঘিরে উন্মাদনা তৈরি করা। উন্মাদনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মাঝবয়সি বাবু সুদূর বেঙ্গালুরু থেকে চলে এসেছেন। বাবুর মতো আরও বহু মানুষ এসেছেন, আসছেন দলে দলে। অধিকাংশই গরিব। যাদের এই শহরে এখন মাথা গোঁজার জায়গাটুকু নেই। গাছের তলায়, বাসের শেডে সঙ্গে করে আনা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছেন ৭-৮ ডিগ্রি ঠান্ডার মধ্যে। বাবু পেশায় গাড়িচালক। মালিককে দিন সাতেক আগে বলেছেন, আমি যাচ্ছি রামমন্দির। হঠাৎ ঘোষণায় মালিক বিপদে, কিন্তু বাবুর পণ যাবই। অগত্যা মালিকের পরবর্তী প্রশ্ন, কবে ফিরবে? বাবু বলেছেন, জানা নেই। চারদিনে এসেছেন, তিন দিন এখানে বসে আছেন। কবে দেখতে পাবেন, তার উপরে ফেরা স্থির হবে। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত দেখতে পারেননি মন্দিরে। সকালে ঝামেলার সময়ে পুলিশের লাঠি পড়েছে ঘাড়ে। বাবা-মা, স্ত্রী, কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে আছে বাবুর। তাঁর একার আয়ের উপরে নির্ভরশীল পরিবার। তাও কুছ পরোয়া নেহি মনোভাবে হাজির অযোধ্যায়। বাবুর দাবি, রামমন্দির দেখতে আসার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই। তিনি বিজেপি করেন না। আগামী ভোটটা বিজেপি’কে দেবেন কি না, সেটা তখন ভাববেন।
ত্রিপুরার খোয়াইয়ের বাসিন্দা পীযূষকান্তি রায় বাংলায় লেখা পোস্টার গলায় ঝুলিয়ে এসেছেন। তাতে নেশামুক্ত ভারত অভিযানের কথা লেখা আছে বাংলাতেই। বিজেপি শাসনে যে ত্রিপুরা ডুবে গেছে মাদকের নেশায়, সেখান থেকে এমন বার্তা লিখে এসেছেন। আবার হিন্দিতে এক কদম স্বচ্ছতা কি অওর, কিংবা ইংরেজিতে ত্রিপুরা টু শ্রীরাম মন্দিরও লেখা আছে। রামের সঙ্গেই আছেন বিবেকানন্দ এবং নেতাজীও। জানালেন, ১৫ দিন আগে বেরিয়েছেন। আগরতলা থেকে গুয়াহাটি, সেখান কলকাতা, কলকাতা থেকে বিহার, তারপর অযোধ্যা। বললেন, রামমন্দির দেখে তবে ফিরবেন। তাতে যে কদিন সময় লাগে লাগবে। তাঁরও দাবি মন্দিরের সঙ্গে ভোটের সম্পর্ক নেই।
লক্ষ্ণৌ থেকে অযোধ্যার পথে অসংখ্য যুবককে দেখা যাবে পিঠে ভারী ব্যাগ নিয়ে চলেছেন। অনেকেরই হাঁটার ভঙ্গিমায় স্পষ্ট, দীর্ঘ পথচলায় পা আর চলছে না। অথবা ফোসকা পড়েছে বা ছাল উঠেছে। রামের ছবি দেওয়া পতাকার সঙ্গেই তাদের অনেকেরই পিঠে গোঁজা রয়েছে দেশের পতাকাও। বেশ কিছু তরুণীও চলছেন এইভাবেই। সাইকেলেও একইভাবে রামের বা হনুমানের সঙ্গে দেশের পতাকা লাগিয়ে অযোধ্যায় আসছেন অনেকে। যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল, তাঁরা টেন্ট,ম্যাট, গ্যাস-স্টোভ, দামি জ্যাকেট সহ শীতের হাত থেকে বাঁচার সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েই চলছেন। আর গরিব অংশ সাইকেলের ক্যারিয়ারে কম্বল, গায়ে সস্তার মোটা জ্যাকেট, মাথায় গামছা পেঁচিয়ে। হোটেল, গেস্ট হাউসে কোনও জায়গা নেই। মন্দির ধর্মশালাও উপচে পড়ছে। অতএব পথেঘাটেই থেকে যাচ্ছেন।
বিহারের সমস্তিপুর থেকে এসেছেন বিশাল কুশওয়াহা। নীতীশ কুমার বিরাট সমর্থক। রেলের চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন। অন্য সরকারি চাকরির জন্যেও পরীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু ফল বের হয়নি। মন্দিরের জন্য বিজেপি’কে ভোট দিতে রাজি না। কিন্তু অযোধ্যায় এসে বিমোহিত, ‘মোদীজী ভালো কাজ করেছেন।’ বিহারেরই মোতিহারি থেকে সপরিবার এসেছেন রাজেশ কুমার। পায়ের হাওয়াই চটিটা ছিঁড়ে যাওয়ায় খালি পায়েই চলছেন। সঙ্গে মা-বাবা, ভাই-বোন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ থেকে নানাদেশের বহু ধর্মীয় সংগঠন তৈরি করেছে ভাণ্ডারা। সেই সব জায়গায় অঢেল খাওয়া দাওয়া। সেখানেই দুই বেলা পেট পুরে খাওয়া জুটছে তাদের।
মধ্য প্রদেশের ঝাঁসির বলীরাম জুন মাসে গিয়েছিলেন বৈষ্ণোদেবী। সেখান থেকে আম্বালা। আম্বালা থেকে পায়ে হেঁটে অযোধ্যা পৌঁছেছেন। বললেন, বিজেপিকেই ভোট দেন বরাবর। কারণ বিজেপি হিন্দুদের দল। বলীরাম দিনমজুর। বছরের বেশিরভাগ সময়ে কাজ থাকে না। মধ্য প্রদেশের আগের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ মামা কোনও কাজ করেননি। যদিও তাতে বিজেপি’কে ভোট দেওয়া আটকায়নি। জাতীয় পতাকাও সঙ্গে নিয়েছেন। কারণ, ‘ভারত তো হিন্দুদের’। গাজিয়াবাদ থেকে হেঁটে আসা টেন্ট ব্যবসায়ী কার্তিক ভার্মার অবশ্য পায়ে হাঁটাই নেশা। বললেন, আমি শুধু মন্দিরে মন্দিরে ঘুরি, তবে পায়ে হেঁটে। পায়ে হেঁটে বালাজী গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে অযোধ্যা। এখান থেকে নেপাল যাবেন। ট্রেকিংয়ের সমস্ত উপকরণ তার সঙ্গে আছে। ফলে পিঠে বিশাল বোঝা নিয়ে হাঁটছেন। ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠার’ দিন অযোধ্যায় ঢুকছেন রীতিমতো খুঁড়িয়ে। জাতীয় পতাকাও সঙ্গে নিয়েছেন, কারণ ‘দেশের মধ্যের সব মন্দিরেই ঘুরি।’ টেন্টের ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে এসেছেন কর্মচারীদের হাতেই। বললেন, ‘ব্যবসার হাল খুবই খারাপ।’ মনে করেন, ‘মোদীজীর জন্যেই রামমন্দির তৈরি হতে পেরেছে। এত বছরের লড়াই সফল হয়েছে।’ কিন্তু তাঁর দাবি, ‘এর সঙ্গে মোদীকে ভোট দেওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। রাম ভগবান, উনি সবার।’
নিজেকে ‘বিজেপি’র সেবক’ পরিচয়ে রামমন্দির নিয়ে সংবাদপত্রের গোটা পাতা রঙিন বিজ্ঞাপন দেওয়া রীতেশ তিওয়ারি ব্যাটরি রিকশার ব্যবসা। বললেন, কিছু চিন্তা করবেন না, ভোটের মধ্যে যারা দোদুল্যমান সবাইকে আমাদের দিকে টেনে নেব। ‘ব্যস, মন মে রাম হোনা চাহিয়ে।’ সব রাজ্য থেকে লোক আনা হবে এখানে। বিশাল মন্দির দেখে সবাই মোহিত হয়ে যাবে। আর গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভিএইপি’র পক্ষ থেকে রামের নামে শপথ করানো হবে, মোদীজী রামকে এনেছেন। তাই রামের সৌগন্ধ ভোটটা ওনাকেই দিতে হবে। মন্দির হওয়ার আগেই তো মন্দিরের কথা বলে তিন রাজ্যে জিতে গেলাম। আর এখন তো মন্দির খুলে দেওয়া হয়েছে। বিজেপি’র সেবক যতটা নিশ্চিত রামচন্দ্রের ভক্তকুল কিন্তু মোদীজীকে ততটা গ্যারান্টি দিচ্ছেন না এখনই।
Comments :0