তৃণমূল নেতা অভিষেক ব্যানার্জির স্ত্রীর দুটি প্যান নম্বর। ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হিসাবে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে যে নথি মমতা ব্যানার্জির ভাইপো জমা দিয়েছেন সেখানে এই কাণ্ড সামনে এসেছে। ‘চোরদের উলটো করে সোজা করার’ ঘোষণা করা নরেন্দ্র মোদীর শাসনে মমতা ব্যানার্জির পরিবারের সদস্য দুটি প্যান নম্বর নিয়ে বহাল তবিয়তে দিন কাটাচ্ছেন।
গত শুক্রবার মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন অভিষেক। সেই মনোনয়নপত্রের হলফনামায় অভিষেক ব্যানার্জি জানিয়েছেন তাঁর স্ত্রীর নাম রুজিরা নারুলা। সেই মহিলার প্যান— সিসিএমপিএন ৯৩৭৭এফ। ২০২১-২২ পর্যন্ত তিনি আয়কর জমা দিয়েছেন।
গত লোকসভা নির্বাচনেও ডায়মন্ডহারবারে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন অভিষেক। সেবার দেদার ছাপ্পা, ভোট লুট করেছিল তৃণমূল। এমনকি সিপিআই(এম) প্রার্থী ফুয়াদ হালিম রক্তাক্ত হয়েছিলেন তৃণমূলের দুর্বৃত্ত কর্মীদের হামলায়। সেই নির্বাচনে অভিষেক যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন, সেখানে তাঁর স্ত্রীর নাম লেখা হয়েছিল রুজিরা ব্যানার্জি, ‘নারুলা’ নয়। তাঁর প্যান ছিল— এজেএনপিএন ২২৮৬আর। সেবার ২০১৭-১৮ পর্যন্ত রুজিরা আয়কর দিয়েছিলেন বলে মনোনয়নপত্রে জানানো হয়েছিল।
পাঁচ বছরের ব্যবধানে পদবির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্যান বদলে গেছে!
প্যান মানে প্রাইমারি অ্যাকাউন্ট নম্বর। দেশের এক ব্যক্তির একটিই প্যান থাকতে পারে। হারিয়ে গেলে, নষ্ট হয়ে গেলে, পুড়ে গেলে নতুন প্যান কার্ডের জন্য আবেদন করা যায়। নতুন প্যান কার্ড পাওয়াও যায়। কিন্তু নম্বর পালটায় না। পদবি, ধর্ম বদলালেও নম্বর পালটায় না। কিন্তু রুজিরা নারুলা তথা রুজিরা ব্যানার্জির তাই হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন যে, একই ব্যক্তির দুটি প্যান নম্বর থাকতে পারে না। আমাদের কাছে মাঝে মাঝে এমন ঘটনা ধরা পড়ে। সেই সবকটি কোনও জালিয়াতির কেস। একই ব্যক্তি ভিন্ন নামে দুটি প্যান নম্বর ব্যবহার করে জালিয়াতির চেষ্টা করেন।
আয়কর বিভাগের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, দেখা গেছে অনেকে ভুল করেন। তাঁদের দুটি প্যান নম্বর হয়ে যায়। তখন একটি প্যান কার্ড সারেন্ডার করতে হয়। যে প্যান নম্বরটি সারেন্ডার করা হয়, সেটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। দুটি প্যান কার্ড রাখা বেআইনি।
কিন্তু রুজিরা নারুলা তথা রুজিরা ব্যানার্জির ক্ষেত্রে এমন হয়নি। তাঁর দুটি প্যানই ‘ভ্যালিড প্যান’। অর্থাৎ এখনও সক্রিয়, ‘বৈধ’। অর্থাৎ অভিষেক ব্যানার্জির স্ত্রী দুটি প্যান কার্ডই রেখেছেন। একটি সারেন্ডার করার কথা, সেটি তিনি করেননি। আয়কর বিভাগের আধিকারিকদের মতে যা বেআইনি। তাৎপর্যপূর্ণ হলো অভিষেক ব্যানার্জির স্ত্রীর দুটি প্যান কার্ডের বিষয় মোদী-শাসনে আয়কর দপ্তরের আধিকারিকদের নজর এড়াতে পারে না।
আয়কর বিভাগের আধিকারিকদের আর একটি পর্যবেক্ষণ হলো, ২০১৯-এ অভিষেক ব্যানার্জির স্ত্রীর নাম রুজিরা ব্যানার্জি। আর পাঁচ বছর পরে প্যান নম্বরে তাঁর নাম রুজিরা নারুলা। বিয়ের আগের পদবি ব্যবহার করে বিয়ের পরে প্যান কার্ড সাধারণত তখনই কোনও মহিলা করেন যদি তাঁর ডিভোর্স হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মহিলারা স্বামীর পদবি বিয়ের পরেও ব্যবহার করেন না। কিন্তু রুজিরার ক্ষেত্রে সেই যুক্তি খাটছে না। কারণ, ২০১৯-র তিনি নিজেকে রুজিরা ব্যানার্জি হিসাবেই হলফনামায় জানিয়েছেন। এক আয়কর আধিকারিকের কথায়, ‘‘পাঁচ বছর পরে কেউ স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেন, কিন্তু তাঁর প্যান নম্বর বদলে যেতে পারে না।’’
অভিষেক ব্যানার্জির ২০১৯ এবং এবারের হলফনামা দেখলে বোঝা যাচ্ছে, এবারে উল্লিখিত প্যানের ভিত্তিতে যে আয় তাই দেখাতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০১৯-র প্যান যেহেতু এখনও সক্রিয়, ফলে সেই প্যানের আওতায় তাঁর আরও লেনদেন থাকতে পারে। যার অঙ্ক যথেষ্ট বেশি হতে পারে। যা এবার আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। রুজিরা ব্যানার্জির নামে যে প্যান নম্বর ২০১৯-র হলফনামায় অভিষেক ব্যানার্জি উল্লেখ করেছেন, সেখানে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত আয়ের হিসাব দেওয়া হয়েছে। আর রুজিরা নারুলা নামে এবার যে প্যান নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত আয়ের হিসাব দেওয়া হয়েছে। যদিও এবার দেখানো হয়েছে ২০২২-২৩-এ রুজিরা নারুলার কোনও আয়ই নেই।
এর আগে রুজিরা ব্যানার্জি তথা রুজিরা নারুলার পরিচয় নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। শুল্ক দপ্তর সূত্রের দাবি, ২০১৯-র ১৫মার্চ রাত প্রায় পৌনে ১টা বারোটা থাই এয়ারওয়েজের বিমানে (টিজি ৩১৩) দমদমে নামেন দু’জন মহিলা। একজনের নাম রুজিরা নারুলা, অন্যজন মেনকা গম্ভীর। তাঁদের কাছে থাই পাসপোর্টও মেলে। রুজিরা নারুলার পাসপোর্ট নম্বর ছিল- এএ ৫৬৬৩৭৫৭। দ্বিতীয় মহিলার পাসপোর্ট নম্বর- এএ ৫২৬৩৩৮৭। শুল্ক দপ্তরের আধিকারিকরা তাঁদের পাসপোর্ট দেখতে চান। অভিষেক ব্যানার্জির স্ত্রী ও তাঁর বান্ধবী পাসপোর্ট দেখাতে অস্বীকার করেন। অভিষেক ব্যানার্জির স্ত্রী রুজিরা নারুলার কাছে তিনটি ব্যাগেজ, তাঁর বান্ধবীর কাছে দুটি ব্যাগেজ ছিল। দুজনের কাছেই একটি করে হ্যান্ড লাগেজ ছিল। সাতটি ব্যাগের মধ্যে তিনটি ব্যাগে সোনার গয়না ছিল। বিমানবন্দর থানার আধিকারিকরা সেখানে উপস্থিত হন এবং কোনরকম চেকিং ছাড়াই তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য বারেবারে বলতে থাকেন পুলিশ আধিকারিকরা।
প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে ডায়মন্ডহারবারে দলীয় কার্যালয়ে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে সাংবাদিক বৈঠক করে তা সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেন অভিষেক ব্যানার্জি। তিনি দাবি করেছিলেন, ‘‘আমার স্ত্রী জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্যাঙ্ককে। তাই থাই পাসপোর্ট। ও এখানকার ভোটারও নয়।’’
কিন্তু তখনই তাঁর প্যান নম্বর ছিল এবং তা রুজিরা ব্যানার্জি নামে। এবার হাজির হয়েছে আর একটি প্যান নম্বর— সেটি রুজিরা নারুলা নামে।
সেবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রুজিরাকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়। এই নোটিসে বলা হয়েছিল, থাইল্যান্ডের নাগরিক রুজিরা নারুলাকে ব্যাঙ্ককের ভারতীয় দূতাবাসকে ২০১৬-র ৮জানুয়ারি পিআইও (পারসন অব ইন্ডিয়ান অরিজিন) কার্ড দিয়েছিল। কার্ডে তাঁর পিতার নাম নিফন নারুলা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। তার প্রায় দেড় বছর পরে ওসিআই কার্ডের জন্য জমা দেওয়া নথিতে তিনি উল্লেখ করেন তাঁর পিতার নাম গুরশরণ সিং আহুজা, বাড়ি নয়াদিল্লির রাজৌরি গার্ডেনে। ২০১৬-র জানুয়ারি থেকে ২০১৭’র নভেম্বরের মধ্যে বেমালুম বদলে গেছে পিতার নামও।
কিন্তু কোনও প্যানেই ‘আহুজা’ নেই। তাহলে কী আরও কোনও প্যান নম্বর আছে?
Comments :0