শান্তনু ব্যানার্জি
সুদানে রক্তপাত থামার কোনও লক্ষ্মণ নেই। সেনাবাহিনী এবং আধা-সেনা গোষ্ঠী র্যা পিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)’র মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ অব্যাহত। সংঘর্ষবিরতি ঘোষণা হলেও, উভয় পক্ষের যোদ্ধারাই তা মানছে না। গত বুধবার সুদানে এসেছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের শীর্য মানবাধিকার আধিকারিক মার্টিন গ্রিফিথ। তিনি বিবাদমান দুই শিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষবিরাম নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। এক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে সংঘর্ষ কবলিত অঞ্চলে আটকে পড়া লোকজনের ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ।
সুদানে ক্ষমতা দখল নিয়ে সেনাবাহিনী (এসএএফ) এবং আধা-সেনা (আরএসএফ)’র মধ্যে বেশ কিছু সময় ধরেই চাপানউতোর চলছিল। গত ১৫ এপ্রিল যা রীতিমত সশস্ত্র সঙ্ঘাতের আকার নেয়। বিতর্কের সূত্রপাত হয় আরএসএফ’কে সেনাবাহিনীতে মিশিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবকে ঘিরে। কারণ, আধা-সেনা মানতে চায়নি সেনার নেতৃত্ব। ক্রমে সরাসরি বিবাদে জড়িয়ে পড়েন সেনা প্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং আধা-সেনার কমান্ডার মহম্মদ হামদান দাগালো ওরফে হেমদতি।
এদিকে সেনা এবং আধা-সামরিক বাহিনীর সঙ্ঘাতের চড়া মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ইতিমধ্যে লড়াইয়ে ছ’শোর বেশি মৃত্যু হয়েছে। আহত সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি। হতাহতের মধ্যে অধিকাংশই গরিব মানুষ। তারই একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মহিলা ও শিশু।
সংঘর্ষবিরতি যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় লাগাতারভাবেই বেড়ে চলেছে হতাহতের সংখ্যা। সেনা ও আধা-সেনার দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে নাগরিক এলাকায়। দফায় দফায় হামলার মুখে পড়েছে হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র। চলছে লুটপাট। বাদ যাচ্ছে না মানবাধিকার সংস্থার পাঠানো ত্রাণ সামগ্রীও। চরম নৈরাজ্যের আবহে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা নিরাপত্তার অভাবে আপাতত ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। দেশ ছাড়ছেন মানুষ। হাজার হাজার শরণার্থী প্রতিবেশী দেশগুলিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। বাস্তবে যা ক্রমশ গোটা অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনাকে চাগিয়ে তুলেছে।
সুদানে বর্তমানে দুর্নীতিগ্রস্ত দুই বাহিনীর জেনারেলদের সশস্ত্র সঙ্ঘাতের পরিধি সমগ্র অঞ্চলকে অস্থির করে তুলেছে। জড়িয়ে পড়েছে আঞ্চলিক এবং সাম্রাজ্যবাদী শিবিরও। বাস্তবে যা দুনিয়ায় শক্তি ভারসাম্যের নয়া সমীকরণ ফুটিয়ে তুলেছে। বেআব্রু করেছে লগ্নিপুঁজির লুটেরা স্বরূপকে। সম্পদ এবং সীমানা বিস্তারে যা ন্যূনতম মানবাধিকারেরও পরোয়া করে না। আর এখানেই প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ আফ্রিকা মহাদেশের দেশটির গুরুত্ব।
সুদানে সম্পদের অধিকাংশই বহুজাতিকদের নজরে। তা নিয়ে চলেছে বহুস্তরীয় সঙ্ঘাতও। তার মধ্যে দুই জেনারেলের বাহিনীর এহেন সম্মুখ সমর দেখে হতবাক তামাম বিশ্ব।
এর আগে অসামরিক সরকার গঠনে আধা-সেনা (আরএসএফ)’র সেনায় মিশে যাওয়া ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। দেশের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তি সঙ্গে আগে তা নিয়ে বোঝাপড়াও হয় জেনারেলদের। অবশ্য শুরু থেকেই সুদানের বামপন্থীরা এর পরিণতি ঘিরে সংশয় প্রকাশ করেন। সরাসরি প্রশ্ন তোলেন দক্ষিণপন্থী দলগুলির অসামরিক সরকার গঠনে আন্তরিকতার বিষয়ে।
সুদানের কমিউনিস্ট পার্টি সাফ জানায়, সেনা এবং আধা-সেনা লুটের রাজত্ব বজায় রাখতেই দেশে সংঘর্ষ জারি রাখবে। আর এই অছিলায় তারা অসামরিক সরকারের হাতেও ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। বাস্তবে যা মিলেও যাচ্ছে আজকের ঘটনাবলির সঙ্গে।
‘‘বিধ্বস্ত খার্তুম। শহরের চারপাশে ধ্বংসের চিহ্ন। রাস্তায় পড়ে লাশ। বেশ কিছু দেহে পচন ধরেছে। সংঘর্ষ চলায় দেহগুলি উদ্ধারকাজ সম্ভব হয়নি,’’ জানান সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার সাংবাদিক হিবা মোর্গান।
মাঝে মধ্যে খার্তুমে রাষ্ট্রপতি ভবনের আশপাশ থেকে সংঘর্ষের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আকাশ ছেয়ে রয়েছে কালো ধোঁয়ায়।
গত ১৫ এপ্রিল সুদানের বায়ু সেনা খার্তুমের টিবা এবং সোবায় আরএসএফ’র ঘাঁটিতে হামলা চালায়। ওই দিন সকাল থেকেই বিভিন্ন শহরে ভয়াবহ গুলির লাড়াই শুরু হয়ে যায়। শহরে রাষ্ট্রপতি ভবন ও বিমানবন্দরের দখল পেতে চলে দফায় দফায় সংঘর্ষ।
প্রথমে আরএসএফ’র প্রধান জেনারেল দাগালো রাষ্ট্রপতি ভবন দখলের দাবি করেন। সামরিক প্রশাসনের একদা দ্বিতীয় এই জেনারেল সামরিক জুন্টার চেয়ারম্যান তথা সেনা প্রধান জেনারেল বুরহানের বাহিনী পরাজিত বলেই জানান। কিন্তু দ্রুত পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। এর পর একটা সময় সুদানের সেনা জানায় আরএসএফ’র যোদ্ধারা রাষ্ট্রপতি ভবন সংলগ্ন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
ভয়াবহ সংঘর্ষের মুখে এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান বহু স্থানীয়। সেনার পক্ষ থেকে তাঁদের ঘরে ফেরার জন্য বলা হয়। এই সময় আধা-সেনার পক্ষ থেকে খার্তুম বিমানবন্দর এবং এল-ওবেইদ শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা করা হয়। দাবি করা হয় মিশর সীমান্তে উত্তরের মেরোয়েত সামরিক বিমান ঘাঁটি দখলেরও। কিন্তু তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে।
‘‘মনে হচ্ছে সুদানের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতি ভবনের নিয়ন্ত্রণ পেতে জোরালো হামলা শুরু করেছে। সেনা এবং আধা-সেনার তীব্র সংঘর্ষ চলছে। হামলা করা হচ্ছে যুদ্ধ বিমান থেকেও। রাষ্ট্রপতি ভবন এবং খার্তুমের বিভিন্ন অংশ ঠিক যেন যুদ্ধক্ষেত্র,’’ খার্তুম থেকে খবর পাঠিয়েছেন ফ্রিলান্স সাংবাদিক স্টিভেন মেজর।
এদিকে সুদানে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিগুলিও। আধা-সেনা প্রধান জেনারেল দাগালোকে সমর্থন করছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী (ইউএই)। পাশাপাশি সেনা প্রধান জেনারেল বুরহানের পেছনে আছে মিশর। বাস্তবে যখন সুদানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কণ্ঠরোধে পরস্পরকে টেক্কা দিতে দেখা গেছে সেনা এবং আরএসএফ’কে।
২০০০ সালের পরবর্তী সময়ে দারফুরে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় সুদানের শাসকরা বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরি করে। এমন সশস্ত্র দলগুলিকে নিয়েই ২০১৩ সালে গড়ে ওঠে আরএসএফ।
ওই আধা-সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার ওপর অপরাধ এমনকী গণহত্যা সংগঠিত করারও অভিযোগ রয়েছে। ওই গোষ্ঠীগুলির হানাদার ফৌজকে নিয়ে তৈরি আরএসএফ দেশের মানুষের কাছে কোনোকালেই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। সুদানের প্রাক্তন স্বৈরাচারী একনায়ক ওমর আল-বশিরের প্রশাসনের আমলে ওই ভয়াবহ অপরাধগুলি ঘটে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) বসিরের ওপরে মামলা চলছে।
২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল দুর্বার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখে বসির ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। দীর্ঘ চার মাস ধরে চলা গণতন্ত্রের দাবিতে সেই আন্দোলন ‘ডিসেম্বর বিপ্লব’ নামেই বিখ্যাত।
বসিরের ক্ষমতা থেকে সরার সময় আরএসএফ দেশের অন্যতম ক্ষমতাশালী সংস্থা হিসাবে উঠে আসে। দারফুরে সোনার খনির কারবার ঘিরে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয় অর্থনৈতিক কার্যকলাপ।
আরএসএফ‘র শক্তি বৃদ্ধিতে অসুবিধায় পড়ে সেনা। গত কয়েক বছর ধরেই উভয় পক্ষের মধ্যে আড়ালে দ্বন্দ্ব চলে। আবার কখনও তা চলে আসে প্রকাশ্যেও। খার্তুমের রাজনৈতিক মহলে চর্চায় থাকত বুরহান এবং দাগালোর মধ্যে জারি মতপার্থক্য নিয়ে নানা রকমের জল্পনা। কিন্তু ‘ডিসেম্বর বিপ্লব’ থেকে সামরিক জুন্টাকে রক্ষা করতে একযোগে কাজ করতে থাকেন ওই ক্ষমতালোভী দুর্নীতিবাজ সেনা আধিকারিকরা।
বসিরের বিদায়ের পরে সামরিক প্রশাসন ক্ষমতা দখল করে জুন্টা সরকারের চেয়ারম্যান হন বুরহান। উপপ্রধান করা হয় দাগালোকে। কিন্তু বুরহানের বিদায়ের পরেও দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে। মেরেয়ে সামরিক বিমানঘাঁটির কাছেই আন্দোলনকারীরা ধরনা শুরু করেন। এই সময় বুরহান আরএসএফ’কে বিমান ঘাঁটি ঘিরে ফেলার নির্দেশ দেন। ২০১৯ সালের ৩ জুন বিমান ঘাঁটিতে আধা-সেনা মোতায়েন হয়। এবং তার পরেই শুরু হয় গণহত্যা।
আরএসএফ শতাধিক আন্দোলনকারিকে খুন করে। আহত হন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। সেনার সদর দপ্তর থেকে মহিলা প্রতিবাদীদের পরপর ধর্ষিতা হতে দেখেও, হাত গুটিয়ে রাখে জওয়ানরা।
বলা বাহুল্য, সেদিন যারা আন্দোলনকারীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিল, সব দেখেও যারা আড়ালে থেকে মজা দেখে, আজ তারাই পরস্পরের ওপরে মারণ হামলায় রত।
সুদানের চিকিৎসকদের সংগঠনের আশঙ্কা বিদেশিদের উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার পর অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে। সংঘর্ষ কবলিত অঞ্চলে প্রায় ৬৯ শতাংশ হাসপাতালই বিধ্বস্ত। সেখানে চিকিৎসা সম্ভব নয়। দেশে ওষুধের আকাল। অনেক অঞ্চলে ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট পরিষেবা। ঠিক মতো পাওয়া যাচ্ছে না খাবার ও জল। সেনা এবং আধা-সেনার লড়াইয়ে সব থেকে বেশি প্রভাবিত খার্তুম। প্রায় ৬০ লক্ষ জনসংখ্যার শহরটিতে আজ শুধুই হাহাকার। ভেঙে পড়েছে সামাজিক পরিকাঠামো।
এই প্রথম সুদানের সংঘর্ষের সরাসরি প্রভাব পড়ল খার্তুমে। অতীতে কখনও এমন সঙ্ঘাতের আঁচ রাজধানী শহরে পড়েনি। সংঘর্ষের প্রথম থেকেই অচল হয়ে যায় বিমানবন্দর। বাস্তবে যা বিশ্বের অন্যতম গরিব দেশটিতে খাদ্য সঙ্কট আরও তীব্র করেছে।
আফ্রিকা মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ সুদান। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। রয়েছে চাষাবাদের সম্ভাবনাও। কিন্তু শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেশের বিকাশে অন্তরায় হচ্ছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সমীক্ষা অনুসারে, ইতিমধ্যে সেনা এবং আরএসএফ’র সংঘর্ষের মাঝে পড়ে বহু নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। খার্তুম সহ বিভিন্ন অংশে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীও পাচ্ছেন না। এর ফলে জোরালো হচ্ছে দেশ ছাড়ার ঘটনা।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ চাদের সঙ্গে সুদানের দীর্ঘ সীমানা। বর্তমানে ওই সীমান্তে হাজার হাজার শরণার্থী অপেক্ষা করছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের তথ্য অনুসারে, চাদের পশ্চিমের প্রদেশগুলিতে ইতিমধ্যে ৪ লক্ষের বেশি শরণার্থী রয়েছেন। আক্ষরিক অর্থেই যা আরও জটিল করেছে শরণার্থী সঙ্কটকে।
Comments :0