এই পরিস্থিতির মুনাফা লুটছে এক লটারির কোম্পানি, এবং রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। নির্বাচনী বন্ড থেকে পাওয়া তথ্য সেদিকেই নির্দেশ করছে। মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তাকে পণ্য বানিয়ে ভরানো হয়েছে দলীয় তহবিল, বেড়েছে বহুজাতিক লটারি ব্যবসায়ীর মুনাফা। এই সংস্থাই টাকা দিয়েছে বিজেপি’র তহবিলেও, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে।
নির্বাচনী বন্ড কেনাবেচার তথ্য অনুযায়ী, লটারি ধনকুবের স্যান্টিয়াগো মার্টিনের সংস্থা ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি অবধি মোট ১৩৬৮ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে, এবং সেই টাকা রাজনৈতিক তহবিলে জমা করেছে। ১৩৬৮ কোটি টাকার ৩৯.৬ শতাংশ এসেছে তৃণমূলের ভান্ডারে। যার পরিমাণ ৫৪৩ কোটি টাকা। বিজেপি পেয়েছে ১০০ কোটি।
এই সংস্থার লটারির টিকিট কেটেই কোটিপতি হওয়ার দাবি করেছে অনুব্রত মন্ডলের পরিবারের সদস্যরা থেকে শুরু করে তৃণমূলের আরও একাধিক বিধায়কের পরিবারের সদস্য। লটারির এই রমরমায় আদ্যোপান্ত জড়িয়ে তৃণমূল কংগ্রেস।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে তৃণমূল জেতার পর থেকে ফিউচার গেমিং তৃণমূলকে বিপুল আর্থিক সাহায্য করে চলেছে। তৃণমূলকে মোট ৫৪৩ কোটি টাকা দিয়েছে এই সংস্থা, তারমধ্যে ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেওয়া টাকার পরিমাণ ৫৪১ কোটি।
এই সংস্থা কেন তৃণমূলকে বিপুল সহায়তা করেছে, সেটা পুলিশি রিপোর্টের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হবে। ২০২২ সালে সংস্থার বিরুদ্ধে কলকাতা পুলিশ এফআইআর করে। তদন্ত করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। ফিউচার গেমিংয়ের ৪০৯.৯২ কোটি টাকার স্থাবর সম্পত্তি সাময়িক ভাবে বাজেয়াপ্ত করে ইডি। অভিযোগ ছিল, লটারির টিকিট বিক্রির লভ্যাংশ উপঢৌকন হিসেবে বিলিয়েছে এই সংস্থা। তারফলে লটারির পুরস্কার দেওয়ার নীতিতে আনতে হয়েছে বদল।
রাজ্য সরকারের দাবি ছিল, নীতি বদলে সায় নেই সরকারের। তাই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনুব্রত মন্ডলের পরিবারের লটারি জেতা, কিংবা জোড়াসাঁকোর তৃণমূল বিধায়ক বিবেক গুপ্তের স্ত্রীর ১ কোটি টাকা জ্যাকপট জেতা, কিংবা নৈহাটির তৃণমূল বিধায়ক রাজেন্দ্র প্রসাদ সিংয়ের শ্যালিকা’র ১ কোটি টাকার পুরস্কার জেতা কি নেহাতই কাকতালীয়? না কলকাতা পুলিশের এফআইআরে বর্ণিত উপঢৌকন দেওয়ার উদাহরণ এগুলি?
লুটের এই তন্ত্রের ফলে একদিকে ফুলেফেঁপে উঠেছে শাসকদল এবং তার অনুসারি সমস্ত স্তর। অপরদিকে অনিশ্চিতের দিকে চেয়ে লটারির টিকিট কাটা বাংলার সাধারণ বিপর্যস্ত মানুষ তলিয়ে গিয়েছে আরও অতলে।
নির্বাচনী বন্ডের তথ্য অনুযায়ী, তৃণমূলের অপর সহায়কের নাম আইএফবি অ্যাগ্রো। এই সংস্থা দেশি, বিদেশি মদ তৈরি করে। ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এলাকায় এই সংস্থার বটলিং প্ল্যান্ট। অভিযোগ উঠেছিল, অভিষেক ব্যানার্জির দলবল কারখানায় হামলা চালিয়েছিল। তারপর এই সংস্থার তরফে ৪২ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে তৃণমূল। সোজা কথায়, রাজনৈতিক তোলাবাজির নিকৃষ্ট উদাহরণ এই লেনদেন।
লটারির দোকানের পাশাপাশি, গত ১৩ বছর ধরে রাজ্যে ধারাবাহিক ভাবে বাড়ছে মদের দোকান। রাজ্যে মদ বিক্রির পরিমাণও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মনোবিদরা বলছেন, অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে যাওয়া সমাজ বাস্তব ভুলতে পান করছে মদ। আর সেই ফায়দা তুলছে তৃণমূল। মদ প্রস্তুতকারী বিভিন্ন সংস্থার থেকে বন্ডের মাধ্যমে রাজ্যের শাসকদলের আয় ১৩৫ কোটি টাকার কিছু বেশি।
Comments :0