Sundarban

বালুর দপ্তরের বিরুদ্ধে লড়ে ক্ষতিপূরণ আদায় সুন্দরবনের দুই মহিলার

রাজ্য

প্রতীম দে: কলকাতা
 

হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে বন দপ্তরকে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সুন্দরবনের বাঘের আক্রমণে নিহত দুই গ্রামবাসীর স্ত্রীকে। তাঁরা সরস্বতী আউলিয়া এবং সরোজিনী মণ্ডল। আইনি লড়াই লড়ে ক্ষতিপূরণ পেলেও আবাস যোজনার ঘর পায়নি এই দুজন। দুয়ারে সরকারে গিয়ে ফরম জমা করেছেন, পঞ্চায়েতে গিয়েছেন তাও হয়নি। বিধবা ভাতা পাচ্ছেন তাঁরা তাও স্থানীয় তৃণমূল নেতার হাতে পায়ে ধরার পর।
রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এখন চুরির অভিযোগে জেল হেপাজতে। তাঁরই দপ্তরের বঞ্চনার বিরুদ্ধে আদালতে লড়েছেন দুই নিহত মৎস্যজীবীর স্ত্রী। আলোড়ন পড়েছে গোসাবায়, যেখানে তাঁদের বাড়ি। কিন্তু আমফানে ঝড়ে ভেঙেছে মাটির দেওয়াল। খড় দিয়ে কাগজ দিয়ে কোনমতে একটা দেওয়াল বানিয়ে ভাঙা ঘরে থাকেন সরস্বতী আউলিয়া। 
ঠান্ডায় এইভাবে কি করে থাকে? তাঁর উত্তর—‘‘এভাবেই থাকতে হবে, কিছু করার নেই।’’ সরকার থেকে টাকা দেয়নি ঘর করার জন্য?— এবার তিনি বললেন,‘‘না না। অনেক বলেছি, কিছু দেয়নি।’’
সুন্দরবনের লাহিড়ীপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় থাকেন সরস্বতী আউলিয়া। ২০১৯ সালে জঙ্গলে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের হামলায় মৃত্যু হয়েছে তাঁর স্বামী রাধাকান্ত আউলিয়ার। বন্ধু শম্ভু মণ্ডলকে বাঘের হাত থেকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রাধাকান্ত আউলিয়া। বন্ধুকে তিনি বাঁচাতে পারেননি। তিনি নিজেও বাঘের হামলায় মারা যান। দিনটি আজও মনে সরোজিনী মণ্ডলের। ধরে আসা গলাতে তিনি বলেন, ‘‘মাছ, কাঙড়া ধরতে নদীতে গিয়েছিলেন। জেটি ভাড়া করে সবাই যায় মাছ ধরতে। তিনিও গিয়েছিলেন। আগেও যেতেন। ফেরার সময় বাঘ হামলা করে। সব শেষ হয়ে যায়।’’ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। 
চার বছর আগে দুজনের স্বামী বাঘের পেটে যাওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী বনদপ্তরের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দরখাস্ত জমা করেছিলেন। কিন্তু বনদপ্তরের পক্ষ থেকে তাদের সেই আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। সরোজিনী মণ্ডল এবং সরস্বতী আউলিয়ার হয়ে আইনি লড়াই লড়েন আইনজীবী শান্তনু চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘২০১৯ এর ১৭ অক্টোবর বাঘের হামলায় শম্ভু মণ্ডল এবং রাধাকান্ত মণ্ডলের মৃত্যু হয়। পরের দিন শম্ভু মণ্ডলের দেহ পাওয়া গেলেও রাধাকান্ত আউলিয়ার দেহ পাওয়া যায়নি। পঞ্চায়েত থেকে মৃত্যুর শংসাপত্র পাওয়ার পর সরোজিনী মণ্ডল এবং সরস্বতী আউলিয়া ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করে। কিন্তু বনদপ্তর তা খারিজ করে দেয়।’’ তিনি আরও জানান যে, ‘‘বনদপ্তরের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয় যে ওই দুই মৎস্যজীবী নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করে মাছ ধরছিলেন তাই তাঁদের মৃত্যুতে পরিবারকে কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। কিন্তু আদালতের পক্ষ থেকে সেই যুক্তি খারিজ করে দেওয়া হয়।’’ তার কথায় আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয় যে জীবিকার কারণে কোনও ব্যক্তি যদি নিষিদ্ধ এলাকায় গিয়ে মাছ ধরে এবং বাঘের হামলায় যদি তার মৃত্যু হয় তাঁর সঙ্গে ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। আইনজীবীর কথায় সুন্দরবনের প্রায় ২৫০ জন ব্যাঘ্র বিধবা সুন্দরবন ব্যাঘ্র সমিতির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের দাবি করেছেন সরকারের কাছে।
সুন্দরবন ব্যাঘ্র সমিতি একটি সংগঠন, যা ওই এলাকার ব্যাঘ্র বিধবাদের নিয়ে গঠিত। তাদের বিভিন্ন সমস্যা, লড়াইয়ে পাশে থাকে এই সংগঠন। সরোজিনী মণ্ডল এবং সরস্বতী আউলিয়া আদালতের নির্দেশে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। কিন্তু কবে সেই টাকা হাতে পাবেন তা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। সরস্বতী আউলিয়া বলেন, ‘‘টাকা তো পাবো শুনেছি। কিন্তু করে সেই টাকা হাতে পাবো জানি না। শুধু বলা হয়েছে টাকা পাওয়ার আগে ফোন আসবে।’’
স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে কাঁকড়া, ছোট চুনো মাছ ধরে কোন মতে সংসার চালায় সরস্বতী আউলিয়া। একটি ছেলে, বাইরে থাকেন কাজের জন্য। এক কথায় পরিযায়ী শ্রমিক। পুত্রবধূ, নাতনি তাঁর সঙ্গে থাকেন। ভেঙে পড়া মাটির দেওয়ালের পাশে বসে সরস্বতী আউলিয়া বলেন, ‘‘গরিব মানুষ আমরা। ছেলে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে পারে না। সংসার তো চালাতে হবে। তাই কাঁকরা, মাছ ধরা ছাড়া আর কি কাজ করব।’’ ঘরের বিষয় জানতে চাওয়া হলে বলেন, ‘‘আমফানের সময় ঘর ভেঙেছিল। আবাস যোজনার ঘরের জন্য আবেদন করেছিলাম। টাকা পাইনি।’’ সরস্বতী আউলিয়ার সঙ্গে তাঁর পরিবার থাকলেও ভাঙা ঘরে একাই থাকেন সরোজিনী মণ্ডল। তাঁরও দুই ছেলে পরিযায়ী শ্রমিক। ছোট ছেলে থাকে হায়দরাবাদে, আর বড় ছেলে থাকে আন্দামানে। দুই ছেলের পরিবারও তাদের সাথে বাইরের রাজ্যে থাকেন। 
সংসার চলে কি ভাবে? তাঁর উত্তর,‘‘ছেলেরা তো সব সময় টাকা পাঠাতে পারে না। ওদের হাতে কাজ থাকলে টাকা পাঠায়। তাই কখনও কখনও কাঁকড়া ধরে কিছু পয়সা ঘরে আসে। 
তবে শুধুমাত্র সরস্বতী আউলিয়া বা সরোজিনী মণ্ডল নয় বাসন্তী, গোসাবা ব্লকে অনেকে মহিলার স্বামীকে হারিয়েছেন বাঘের আক্রমণে। সবাই ক্ষতিপূরণ পান না। সবাই সাহস করে আইনি লড়াই করতেও পারেন না। অনেকে আবেদন করেন তাদের আবেদনও খারিজ হয়ে যায়, নিষিদ্ধ এলাকার নাম করে। তারাও ওই কাঁকড়া ধরে বা হাঁস, মুরগি পালন করে জীবন জীবিকা চালান। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কলকাতা বা অন্যত্র চলে আসেন গৃহসহায়িকার কাজ নিয়ে।
 

Comments :0

Login to leave a comment