Rafale scam

রাফালে কেলেঙ্কারির তদন্তে মোদীই ঢাল

জাতীয়

 ‘চৌকিদারকে’ চোর বলা যাবে না। আসলে চৌকিদার চোর হোক বা না হোক, চৌকিদার যে চোরেরই চৌকিদার, এমন সত্যটা ক্রমশ বেআব্রু হচ্ছে। রাফালে বিমান বরাতে দুর্নীতি নিয়ে ফরাসি বিচারপতিদের তদন্তের পথে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এদেশের মোদী সরকার। নির্দিষ্ট তথ্য চেয়েও এক বছরেরও বেশি সময় ধরে না পেয়ে এখন সেই তদন্ত প্রায় বন্ধ। কারণ ফরাসি তদন্তকারীদের হাতে যাতে সেই তথ্য না যায় তা নিশ্চিত করতে শুধু সরাসরি প্রত্যাখ্যানই নয়, নানা অছিলায় বিষয়টি দীর্ঘ আট মাস ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। জুলাই মাসে ভারতে বহাল তৎকালীন ফরাসী দূত ইমানুয়েল লেনাইন কূটনৈতিক নোটের মাধ্যমে মোদী সরকারের রাফালে তদন্তে অসহযোগিতা নিয়ে সরবও হয়েছেন। নিজের নোটে বর্তমানে ব্রাজিলে বহাল ফরাসি রাষ্ট্রদূত লিখেছিলেন, ‘আমাদের ভারতীয় শরিকরা বহু কেসই সামলাতে অনেক দেরি করেছে। আবার অনেক সময়েই সেই তদন্ত থাকত অসম্পূর্ণ।’ চোরেদের আড়াল করতে মোদী সরকারের তৎপরতার এই তথ্য বৃহস্পতিবারই ফাঁস করেছে প্যারিসের এক অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট ‘মিডিয়াপার্ট’। এর আগেও এই ওয়েবসাইট রাফালে কেলেঙ্কারিতে মোদীকে বেআব্রু করেছে। সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা ভোটের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী বারে বারেই বলে বেড়িয়েছেন, ‘মোদী গ্যারান্টি মানেই হলো দুর্নীতিটাই জেলে ঢুকে যাওয়া’। কিন্তু ‘মিডিয়াপার্ট’ আরও একবার খোলসা করল, জেলে পোরা নয়, দুর্নীতিবাজকে বাঁচাতেই সদাজাগ্রত ‘চৌকিদার’। সংসদ ভবনের চৌকিদারির গাফিলতি নিয়ে এই মুহূর্তে মহা-বিব্রত মোদী সরকারের বিড়ম্বনা আরো খানিকটা বাড়িয়েই দিল ফরাসি রিপোর্ট।
নতুন রিপোর্টে ‘মিডিয়াপার্ট’ স্পষ্টই জানিয়েছে, ২০১৬ সালে ৭৮০০ কোটি ইউরো খরচ করে দাসাউ নির্মিত ৩৬টি রাফালে বিমান কেনায় দুর্নীতি নিয়ে চলতি তদন্তে ফরাসি বিচারপতিদের সহযোগিতা করতে অস্বীকার করে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। মোদীর তরফে অসহযোগিতা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে ২০২৩ সালের ২৫ জুলাই ফরাসি দূত ইমানুয়েল লেনাইন কূটনৈতিক নোট পাঠিয়ে তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। 
‘মিডিয়াপার্ট’ জানিয়েছে, রাফালে কেলেঙ্কারিতে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতি’, ‘প্রভাব খাটানো’ ও ‘পক্ষপাতিত্বের’ অভিযোগ রয়েছে। তার ফৌজদারির তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই বিচারপতি ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবেই অনুরোধ জানিয়েছিল। মোদী সরকার যদিও সেই সরকারি অনুরোধ সরাসরি প্রত্যাখান করে দেয়। রিপোর্ট আরো জানিয়েছে, সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করার আগে দীর্ঘ আটমাস ধরে মোদী সরকার ভারতের ফরাসি দূতাবাসকে বিপথে চালনা করেছে। বাধ্য হয়েই তাই ইমানুয়েল লেনাইন এব্যাপারে একটা কূটনৈতিক নোট লিখতে বাধ্য হন। জুলাই মাসে লেখা তাঁর কূটনৈতিক নোটে ইমানুয়েল আরো উল্লেখ করেছিলেন যে, আগস্টের ১১ ও ১২ তারিখ কলকাতায় আসন্ন জি ২০ দুর্নীতি বিরোধী শীর্ষ বৈঠকের সুযোগ নিয়ে ফরাসি সরকার যাতে ‘কিছু ক্ষেত্রে অগ্রসর’ হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু ঘটেনি। 
আর ‘মিডিয়াপার্ট’ জানিয়েছে, একটি বিচারবিভাগীয় অনুরোধ সম্পর্কে মোদী সরকারের টালবাহানা নিয়ে নয়াদিল্লি ফরাসি রাষ্ট্রদূত গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। ২০২২’র ২৮ নভেম্বর ফরাসি দূতাবাসের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আধিকারিক নিজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে গিয়ে লিয়াজওঁ জাজের সঙ্গে দেখা করে তার হাতে ফরাসি জাজদের অনুরোধপত্রটি তুলে দিয়ে আসেন। যদিও তার কয়েকদিন আগেই কুরিয়ারের মাধ্যমে সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রিপোর্ট জানিয়েছে, এর পরের দু’মাস ভারতীয় লিয়াজোঁ বিচারপতি ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগই করেননি। এর পরে ২০২৩’র ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ফরাসি কর্তৃপক্ষকে জানান যে, তাঁকে লিয়াজোঁ বিচারপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অবিলম্বে তাঁর জায়গায় কাউকে বসানো হচ্ছে না। ব্যাপারটা নিয়ে ফরাসি রাষ্ট্রদূত ইমানুয়েল লেনাইন খুবই অধৈর্য হয়ে পড়েন। 
এরপর গত ৬ এপ্রিল তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড ও তাঁর আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আধিকারিক ভারতের বিদেশ মন্ত্রকে ফ্রান্স-ভারত সম্পর্কের দায়িত্বে থাকা আধিকারিক সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ের দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ডিরেক্টারের সঙ্গে দেখা করতে সক্ষম হন। ‘মিডিয়াপার্ট’ তার রিপোর্টে জানিয়েছে, ‘ভারতীয় দুই আধিকারিকই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তাঁরা ‘যত দ্রুত সম্ভব’ ফরাসি বিচারকদের অনুরোধে সাড়া দেবেন। শেষে ২৪ এপ্রিল ফরাসি দূতাবাস জানতে পারে যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নতুন লিয়াজোঁ জাজ নিয়োগ করেছে। ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের থেকে ইমেল মারফত নতুন বিচারপতি নিয়োগের কথাটি ফরাসি দূতাবাসকে জানিয়েছিল।
ফরাসী রাষ্ট্রদূত ইমানুয়েল তাঁর কূটনৈতিক নোটে লিখেছেন, ‘সেই নতুন জাজের সঙ্গে দেখা করা হলেও তিনি কোনওরকম ভাবেই সহযোগিতা করেননি।’
‘মিডিয়াপার্ট’-এর রিপোর্ট অনুসারে, এই তদন্তের পুরো ঘটনা মোদী সরকারের মনোভাবটাকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছে, তাদের আকাঙ্ক্ষা হলো রাফালে জেট বিক্রির দুর্নীতির বিষয়ো ফরাসি বিচার বিভাগীয় যে তদন্ত চলছে তা যেন কোনও ফলাফলে না পৌঁছায়। এই একই চেষ্টা রয়েছে ফরাসি সরকারের তরফেও। এর ফলে তদন্তকারী বিচারকরা একটি বড় বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, কারণ তাঁদের কাছে গোপনীয় ফরাসি নথি ও ভারতীয় বিচারবিভাগীয় নথি উভয়েরই অভাব রয়েছে যা গোপন কমিশনের লেনদেনের ব্যাপারটা পুরোপুরি প্রমাণ করে ফেলতে পারে।

রাফালে দুর্নীতি নিয়ে মোদী সরকার মুখে কুলুপ আঁটলেও এর আগেই এই ‘মিডিয়াপার্ট’-এর রিপোর্টে ফাঁস হয়েছে দুর্নীতি। বিশেষ করে ফরাসি সরকারের তরফে তদন্তে বারে বারেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে মোদী সরকারকে। একটা সময় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক দাবি করেছিল, রাফালে বরাতে কোনও মধ্যস্থতাকারী ছিল না। ফরাসি তদন্তে আগেই দেখা গিয়েছিল এক ভারতীয় কোম্পানিকে অর্থ দেওয়া হয়েছে। এখন ফরাসি অনলাইন জার্নাল ‘মিডিয়াপার্ট’ নতুন নথি প্রকাশ করে জানিয়েছে, রাফালে নির্মাতা দাসাউ অ্যা ভিয়েশন ভুয়ো ইনভয়েস ব্যবহার করে এক ভারতীয় মধ্যস্থতাকারীকে অন্তত ৭৫ লক্ষ ইউরো (৬৫ কোটি টাকা) পাইয়ে দিয়েছে। সুষেন গুপ্তা নামের এক মধ্যস্থতাকারীকে টাকা দেওয়া হয়েছে ভুয়ো ইনভয়েস ব্যবহার করে। এই ব্যক্তির মরিশাসে নথিভুক্ত ইন্টারস্টেলার টেকনোলজি দাসাউয়ের কাছ থেকে টাকা পেয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা বরাতে মধ্যস্থতাকারী অবৈধ। প্রশ্ন উঠেছে, রাফালে নির্মাতা সংস্থা কোনও কারণ ছাড়াই এই ব্যক্তিকে টাকা দিল কেন? 
‘মিডিয়াপার্ট’ জানিয়েছে, ২০১৮-র ১১ অক্টোবর রাফালে বরাতের কমিশন পাওয়ার দলিলও সিবিআই হাতে পায় বলে অভিযোগ। কিন্তু তারা সেই তদন্তে আর এগোয়নি। ইডি’র হাতে থাকা একটি দলিলে সুষেন গুপ্তা জানিয়েছেন তিনি দাসাউয়ের তরফে ভারতে প্রশাসনিক স্তরের কাউকে দিয়েছেন। আরেকটি চাঞ্চল্যকর নথিও ইডি ও সিবিআই’র হাতে রয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ২০১৫-তে রাফালের বরাত সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হবার সময়ে সুষেন গুপ্তা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের গোপন দলিল পেয়েছিলেন। সেখানে বিমানের দাম, ভারতের তরফে আলোচনাকারীরা কী অবস্থান নেবেন তা নিয়ে বিশদ ছিল। এই দলিল তাঁর হাতে গেল কী করে এবং কেন—এই প্রশ্নের কোনও উত্তর মেলেনি। বরং কংগ্রেসের তরফে অভিযোগ করা হয়েছে, এই ব্যক্তি দাসাউকে নোট দিয়ে বলেছিল ‘রাজনৈতিক হাইকম্যান্ডের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়া যায়’। যে-সময়ে এই নোট দেওয়া হয় তখন মোদী প্রধানমন্ত্রী। এই ‘হাইকম্যান্ড’ কে? তিনি কি শেষ পর্যন্ত দেখা করেছিলেন? 
প্রশ্ন উঠেছে, রাফালে বরাত নিয়ে ইউপিএ আমলে আলোচনার সময়ে ‘দুর্নীতি সংক্রান্ত’ একটি ধারা ছিল। মোদী সরকার সেই ধারা বাদ দেয়। কেন এই ধারা বাদ দেওয়া হয়েছিল তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। 
এখন জানা যাচ্ছে, রাফালের জন্য যে কমিশন বা উৎকোচ দেওয়া হয়েছে তা ভারতের তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এবং ইডি জানত। সেই সংক্রান্ত নথিপত্রও তাদের হাতে ছিল। এই সুষেন গুপ্তা অগস্টা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার বরাতে উৎকোচ পেয়েছিলেন বলে অভিযোগ। সিবিআই তার নথিপত্রও পায়। সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের কাছে মরিশাসের কর্তৃপক্ষ নথিপত্রও পাঠায়। ২০১৮-র ১১ অক্টোবর রাফালে বরাতের কমিশন পাওয়ার দলিলও সিবিআই হাতে পায় বলে অভিযোগ। কিন্তু তারা সেই তদন্তে আর এগয়নি। ইডি’র হাতে থাকা একটি দলিলেও কমিশনের প্রমাণ রয়েছে। এই অবস্থায় দেশের আইন অনুযায়ী তদন্ত করার কথা। কেন তা করা হয়নি এবং কাদের নির্দেশে সেই তদন্ত ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে, এই প্রশ্নও উঠেছে।

এখন ‘মিডিয়াপার্ট’-এর নতুন রিপোর্টে ফাঁস হলো মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ফরাসি পক্ষকে সহযোগিতা না করার। ফরাসি ওই ওয়েবসাইটটির পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এবারও কোনও সাড়া দেওয়া হয়নি। বহু লড়াই করে পাওয়া তথ্যের অধিকার আইনটাই যাঁর সময়ে তামাদি হতে বসেছে সেই প্রধানসেবক ভোট প্রচারে যতই দুর্নীতিমুক্ত ভারত গড়ার বুলি আওড়ান, আসলে তিনি যে কার চৌকিদার তা হয়তো দেশের মানুষ ভালোই বুঝছেন।

 

Comments :0

Login to leave a comment