RG Kar CFSL

আটতলাকে তদন্তের আওতার বাইরে কেন রাখছে সিবিআই?

রাজ্য

  সিএফএসএল’র রিপোর্টকে পরিকল্পিতভাবে কেন এড়িয়ে গেছে সিবিআই, তা নিয়ে রীতিমত শোরগোল। আর জি করের চারতলার সেমিনার রুম আদৌ ঘটনাস্থল কিনা তা নিয়ে শুধু প্রশ্ন তোলা নয়, সেখানে কোন ধস্তাধস্তির ঘটনার প্রমাণও মেলেনি বলে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবোটারির দিল্লির সদর দপ্তর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তারপরেও সিবিআই কেন এই গুরুতর পর্যবেক্ষণকে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করলো না, তা নিয়ে ধাঁধায় সংশ্লিষ্ট মহল। আরও সন্দেহ দানা বেঁধেছে সিবিআই’র তদন্ত প্রক্রিয়াতেও।
দিল্লি থেকে আসা সিএফএসএল’র আধিকারিকরা গত ১৪ আগস্ট সরেজমিনে আর জি করের চারতলার সেমিনার রুম পর্যবেক্ষণ করে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে। তারপর সরকারিভাবে রিপোর্ট দেয় সেপ্টেম্বরে। গত ১২ সেপ্টেম্বর সিবিআই’র কাছে সেই রিপোর্ট পাঠায়। তার আগে যদিও ১৪ আগস্টের পরে সরেজমিনে তদন্ত শেষে মৌখিকভাবেও চারতলার সেমিনার রুম আদৌও ‘প্লেস অব অকারেন্স’ কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তারা। 
একইসঙ্গে তদন্তের প্রাথমিক পর্বে, জেরাতেও সিবিআই’র কাছে এমন ইঙ্গিত আসে। তার ভিত্তিতে আগস্টের শেষের দিকে কয়েক দফায় আর জি করে গিয়ে চারতলার পাশাপাশি আটতলাও ঘুরে দেখে, তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে সিবিআই। 
আটতলার অর্থোপেডিক ওটির পাশের একটি রুমেও গিয়েছিল তদন্তকারী আধিকারিকরা। পরবর্তীতে সেই রুমটি সিল করে দেওয়া হয়। আটতলার অর্থোপেডিক রুমের কাজকর্ম এখনও বন্ধ আছে। কেন? 
একাধিকবার সিবিআই’র তদন্তকারীরা বেশ কয়েকবার আটতলায় যান। কিছু নমুনা সংগ্রহও করে। আটতলা থেকে লিফটে করে চারতলায় ওঠানামা করেন তদন্তকারী আধিকারিকরা, বেশ কয়েকবার। তদন্তের এই বিশেষ পর্যায়ে আটতলা কেন তদন্তকারী আধিকারিকদের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল? আটতলায় রয়েছে অর্থোপেডিকের অপারেশন থিয়েটার। আটতলা থেকে লিফটে চারতলায় সেমিনার রুমে যাওয়া যায়, সিসিটিভি’র নজর এড়িয়ে। চারতলার সেমিনার রুমের ঘটনাস্থলের সঙ্গে ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের আটতলা বা অন্য কোনও ফ্লোরের কোনও যোগসূত্র কি রয়েছে এই ঘটনাক্রমে? এই আটতলার ওটি সন্দীপ ঘোষের ওটি বলেই পরিচিত ছিল হাসপাতালে। তিনি এখানেই অপারেশন করতেন। 
সেই রাতে আর জি করের ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের চারতলার সেমিনার রুমে ঠিক কী হয়েছিল? আদৌ সব কিছু সেখানেই ঘটেছিল? সেটা কী শ্যাডো পিও (প্লেস অব অকারেন্স)? সেখান কত জন হাজির ছিল? এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে গোটা রাজ্য জুড়ে বিচারের দাবিতে পথে নামা মানুষের মধ্যে।
এর কিছুদিনের মধ্যেই সিএফএসএল’র রিপোর্টও সিবিআই’র হাতে আসে। নিজেরাও যেখানে প্রমাণ সংগ্রহে ঘুরেছে সেটা তদন্তের আওতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো কেন? 
অথচ তারপরেও এই সম্ভাবনাকে, তদন্তের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিককে কার্যত এড়িয়ে গিয়েই মাত্র একজন ব্যক্তি অপরাধে যুক্ত, কলকাতা পুলিশের এই তত্ত্বে সিলমোহর দিয়ে ৭ অক্টোবর চার্জশিটও পেশ করে দেয় সিবিআই। 
সেখানে চারতলার সেমিনার রুমের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায় ৮ আগস্ট শেষ রাতে সেমিনার রুমে ঢুকেছিল, তাপর সেখান থেকে বেরিয়েছিল একাই। এটাই চার্জশিটে দাবি করে সিবিআই। যার মোদ্দা কথা চারতলার সেমিনার রুমেই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটে। এমনকি সেখানে ধস্তাধস্তি হয় এবং বায়োলজিক্যাল তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে স্পষ্ট সঞ্জয় রায়ই অপরাধী। চার্জশিটে কার্যত উপসংহার টেনে দেয় সিবিআই।
কেন? চারতলায় সেদিন ধস্তাধস্তি হয়েছে এমন কোনও ঘটনার চিহ্ন মেলেনি বলে সিএফএসএল’র দাবি। ধর্ষণের আগে ধর্ষক ঐ পড়ুয়া চিকিৎসকের ওপর শারীরিক বল প্রয়োগ করেছিল, অত্যাচার করেছিল, ঐ পড়ুয়া চিকিৎসকও স্বাভাবিকভাবেই বাঁচার মরিয়া চেষ্টায় প্রতিরোধ করেছিলেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন উল্লেখ করে বলা হয়, ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটেছিল। অথচ সিএফএসএল’র দাবি, চারতলার সেমিনার রুমে এরকম ধস্তাধস্তি, দুজনের শারীরিক সংঘাতের কোনও চিহ্ন বা প্রমাণ মেলেনি। 
তদন্তের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এই অংশকেই কেন এড়িয়ে যেতে হলো সিবিআই-কে? আগস্টের শেষ দিক ও সেপ্টেম্বরের প্রথমে কয়েক দফায় এই সম্ভাবনায় জোর দিয়ে চারতলার পাশাপাশি আটতলায় গিয়েও তদন্ত চালালেও তার কোনও প্রতিফলন কেন চার্জশিটে দেখা গেল না? কেন সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এই পর্যবেক্ষণকে নিজেরাই এড়িয়ে গেল? 
তাহলে কী তদন্তের মাঝপথে সেপ্টেম্বরেই কোনও কারণে ব্রেক কষতে হয়েছিল সিবিআই-কে? কোন নির্দেশ ছিল তদন্তের গতি শ্লথ করার? নিজেরাই আটতলায় তদন্ত করে, একটি রুম সিল করে রাখলেও সেই সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখতে তদন্তের পরবর্তী ধাপে কেন গেল না সিবিআই? কীসের বাধা? কোথা থেকে আসছে বাধা? কোনোভাবে কী তদন্তের সঙ্গে আপস করতে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে?
ঘটনাস্থল থেকে মেলা নমুনায় ধৃত সঞ্জয় রায়ের উপস্থিতি টের পাওয়া গেলেও সে কী একাই যুক্ত ছিল? নাকি আরও কয়েকজন? সেই কয়েকজনের উপস্থিতি কি শুধু ধর্ষণের সময়, নাকি খুনের সময়েও? দেহ ঘটনাস্থলে সাজিয়ে রাখা, জুতো জোড়া পরিপাটি করে রাখা, নিহত তরুণী চিকিৎসকের হাত তাঁর মাথায় রেখে দেওয়া, এসবই একজনের কাজ? সঞ্জয় রায় ছাড়া আর কতজন ছিল? পুলিশের এফআইআরে গড়িমসি, ঘটনাস্থল কর্ডন করা, দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের সুযোগ না রেখেই তড়িঘড়ি দাহ করা এসবই সবই যদি পরিকল্পিত হয়, তবে এমন একাধিক গুরুতর ঘটনাক্রম কীভাবে সিবিআই’র প্রথম চার্জশিটের বৃত্ত থেকে বাইরে থাকলো? কোন প্রভাবশালী মহলকে আড়ালের চেষ্টা? কোন বোঝাপড়ার বিনিময়ে?
বড়দিনের উৎসবের আবহেও এই প্রশ্নই এখন রাজ্যবাসীর মনে।
 

Comments :0

Login to leave a comment