Amit Shah

দুই দিন ভোর রাতে ঘুম ভাঙিয়েছেন মোদী

জাতীয়

হিংসার ঘটনা চলছে কম করে ১০০ দিন। সংসদে মণিপুর নিয়ে অবশেষে আলোচনায় অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ২ ঘণ্টা ৪ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডের দীর্ঘ বক্তৃতা করলেন বুধবার। না, এতক্ষণ মণিপুর নিয়ে বলেননি ‘সাহেব’ এর নির্ভারযোগ্য লেফটেন্যান্ট। শুরুর ১ ঘণ্টা ১৯ মিনিট বলেছেন, মোদী সরকার দেশের জন্য কী কী করেছেন তার বিবরণ এবং বিরোধীদের আক্রমণের জন্য। তারপর ৩০ মিনিট বলেছেন মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে। মোদীর সাফল্যগাথা শোনালেও মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতিতে মোদী কী করেছেন, সেটা বলতে গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী একদিন তাঁকে রাত ৪টেয় ফোন করেছেন, পরের দিন ভোর সাড়ে ছটায় আবার ফোন করে ঘুম ভাঙিয়েছেন! এর বেশি মোদী কিছু করেছেন বলে ২ ঘণ্টার বেশি বক্তৃতায় কিছু বলতে পারেননি অমিত শাহ-ও। 
মণিপুর নিয়ে মৌন মোদীর মুখ খোলাতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে। সংসদের বাদল অধিবেশনের শেষ পর্বে সেই আলোচনায় রাজি হয়েছে সরকার। আলোচনায় সরকার পক্ষের বক্তব্যে মণিপুর কম, ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ নিয়েই চর্চা এবং আক্রমণ বেশি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও এদিন তার বাইরে যাননি। আগে-পরে মিলিয়ে ২ ঘণ্টার বেশি বক্তৃতার দেড় ঘণ্টা কাটিয়েছেন এইসব করেই। তবে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের ঠেলায় বিজেপি’র ‘লৌহপুরুষ’ এর গলা এদিন ম্রিয়মানই লেগেছে। সবথেকে আকর্ষণীয় ছিল সরকারের সাফল্যের হিসাব দেওয়ার সময়ে তিনি বিজেপি’র বদলে বার বার এনডিএ বলছিলেন। গুজরাট গণহত্যার অন্যতম অভিযুক্তের মুখে এদিন শোনা গেছে- ‘হিংসা কোনও সমস্যার সমাধান নয়। আলোচনাই পথ’, এমন শব্দ বন্ধনীও। 
দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মণিপুর নিয়ে আলোচনার সময়ে বলেছেন, মায়ানমারে ২০২১ সালে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সেখানে এখন গণতান্ত্রিক সরকার নেই। সেনা সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মায়ানমারে  কুকি ডেমোক্র্যটিক ফ্রন্ট আছে। যারা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। তাদের দমন করতে মায়ানমারের সেনা সরকার কুকিদের উপর দমনপীড়ন শুরু করে। যেহেতু ভারতের সঙ্গে মায়ানমার  সীমান্তে বেড়া নেই, তাই মণিপুর এবং মিজোরামে মায়ানমার থেকে বিরাট সংখ্যায় কুকি শরণার্থীরা ঢুকতে থাকে। হাজার হাজার কুকি আদিবাসী আসতে থাকে। তারা জঙ্গলে বসতি তৈরি করতে থাকে। এরফলে মণিপুরের বাকি অংশে অসুরক্ষার ভাবনা তৈরি হয়। জনবিন্যাস বদলে যাবে বলে আতঙ্ক তৈরি হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এদিন বারে বারে মেইতেইদের অসুরক্ষার মনোভাবকে মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁর বক্তৃতায়। বার্মায় সেনা শাসনের কারণে মাদক পাচারও মণিপুরে বেড়ে গেছে বলে দাবি করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। যদিও বক্তৃতার শুরুতে ইউপিএ সরকারের সময় থেকে মোদী সরকারের সময়ে কত বেশি মাদক বাজেয়াপ্ত হয়েছে সেই হিসেব দিয়েছিলেন ‘সাফল্য’ বোঝাতে।
এরপরে অমিত শাহ গুজব ছড়ানোর প্রসঙ্গ টানেন। ২৯ এপ্রিল রটে যায় সরকার ৫৮ কুকি শরণার্থী শিবিরকে ফরেস্ট ভিলেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এটা গুজব ছিল বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী দাবি করেছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, গুজব যখন ছড়ায় তখন এভাবেই ছড়ায়। অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়। এরফলে সমতলে মেইতেইদের মধ্যে অশান্তি ছড়িয়ে পরে। এরপরে হিংসার জন্য কার্যত মণিপুর হাইকোর্টকে দায়ি করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। তিনি বলেছেন, বহু বছর ধরে বিচারাধীন একটি বিষয় নিয়ে হঠাৎ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দেয় হাইকোর্ট। মেইতেইদের আদিবাসী বলে ঘোষণার কথা বলে। এই বিষয়ে হাইকোর্ট নাকি ভারত সরকারের কোনও মন্ত্রক এবং মণিপুর সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি। এই ঘটনায় পাহাড়ে কুকিদের মধ্যে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। মেইতেইরা আদিবাসী হলে তাদের চাকরি ইত্যাদি সঙ্কটে পড়বে। ফলে তাদের উদ্বেগ স্বাভাবিক। এরফলে পাহাড়-সমতল সংঘর্ষ হয়। তারপরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, যা আজও অব্যাহত আছে বলে স্বীকার করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। 
প্রধানমন্ত্রী কেন মণিপুর যাচ্ছেন না, বিরোধীদের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অমিত শাহকে হাতড়াতে হয়েছে নরসিমা রাও থেকে গুজরাল হয়ে মনমোহন সিং সরকারের রেকর্ড। তখন কত জাতি দাঙ্গা হয়েছে, কত লোক মরেছে, কোনও আলোচনা হয়নি, কোনও নেতা মন্ত্রী যাননি, কোনও জবাব দেওয়া হয়নি। তিনিই প্রথম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তিন দিন থেকেছেন। তারপর সংযোজন করে বলেছেন তিন রাতও থেকেছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায় ২৩ দিন থেকেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৭ ঘণ্টা কাজ করেন। একদিনও ছুটি নেননি। এমন প্রধানমন্ত্রী দেশে আর হয়নি বলে দাবি করেন শাহ। এই সময়েই তিনি জানান, মোদী দুই দিন তাঁকে ভোর রাতে ফোন করে ঘুম ভাঙিয়েছেন। মণিপুর নিয়ে মোদী এছাড়া কিছু করেছেন বলে অমিত শাহ সংসদে জানাননি। 
জওহরলাল নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী সরকারের সময়ের দাঙ্গার হিসাব দিতে শুরু করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। পালটা বিরোধী বেঞ্চ থেকে ‘গুজরাট গুজরাট’ আওয়াজ শুরু হলে মেজাজ হারান অমিত শাহ। চিৎকার করে বলেন, আমাদের কেউ মণিপুরের ঘটনায় যুক্ত নয়। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে হিসাব আছে কোনও কোনও নেতা যুক্ত। নাম বলবো তাদের? হুঁশিয়ারি দেন কয়েকবার। পালটা বিরোধী বেঞ্চ থেকে ‘বলুন বলুন’ আওয়াজ শুরু হয়। যদিও সে পথে যাননি শাহ। 
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী দাবি করেন, তাদের সরকার হিংসা কমিয়ে এনেছে। বিরোধীরা হিংসার আগুনে ঘি ঢালছে বলেও অভিযোগ করেন। রাহুল গান্ধীর নাম করে অভিযোগ করেন অমিত শাহ। এইসঙ্গে এমনও দাবি করেন, বিজেপি কোনোদিন জাতি দাঙ্গা নিয়ে রাজনীতি করেনি! এরপরে তিনি মহিলাদের বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনাকে সমাজের কলঙ্ক বলে নিন্দা করেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ভিডিও কেন সংসদের অধিবেশনের আগের দিন ভাইরাল করা হয়েছে সেই দিকেই মূল আলোচনা নিয়ে যেতে চান। এরপর বিরোধীদের প্রশ্নের মুখে জানান, ৪ তারিখের ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দিলে ৫ তারিখেই সবাই গ্রেপ্তার হয়ে যেত। যেদিন ভাইরাল হয়েছে, তারপর সবাই গ্রেপ্তার হয়েছে। বিরোধী বেঞ্চ থেকে আওয়াজ ওঠে ভিডিও সামনে আসার পরে আপনারা জানতে পারলেন এমন ঘটনা ঘটেছে? আপনার পুলিশ, গোয়ান্দা দপ্তর কী করছিল? এইসব প্রশ্নের কোনো যুৎসই জবাব দিতে পারেননি শাহ। বক্তৃতার শেষে মণিপুর নিয়ে সর্বসম্মত শান্তি প্রস্তাবের কথাও বলেন শাহ। তারপর এদিনের মতো অধিবেশন মুলতুবি হয়ে যায়।

Comments :0

Login to leave a comment