Anubrata mondal

সরকারি প্রকল্প থেকে দেদার তোলা তুলেছেন অনুব্রত

রাজ্য

গোরু পাচারের টাকা সাদা করতে প্রকৃত বিজেতার কাছ থেকে লটারির টিকিট ছিনিয়ে নেওয়া, ঘনিষ্ঠজন এমনকি সাধারণ তৃণমূল কর্মী, গাড়ির চালক, দিনমজুরদের নামেও ব্যাঙ্কে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে গোরু পাচারের টাকা লেনদেন— মানি লন্ডারিংয়ের অভিনব সব কৌশল নিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জির স্নেহধন্য অনুব্রত মণ্ডল। 
গোরু পাচার কাণ্ডে ইডি’র চার্জশিট যেন শাসক তৃণমূলের আয়না! শুধু গোরু পাচারই নয়, জেলা পরিষদ থেকে পৌরসভা, সরকারি সব প্রকল্পে কাজ পেতে গেলেও কীভাবে অনুব্রত মণ্ডলকে কমিশন দিতে হতো সেই বয়ানও উঠে এসেছে ২০৪ পাতার এই চার্জশিটে।
গোরু পাচারের বিপুল টাকার ‘মানি রুটের’র হদিশ পেতেই একাধিক ব্যক্তিকে ইডি জেরা করেছিল। সে তালিকায় ছিলেন এক ঠিকাদারও। গত বছরের ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর তাঁকে জেরা করেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী আধিকারিকরা।
জেরাতেই অনুব্রত ঘনিষ্ঠ সেই ঠিকাদারে বয়ান ও একাধিক তথ্য প্রমাণে ইডি জানতে পারে সরকারি যে কোনও ঠিকাদারি কাজে, নির্মাণ প্রকল্পে অনুব্রত মণ্ডলকে দিতে হতো টাকা। অনুব্রত মণ্ডলকে কাজ শুরুর আগেই কমিশন দিতে না পারলে মিলতো না কাজের বরাত। ১ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত এই তোলা দিতে হতো সরকারি যে কোনও প্রকল্পের বরাত পেতে হলে। সে টাকা অনুব্রত মণ্ডলের হয়ে তুলতো সায়গল হোসেন। সায়গল হোসেনের হাতেই সেই কমিশনের নগদ টাকা দিতে হতো। সরকারি কাজের বরাত পেতে হলে  ৫ শতাংশ কমিশনের অর্থ আগে দিতে হবে অনুব্রত- এমন শর্তেই কাজ করতে হতো ঠিকাদারদের।
অনুব্রত ঘনিষ্ঠ ঐ ঠিকাদারের বয়ান উল্লেখ করেই ইডি চার্জশিটে জানিয়েছে যে, এমনকি ঠিকাদারদের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেও কালো টাকা সাদা করতেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি। জেরায় এক ঠিকাদার জানিয়েছেন ২০১৯-২০ সালে অর্থাৎ লকডাউনের সময় অনুব্রত মণ্ডল ঐ ঠিকাদারকে কয়েক দফায় ৯০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা নগদ দিয়েছিলেন। তারপর অনুব্রতের নির্দেশেই সেই সমপরিমাণ টাকাই অনুব্রতরই দেওয়া বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হয়েছিলে, আরটিজিএস করেও টাকা দিতে হয়েছিল। অর্থাৎ  গোরু পাচারের নগদ এক কোটি টাকা ঠিকাদারকে দিয়ে, তারপর সেই টাকা তাঁরই চালকল, সংস্থার অ্যাকাউন্টের জমা করানো— একেবারে পরিকল্পিতভাবে চলেছিল অপারেশন। পরিবারের হিসাবরক্ষক মণীশ কোঠারিই মূলত অনুব্রত এবং সকুন্যার হয়ে এই আর্থিক লেনদেন দেখতেন। চার্জশিটে উল্লেখ করা  হয়েছে, বোলপুরের ঐ ঠিকাদার জেরায় জানিয়েছিলেন অনুব্রত মণ্ডল সায়গলের মাধ্যমে যে নগদ টাকা পাঠিয়েছিলেন তা এরপর অনুব্রতর নির্দেশেই তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের নামে যে রাইসমিল রয়েছে সেই ভোলে ব্যোমের অ্যাকাউন্টে আরটিজএস করে দিতে রাজি হয়েছিলেন। ভোলেব্যোম রাইসমিলের অ্যাকাউন্টে টাকাও পাঠাতে হয়েছিল। সরকারি কাজের বরাত পাওয়ার পরে দফায় দফায় যখন তখন অনুব্রত মণ্ডল তাঁর দেহরক্ষী সায়গল হোসেনের মাধ্যমে টাকা চেয়ে পাঠাতেন। 
অনুব্রত মণ্ডলের আরও এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, যিনি আবার অনুব্রতর চালকলের ব্যবসাও দেখভাল করতেন, তিনিও জেরায় অনুব্রত মণ্ডলের তোলাবাজির অভিযোগকেই বৈধতা দিয়েছেন। ইডি’র চার্জশিটে সে প্রসঙ্গ উল্লেখ রয়েছে, তাতে ঐ ব্যক্তি ইডি’র জেরায় জানিয়েছিলেন জেলা পরিষদ থেকেও কমিশন নিতেন অনুব্রত মণ্ডল। সায়গল হোসেন তাঁর হয়ে টাকা তুলতেন। সায়গল হোসেনকে টপকে অনুব্রতর সঙ্গে যোগাযোগ করা যেত না, ঐ বিপুল পরিমাণ টাকা তোলা, ব্যবস্থা করা সবকিছু অনুব্রতর হয়ে করতো এই পুলিশ কর্মী সায়গল হোসেন। আগে ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হতো তারপরে অনুব্রত মণ্ডল।
ফলে গোরু পাচারের তদন্তে অনুব্রতের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির হদিশ পেতেই উঠে আসে এই তোলাবাজির অভিযোগ। জেলা পরিষদ থেকে পৌরসভা, সব জায়গা থেকেই মাসে মাসে দফায় দফায় কমিশন সায়গলের মাধ্যমে পৌঁছে দিত হতো মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে ‘বীর’ বিশেষণ পাওয়া অনুব্রত মণ্ডলকে।
তবে শুধু অনুব্রত মণ্ডল, গোরু পাচারের তদন্তে নেমে ইডি নিশ্চিত হয়েছে অনুব্রত কন্যা সুকন্যা মণ্ডলও সরাসরি মানি লন্ডারিংয়ে যুক্ত। চার্জশিটে মণীশ কোঠারি থেকে সুকন্যার সংস্থার ডিরেক্টর, অনুব্রতর বাড়ির পরিচারক বিদ্যুৎ বরণ গায়েনের বয়ানেই তা স্পষ্ট। তিহার জেলেই বন্দি অনুব্রতর পরিবারের হিসাবরক্ষক মণীশ কোঠারি জেরায় ইডি-কে জানিয়েছেন অনুব্রত পরিবারের, তাঁদের একাধিক চালকল থেকে সুকন্যার দুটি সংস্থা, সব কিছুর ব্যাঙ্কের হিসাব, আর্থিক লেনদেন সুকন্যার নির্দেশেই তিনি করতেন। সুকন্যা মণ্ডলই আর্থিক লেনদেনের সব কিছুই নির্দেশ দিতেন। এমনি ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের সব নথি সুকন্যাই দিতেন তাঁকে। প্রতিদিনকার ব্যবসা, লেনদেনও সুকন্যাই দেখতেন। এমনকি অনুব্রতর বাড়ির পরিচারক বিদ্যুৎ বরণ গায়েনের আইটি ফাইলও দেখতেন সুকন্যা মণ্ডলই, তাঁর ইমেল আইডি রয়েছে। বাড়ির পরিচারক থেকে গাড়ির চালকও ইনকাম ট্যাক্স ফাইল করতেন। কারণ তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কয়লা কালো টাকা ঢোকাতেন বাবা-মেয়ে। যদিও সুকন্যা মণ্ডল ইডি’র জেরায় সব প্রশ্নের দুটি উত্তর দিয়েছেন— আমি এসব কিছুই জানি না এবং বাবা জানে, মণীশ কোঠারি সব দেখতেন। 
গত ৮ মার্চ আসানসোল জেল থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লিতে ইডি নিয়ে আসার সময় যেভাবে পুলিশি মদতে অনুব্রত মণ্ডলকে শক্তিগড়ে একটি ল্যাংচার দোকানে তাঁর দলীয় বাহিনীর সঙ্গে সলা পরামর্শের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল তা নিয়ে ক্ষুব্ধ ইডি। চার্জশিটেও রয়েছে সেই প্রসঙ্গে। সুকন্যা মণ্ডলের গাড়ির চালক তুফান মণ্ডল সেদিন শক্তিগড়ের দোকানে সুকন্যার নির্দেশেই অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেদিন তাঁর সঙ্গে ছিল আরেক তৃণমূল নেতা কৃপাময় ঘোষ। অনুব্রত মণ্ডলকে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার পথে শক্তিগড়ের নির্দিষ্ট কোনও দোকানে গাড়ি দাঁড় করানো হবো, কটার সময় দাঁড় করানো হবে তা আসানসোল জেলের এক আধিকারিকের কাছ থেকে জেনেছিলেন কৃপাময় ঘোষ। শুধু তাই নয় চার্জশিটে ইডি’র দাবি গাড়িচালক তুফান মণ্ডলকে দুটি মোবাইল কিনে দিয়েছিলেন সুকন্যা মণ্ডল, গাড়ি চালকের সেই মোবাইলেই মূলত কথা বলতেন সুকন্যা মণ্ডল।

Comments :0

Login to leave a comment