Adani G20

নতুন বাণিজ্য করিডরেও আদানিরাই

জাতীয় আন্তর্জাতিক

জি-২০ বৈঠক চলাকালীন ঘোষিত হয়েছে ভারত- মধ্য প্রাচ্য- ইউরোপের নতুন অর্থনৈতিক করিডর। এই করিডরে ভারত থেকে সমুদ্রপথ ও রেলপথে ইউরোপে পণ্য চলাচল করবে। ভারত, ইজরায়েল, সংযুক্ত আরব আমীরশাহী ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে আলোচনার ফসল এই নতুন করিডরকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ‘পালটা’ হিসাবে দেখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। 

স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের প্রসঙ্গ ছাড়াও এই করিডরে লাভবান হতে চলেছে ভারতের আদানি গোষ্ঠী। তাদের স্বার্থ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এই করিডরে। জি-২০ বৈঠকের সময়েও আদানিরা তাদের মুনাফার ব্যবস্থা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। 

প্রস্তাবিত এই করিডরে ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে পণ্যবাহী জাহাজ যাবে সংযুক্ত আরব আমীরশাহী পর্যন্ত। সেখানের রেললাইনে পণ্য খালাস করা হবে। সংযুক্ত আরব আমীরশাহী থেকে সৌদি আরব, জর্ডন হয়ে ইজরায়েল পর্যন্ত রেললাইন পাতার কাজ চলছে। এই লাইন শেষ হবে ইজরায়েলের হাইফা বন্দরে। তেল আভিভ থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে হাইফা বন্দর ইতিমধ্যেই কিনে নিয়েছেন আদানিরা। এ বছরের জানুয়ারিতে ১২০০কোটি ডলারে হাইফা বন্দর কিনেছে আদানি পোর্টস। এখানেই শেষ নয়। হাইফায় পণ্য ফের উঠবে জাহাজে। যাবে গ্রিসের পিরাইউস বন্দরে। এই বন্দরটি কেনার জন্যও আদানি গোষ্ঠী সক্রিয়। গত ২৫ আগস্টে গ্রিসে একদিনের সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অন্য প্রসঙ্গের বদলে পিরাইউস বন্দর কেনার ব্যাপারেই তিনি তৎপরতা দেখিয়েছেন বলে সে-দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ৪০ বছরের মধ্যে এই প্রথম ভারতের প্রধানমন্ত্রী গ্রিসে গিয়েছিলেন শুধু এই বন্দরটি আদানিদের হাতে দেবার বিষয়ে সে দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলতে। তখনই মোদী বলেছিলেন, ‘গ্রিস হতে চলেছে ভারতের কাছে ইউরোপের প্রবেশদ্বার’। ভারতের পশ্চিম উপকূলে গুজরাটের মুন্দ্রা বন্দর, মুম্বাই বন্দর আদানিদের হাতে। অর্থাৎ গ্রিসের বন্দর কেনার কাজ সফল হলে এই করিডরের তিনটি সূত্রই চলে যাবে আদানিদের হাতে। 

এই নতুন করিডরের প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ‘আগামী দিনে এই করিডর হতে চলেছে ভারত, মধ্য প্রাচ্য, ও ইউরোপের অর্থনৈতিক সংহতির কার্যকরী পথ’। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেয়েন বলেছেন ‘ঐতিহাসিক’। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন বলেছেন, ‘এটি বড় ব্যাপার, সত্যিই বড় ব্যাপার’। করিডরের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে ইজরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমীরশাহী এবং সৌদি আরবের দুটি শান্তি চুক্তি। 

এই করিডরের গুরুত্ব বোঝাতে বলা হচ্ছে, এখন ভারত থেকে পণ্যবাহী জাহাজকে মিশরের সুয়েজ খালে পৌঁছাতে ৩ হাজার নটিক্যাল মাইল পেরোতে হয়। নতুন করিডরে ১০ দিনে ভারত থেকে ইউরোপে পণ্য পৌঁছে যাবে। সমুদ্রপথ ও রেললাইন ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমীরশাহী ইজরায়েল পর্যন্ত সড়কপথেও পণ্য যাতায়াতের অনুমতি দিলে তা আরও সহজ হবে। 

এই সমগ্র করিডরের মূল ভরকেন্দ্রে থাকছে হাইফা। ইজরায়েলের উত্তর প্রান্তের এই বন্দর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর। আদানিরা হাইফা বন্দর কিনেছে স্থানীয় একটি লজিস্টিক গোষ্ঠী গ্যাডলটের সঙ্গে। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু স্বয়ং গৌতম আদানির হাতে চুক্তিপত্র তুলে দিয়েছিলেন। ‌আদানি তখন মন্তব্য করেছিলেন, এই বন্দর কেনার সঙ্গে সঙ্গে রিয়েল এস্টেটের বড় সম্ভাবনাও খুলে যাচ্ছে। হাইফার চারপাশ বদলে দেব আমরা। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইজরায়েল সফরের সময়েই হাইফা হস্তান্তরের কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়। শুধু তাই নয়, ইজরায়েল-ভারত প্রতিরক্ষা বাণিজ্যে বরাত পায় এই বিষয়ে কোনও অভিজ্ঞতা না থাকা আদানিরাই। 

এই নতুন করিডরের পরিকল্পনার পিছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। আই২ইউ২ ফোরাম (ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমীরশাহী, ইজরায়েল) বেশ কিছুদিন ধরেই এই নতুন করিডরের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। মার্কিন তৎপরতার মুখ্য কারণ এই অঞ্চলে চীনেরও উপস্থিতি রয়েছে। তা হ্রাস করার জন্য ভারতকে ব্যবহার করা। 

আগস্টের শেষ সপ্তাহে ব্রিকসের বৈঠক থেকে নরেন্দ্র মোদী গিয়েছিলেন গ্রিসে। ভারত এবং গ্রিসের বাণিজ্য গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এবং সরকারি অফিসাররা বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু মোদীর মুখ্য আলোচনা ছিল গ্রিস কীভাবে ইউরোপে ভারতের প্রধান ট্রানজিট হাব হয়ে উঠতে পারে। গ্রিসের সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে, গ্রিসের বন্দর ব্যবহারের জন্য মোদী বারংবার জোর দেন। বাণিজ্যিকভাবে বন্দর ব্যবহারের অধিকারের জন্য বন্দর কিনতে চাইছেন আদানিরা। ইতিমধ্যেই আদানিদের আলোচনার মধ্যে রয়েছে পিরাইউস, কাভালা ও ভোলাস বন্দর। পিরাইউস হবে নতুন করিডরের শেষ প্রান্ত। উত্তর গ্রিসের কাভালাও এখনই বাণিজ্যিকভাবে কিনতে চাইছেন আদানিরা। আলেক্সান্দ্রৌপোলিতেও আদানি গোষ্ঠী আগ্রহী। গ্রিসে তেমন কোনও আনুষ্ঠানিক বা সরকারি অনুষ্ঠান করেননি মোদী। সরাসরি বাণিজ্যিক বিষয়েই আলোচনা করেন তিনি এবং তাঁর সঙ্গে যাওয়া ভারতের বাণিজ্য প্রতিনিধিরা। গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোতাকিসের সঙ্গে আলোচনায় বন্দর নিয়েই কথা বলেছেন মোদী। বন্দর নিয়ে কথা বলে আদানিদের কাজ সহজ করে দিয়েছেন মোদী। 

এখন করিডরের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হবার পরে বোঝাই যাচ্ছে, পূর্ব পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছে ভারত সরকার এবং আদানি গোষ্ঠী।

Comments :0

Login to leave a comment