Tea Bonus

চা বাগানের জমি লুটের ছকেই কি একতরফা বোনাস-ঘোষণা রাজ্যের?

রাজ্য

চা বাগানের বিপুল জমি নিরাপদে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতেই কি রাজ্য সরকার একতরফাভাবে ২০ শতাংশ হারে বোনাসের নির্দেশিকা জারি করেছে?
এরাজ্যে এবারই প্রথম নজিরবিহীনভাবে পাহাড়, তরাই ও ডুয়ার্সের সব চা বাগানে ২০ শতাংশ হারে বোনাস দেওয়ার নির্দেশিকা জারি করেছে রাজ্যের শ্রম দপ্তর। গত ২২ সেপ্টেম্বর শ্রম দপ্তরের নির্দেশিকায় সই করেছে বাগান মালিকদের একাধিক সংগঠন। চা বাগানের ব্যাপারে বরাবরের ঐতিহ্য হচ্ছে, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ও মালিক সংগঠনের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে বোনাসের প্রশ্নে নিষ্পত্তি হয়েছে। এ নিয়ে উভয় পক্ষের একাধিক সভা হয়। বোনাসের হার নিয়ে মতবিরোধে মালিকদের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নের একাধিক সভা ভেস্তেও যায়। শেষপর্যন্ত দু’তরফের পক্ষ থেকেই বোনাসের নিষ্পত্তি হয়ে যায়।
গত আর্থিক বছরে এরাজ্যের চা বাগানে বোনাস নিয়ে একাধিকবার মালিক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল ট্রেড ইউনিয়নের। শেষপর্যন্ত তরাই ও ডুয়ার্সে ১৬ শতাংশের বেশি বোনাস দিতে রাজি হননি মালিকরা। তা নিয়ে চা শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। পাহাড়ে চা বাগানে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে পড়তে হয়েছিল প্রশাসনকে। কিন্তু এবার দ্বিপাক্ষিক আলোচনার আগেই বোনাস নিয়ে রাজ্যের শ্রম দপ্তর অ্যাডভাইসরি জারি করে জানিয়ে দেয়, ২০ শতাংশ হারে বোনাস মিলবে। সেই অ্যাডভাইসরিতে স্বাক্ষর করে চা বাগান মালিকদের সংগঠনও। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, ২০ শতাংশ বোনাসের নির্দেশিকা জারি করার পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়ন ও মালিক সংগঠনের কাছে চা বাগানে যাতে শান্তি, সম্প্রীতি বিঘ্নিত না হয় তা নিশ্চিত করার কথা বলেছে রাজ্য সরকার।
আর এখানেই প্রশ্ন, রাজ্য সরকার কেন আগ বাড়িয়ে বাগান মালিকদের একাংশের সাহায্য নিয়ে একতরফাভাবে ২০ শতাংশ বোনাসের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দিল? পাহাড়, তরাই ও ডুয়ার্স মিলিয়ে রাজ্যের প্রায় ২৯০টির কাছাকাছি চা বাগানের মধ্যে সকলের আর্থিক পরিস্থিতি একরকম নয়। তার পরেও একতরফাভাবে ২০ শতাংশ বোনাস অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাগানের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে বিস্মিত বাগান শ্রমিকরাও। 
তাই প্রশ্ন উঠেছে, কেন একতরফাভাবে সরকার এই নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিতে গেল? আসলে গত ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় রাজ্যের বিজনেস সামিট অনুষ্ঠানে চা বাগানের জমিকে হোটেল ও পর্যটন শিল্পের জন্য ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন মমতা ব্যানার্জি। শিল্পপতি সভায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল, ‘‘জমি এখন সহজলভ্য। চা বাগানে হোটেল সহ পর্যটন শিল্পের জন্য আমরা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত জমি দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।’’ ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞপ্তি জারি করে চা বাগানে ১৫ শতাংশ জমিকে পর্যটন শিল্পের নাম করে তুলে দিয়েছিল রাজ্য সরকার। আর বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে আরও ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ জমি পর্যটন শিল্পের জন্য ছাড় দেওয়ার ঘোষণা করেন মমতা ব্যানার্জি। মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর চা বলয়ে শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সরকার সাময়িক পিছু হটে। কিন্তু সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হয়নি। 
রাজ্যের চা শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ও সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল আলমের বক্তব্য, ‘‘রাজ্য সরকার চা বাগানের ৩০ শতাংশ জমি কর্পোরেটের জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছে। বিশেষ করে পাহাড়ের চা বাগানে আন্তর্জাতিক কর্পোরেট সংস্থা জমি পেতে আগ্রহী। হোটেল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে বিনিয়োগ করতে তারা এগিয়ে আসছে।’’ ফলে কর্পোরেটের হাতে চা বাগানের জমি তুলে দিতে হলে শিল্প বিরোধকে যথাসম্ভব নিস্ক্রিয় রাখাই সরকারের পরিকল্পনা। ২০ শতাংশ বোনাসের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বাগানে শ্রমিকদের কাছে সরকার দরদি সাজতে চাইছে। আর এই কাজে পাহাড়ের চা বাগান মালিকদের পাশে পেয়েছে রাজ্য সরকার।
তার অন্যতম কারণ, গত জুলাই মাসে ব্রিটেনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য চুক্তির ফলে এরাজ্যের বিশেষ করে পাহাড়ের দার্জিলিঙ চায়ের রপ্তানির সুযোগ বাড়ার বিপুল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আর অবধারিতভাবে পাহাড়ের চা বাগানের ‘দার্জিলিঙ চা’ রপ্তানির সুযোগ সামনে এসেছে। তাই রাজ্য সরকারের ২০ শতাংশ বোনাসের নির্দেশিকায় পাহাড়ে চা বাগান মালিক সংগঠনের কাছ থেকে সম্মতি নিয়েই সরকার এগিয়েছে।
চা বাগান সূত্রের খবর, চায়ের গুণগত মান বজায় রাখার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি নির্ভর। আগস্ট থেকে অক্টোবর-এই তিন মাস সর্বোচ্চহারে পাতা তোলার কাজ চলে বাগানে। সেই সময় বোনাসের দাবি নিয়ে শ্রমিকদের বিক্ষোভ সভা হলে উৎপাদনের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। কারণ, চা বাগানের অতীত ঐতিহ্যই হচ্ছে, বাগান মালিক সংগঠনের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নের বোনাস ফয়সালার সভাতে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে তা গেটসভা করে শ্রমিকদের জানাতে হয়। এই রীতি মেনে চলে চা বাগানের শ্রমিক আন্দোলন। ফলে যত সময় নেবে বোনাস ফয়সালার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, সেই সময় মেনে বাগানের শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের কাছ থেকে জানবে আলোচনার বিষয়বস্তু। একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে পাহাড়ের চা বাগান মালিকদের প্রভাব ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু তরাই ও ডুয়ার্সে বাগানের পরিস্থিতি বিদেশে রপ্তানির জায়গায় নেই। ফলে তাদের পক্ষে ২০ শতাংশ বোনাস দেওয়া কার্যত চাপের। ফলে সরকারের একতরফা নির্দেশে ইতিমধ্যেই ডুয়ার্সের ৪ টি বাগান বন্ধ হয়েছে। বেশ কিছু বাগান একলপ্তে ২০ শতাংশের পরিবর্তে এখন ১০ শতাংশ ও পরবর্তীকালে ৫ শতাংশ করে বকেয়া বোনাস দেওয়ার কথা বলতে বাধ্য হয়েছে। এরাজ্যের চা বাগানের ইতিহাসে এই ঘটনাও নজিরবিহীন। 
মুখ্যমন্ত্রী চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে জলপাইগুড়ি সরকারি সভা থেকে চা বাগানের ২০ শতাংশ বোনাসের সিদ্ধান্ত জানান। বোনাস নিয়ে বাগান মালিকরা কী অবস্থা নিচ্ছে তা ঠিক করার জন্য মুখ্যসচিবকে নজরদারি করার নির্দেশ দেন। কিন্তু বোনাস নিয়ে সরকারের একতরফা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে ডুয়ার্সের বাগান মালিকদের একাংশ। তাতে সরকারের নির্দেশিকাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আগামী ১০ অক্টোবর সভা ডেকেছে শ্রম দপ্তর।
 

Comments :0

Login to leave a comment