মনোজ আচার্য: কলকাতা
বছর দুই আগের কেন্দ্রের এক শিল্প সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে এরাজ্যে কারখানার সংখ্যা ১০ হাজারেরও কম। যেখানে তামিলনাড়ুতে এই সংখ্যা ৩৮ হাজারের মতো। এছাড়াও ওই রিপোর্ট অনুযায়ী কর্ণাটক থেকে অন্ধ্র প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ থেকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা— প্রায় সমস্ত রাজ্যেই কলকারখানার সংখ্যা এরাজ্যের থেকে বেশি। মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই শিল্প গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বছর বছর। রকমারি আয়োজনে দেদার খরচ করে শিল্প সম্মেলনও হচ্ছে প্রতি বছর। এই নিয়ে সাতবার। কিন্তু এই দশ বছরে রাজ্যে নতুন সাতটা শিল্পও গড়ে ওঠেনি! উপরন্তু চালু লাভজনক শিল্প কলকারখানা বন্ধের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েই চলেছে। শুধু কলকাতাতেই বন্ধ হয়েছে ২০টির বেশি শিল্প।
তৃণমূল সরকারে আসীন হওয়ার চার বছরের মাথায় বন্ধ হয়েছে দক্ষিণ কলকাতার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইস্টার্ন ডিস্টিলারি থেকে বিকো লরির দু’টি ইউনিট। বন্ধ হয়েছে অ্যান্ড্রু ইউল’র দু’টি ইউনিট, বেহালার এমসি মৌজি কারখানা, এমসন ফার্মাসিউটিক্যাল, জোকার ইউনিভার্সাল ইলেকট্রনিক্স কারখানা, ইএমসি’র মতো ঐতিহ্যবাহী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি। এমনকি, বেঙ্গল কেমিক্যালসের মতো প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে।
তারাতলা হাইড রোড এলাকা, যেখানে নানা ধরনের কল-কারখানার সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়, সেখানেও এক এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একাধিক সংস্থা। অনেকগুলি ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়েছে। যেগুলো চালু আছে সেগুলিও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, শ্রমিক কর্মীদের সমস্যা মেটানোর কোনও উদ্যোগ নেই। বন্ধ কল-কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের অভিযোগ, কারখানার জায়গাগুলি জমি হাঙরদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। কারখানার মালিকের সঙ্গে তৃণমূলের নেতাদের যোগসাজশের কারণেই বন্ধ হচ্ছে কারখানাগুলো। কলকারখানা বন্ধে কাজ হারিয়েছেন কয়েক’শ মানুষ। কাজ হারানোদের তালিকা ক্রমশ বাড়ছে।
শুধু চালু কল-কারখানাই নয়, মহানগরের পোস্তা, বড়বাজার, চিৎপুর, কসবা সহ শিল্পতালুকগুলির অবস্থাও খারাপ। অনলাইনে বেচা-কেনা, কর্পোরেট, বহুজাতিক সংস্থার দাপটে এসব এলাকায় ব্যবসার পরিসর ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে বলেই জানাচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে মুটে, মজুররা। ব্যবসায়ীদের কথায়, ২০১১ সালের আগে পর্যন্ত যে লেনদেন ছিল তা তলানিতে ঠেকছে। এমন দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যেই মমতা ব্যানার্জি আবার কোষাগারের বিপুল টাকা খরচ করে দেশ-বিদেশের পুঁজিপতি, শিল্পপতিদের এনে ২১-২২ নভেম্বর বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে জমকালো শিল্প সম্মেলন করতে চলেছেন।
এদিকে তৃণমূলের এই শিল্প সম্মেলন নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠছে গত ৬টি শিল্প সম্মেলনের সারবত্তা কী? কটা নতুন শিল্প, কারখানা গড়ে উঠেছে? এই দশ বছরে রাজ্যে শিল্প বিনিয়োগের সঠিক পরিসংখ্যান কত? তাছাড়া ক্ষমতায় আসার পর মমতা ব্যনার্জি শিল্প স্থাপনের জন্য জেলায় জেলায় যে শিলান্যাস করেছেন সে সবের বর্তমান অবস্থা কী? শিল্প সম্মেলন নিয়ে মমতা ব্যানার্জির পেল্লাই পেল্লাই হোর্ডিং, বিপুল খরচের বিজ্ঞাপনের বহর নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সিঙ্গুর, শালবনী, নয়াচরের শিল্পস্থাপনের বিরোধিতা করে মমতা ব্যানার্জি এরাজ্যের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন সেই তিনিই শিল্প সম্মেলনের নামে কার্যত ভাঁওতাবাজি করছেন বলেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন রাজ্যের ছাত্র-যুবরা। বিগত ৬টি শিল্প সম্মেলন, ‘বিজিবিএস’র জমকালো প্রচারেও রাজ্যে শিল্পের দেখা মেলেনি। তবে কি আবারও লোকসভা ভোটের আগে ভাঁওতাবাজির অভিসন্ধি এঁটে বিপুল সরকারি খরচে ভূরিভোজ আর মমতা ব্যানার্জির আত্মপ্রচার সর্বস্ব এই শিল্প সম্মেলন? জোরালো হচ্ছে এ প্রশ্ন।
Comments :0