Recruitment scam

অভিষেকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত শুরু ইডি’র

রাজ্য

শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে এবার মুখ্যমন্ত্রীর পারিবারিক সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের ৮টি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডাইরক্টরেট। বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তির পরিমাণ সাড়ে সাত কোটি টাকা!
শুধু তাই নয়, মঙ্গলবার ইডি’র পাশাপাশি সিবিআই’র রিপোর্টে এই নিয়োগ দুর্নীতির ভয়াবহ চেহারা তুলে ধরে দাবি করা হয়েছে সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে ওএমআর শিট জালিয়াতির করার জন্য সরকার একটি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট ফার্মকে কোনও টেন্ডার ছাড়াই ওএমআর শিট তৈরি এবং তার মূল্যায়ন করার দায়িত্ব দিয়েছিল। এমনভাবে ওএমআর শিট ডিজাইন করা হয়েছিল যাতে যারা পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁদের বোঝার উপায় নেই কোনটা তাঁদের উত্তরপত্র! সরকারি মদতেই সাজানো হয়েছিল দুর্নীতির নকশা, প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল পর্ষদ। 
আর সেই দুর্নীতির টাকা খেটেছিল লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে! ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি এখনও এই কোম্পানির সিইও। যদিও গত আট বছর ধরে সেই তথ্য চেপে রেখেই দু’-দু’টি লোকসভার ভোটে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন তিনি। 
এই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের আগের ঠিকানাও ছিল খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের ঠিকানা অর্থাৎ ৩০/বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। শুধু তাই নয়, ২০১২ সালে কোম্পানির প্রথম ডিরেক্টর হিসাবে অভিষেক ব্যানার্জি, তাঁর মা লতা ব্যানার্জি, এমনকি পরবর্তীতে অভিষেক-জায়া রুজিরা নারুলা ব্যানার্জিও এই ৩০/বি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটকে তাঁদের ঠিকানা দেখিয়েছিলেন। 
এবার স্বাধীনতার পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের বুকে সর্ববৃহৎ নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় মুখ্যমন্ত্রীর এই পারিবারিক সংস্থার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পথেই হাঁটলো ইডি। মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে এই সংক্রান্ত রিপোর্ট পেশ করে ইডি’র তরফে জানানো হয়, ‘এই কোম্পানির আটটি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সেই সম্পত্তির তালিকা প্রকাশ্যে শুনানিতে জানাচ্ছি না, তার মূল্য সাড়ে সাত কোটি টাকা। নিয়োগ দুর্নীতির টাকার সঙ্গে সরাসরি যোগ আছে এই সংস্থার। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের সকলেই সমন পাঠাতে চলেছি’।
অভিষেক ব্যানার্জির ‘ব্রেনচাইল্ড’ এই প্রতারক সংস্থা। ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল বোর্ড অব ডিরেক্টরসে তাঁর সঙ্গেই যোগ দিয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’ও। অভিষেক ব্যানার্জি ২০১৪ সালে সাংসদ হওয়ার পরে পদত্যাগ করেন লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেডের ডিরেক্টর বোর্ড থেকে। বর্তমানে অভিষেক ব্যানার্জির বাবা-মা’ই  এই সংস্থার অন্যতম দুই ডিরেক্টর। রুজিরা ব্যানার্জিও একসময় ছিলেন এই সংস্থার বোর্ড অব ডিরেক্টরসে। আদ্যোপান্ত পারিবারিক এই সংস্থাতেই খেটেছে নিয়োগ দুর্নীতির অবৈধ টাকা।
মুখ্যমন্ত্রীর এই পারিবারিক সংস্থায় খেটেছে নিয়োগ দুর্নীতির টাকা, আর তার জন্য সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করছে তদন্তকারী সংস্থা-কেবল এরাজ্য নয় গোটা দেশেই এটা নজিরবিহীন ঘটনা বলে উল্লেখ করে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এদিন বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর ঠিকানায়, মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের দ্বারা, মুখ্যমন্ত্রীর কর্মকাণ্ড, প্রভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে এই সংস্থার এই দ্রুত উত্থান। অবশেষে, এত খোঁজখুঁজির পরে, আদালতের ভিতরে আইনজীবীদের ও বাইরে সাধারণ মানুষের সোচ্চার প্রশ্ন, বিচারপতিদের লাগাতার প্রশ্নবাণের পরে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হলো। এতকিছুর পরেও কাদের প্রশ্রয়ে, মদতে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর ভাইপো এখনও নিরাপদে বাইরে আছে?’
যদিও গত সেপ্টেম্বরেই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের সিইও অভিষেক ব্যানার্জির সম্পত্তির যে তালিকা খোদ আদালত জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছিল, সেই তালিকায় ইডি’ অভিষেক ব্যানার্জির কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্যই উল্লেখ করতে পারেনি! সেই অসম্পূর্ণ রিপোর্টে  ক্ষুব্ধ হয় আদালতও। আদালত প্রশ্ন তোলে, মুখ্যমন্ত্রীর পারিবারিক সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস কীসের ব্যবসা করেন? সংস্থায় আয় হয় কোথা থেকে? নির্দিষ্টভাবে কীসের ব্যবসা? আদালতের নির্দেশ ঠেকাতে বিস্তর আইনি লড়াই চালিয়েছেন অভিষেক ব্যানার্জি। যদিও তদন্তের আওতা থেকে বেরোতে পারেননি তিনি। আদালত অভিষেক ব্যানার্জিকে নির্দেশ দেয় দেয় ইডি’র কাছে সংস্থার ও তাঁর নিজের সম্পত্তির খতিয়ান জমা করতে। ডিসেম্বরে অভিষেক ব্যানার্জি ৫হাজার ৫০০ পাতার নথি ইডি’র কাছে জমা দেন। এর আগে ইডি’ যে চার্জশিট জমা দেয় আদালতে তাতেই সামনে চলে এসেছিল অভিষেকের পারিবারিক সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের প্রসঙ্গ! ঘুরপথে অভিষেক ঘনিষ্ঠ কালীঘাটের কাকুর সংস্থা এসডি কনসালটেন্সির মাধ্যমেই চাকরি বেচার টাকা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১’র জানুয়ারি পর্যন্ত তিন দফায় মোট ৯৫ লক্ষ টাকা ঢুকেছিল লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে।
এরই পাশাপাশি সিবিআই’র তরফে এদিন আদালতে জানানো হয়, কীভাবে এস বসুরায় কোম্পানিকে ব্যবহার করো ওএমআর শিট জালিয়াতি করা হয়েছিল। সিবিআই’র তরফে আইনজীবী এদিন বিচারপতি অমৃতা সিনহাকে জানান,  ২০২২ সাল পর্যন্ত এস বসুরায় একটি চার্টার্ড ফার্ম ছিল। তারপরে হঠাৎ সেটা ডাটাবেস, সফটওয়্যার বেস কোম্পানি হয়ে যায়। কোনও টেন্ডার ছাড়াই ২০১৪ সালের প্রাথমিক টেট পরীক্ষার মূল্যায়নের বরাত পেয়েছিল এস বসু রায় কোম্পানি। ওএমআর শিট তৈরি এবং মূল্যায়ন দুটোই করেছিল এই সংস্থা। পর্ষদের অফিসে এই সংস্থার জন্য একটিও ঘর ছিল। অথচ এই কোম্পানিতে এখনও একজনক কর্মীও নেই। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এই কোম্পানি সামনে রেখে পিছন থেকে একটা প্রভাবশালী চক্র গোটা দুর্নীতি সাজিয়েছিল। দুর্নীতিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সিবিআই আদালতে জমা দেওয়া রিপোর্টে দাবি করে— অযোগ্যদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য এই সংস্থার মাধ্যমেই নম্বর দেওয়া হতো। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ একটি পোর্টাল খুলেছিল প্রার্থীদের নাম নথিভুক্ত করার জন্য। এটাও সম্পূর্ণ বেআইনি। এমনভাবে ওএমআর ডিজাইন করা হয়েছিল, যাতে কোনও প্রার্থী তাঁদের উত্তরপত্র চিনতেই না পারেন। এমনভাবে ডিজাইন কিরা হয়েছিল যাতে একটা রোল নম্বরে একাধিক রেজিস্ট্রেশন করা যায়। ওএমআর শিট ওয়েস্ট পেপার হিসাবে বালেশ্বরে গুদামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।
আইনজীবী ফিরদৌস সামিম এদিন বলেন, ‘এদিন ইডি এ সিবিআই’র দুটি রিপোর্টেই স্পষ্ট একেবারে পুর্বপরিকল্পিত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এটি যার সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িয়ে শাসকদল।’ 
নিয়োগ দুর্নীতির চক্রে যাদের বাড়ি, অফিসে সম্প্রতি তল্লাশি হয়েছিল রিপোর্টে তাঁদের নাম উল্লেখ করে বলা হয় তাঁরা কার্যত টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার এজেন্ট হিসাবে কাজ করতেন। তাঁরা হলে ডোমকলের তৃণমূলের বিধায়ক জাফিকুল ইসলাম, বিধায়ক অদিতি মুন্সির স্বামী দেবরাজ চক্রবর্তী, কলকাতার ১০১ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্ত, পাটুলি এলাকার যুব তৃণমূল নেতা সৌরভ ঘোষ, কোচবিহারের সজল কর, মহিদুল আনসারি সহ একাধিক প্রাইমারি টিচার্স ইনস্টিটিউশন।
 

Comments :0

Login to leave a comment