Cattle smuggling case

দিল্লিতে কড়া জেরার মুখে অনুব্রত

জাতীয় রাজ্য

Cattle smuggling case

বুধবার সকাল থেকে দিল্লিতে ইডি’র সদর দপ্তরে দফায় দফায় চলছে ম্যারাথন জেরা।
এনামুলের গোরু পাচারের সাম্রাজ্যে পুলিশ প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ করে’ ইলামবাজার থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে মুর্শিদাবাদের আটটি থানা এলাকা হয়ে গোরু পাচারের সুবিধা করে দেওয়ার বিনিময় মূল্য হিসাবে প্রতিমাসে যে কোটি কোটি টাকা নিতেন অনুব্রত মণ্ডল, সেই টাকার ভাগ কোথায় কোথায় পৌঁছে দেওয়া হতো?
বিপুল টাকার সিংহভাগই ছিল নগদে লেনদেন। একাধিক ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমে অন্যত্র পাচার করার, ভিন রাজ্য বিপুল সম্পত্তি, বোলপুরে জমির পর জমি, চালকলের ব্যবসা ছাড়াও সেই টাকার ভাগ আর কোথায় পৌঁছেছে? কোন শিখণ্ডী সংস্থার মাধ্যমে এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার আত্মীয়ের মাধ্যমে বিদেশে কোথায় পাচার হয়েছে? একের পর এক প্রশ্নবানের মুখে পড়তে হয়েছে অনুব্রত মণ্ডলকে। গত আট মাসে নিজাম প্যালেসে সিবিআই জেরা কিংবা আসানসোল জেলের নানা সুবিধার মধ্যে থেকে সেভাবে জেরায় সহযোগিতা না করলেও প্রথম দিনের লাগাতার জেরায় অবশেষে অনুব্রত মণ্ডল কিছুটা মুখ খুলতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে। 


লাগাতার জেরায় আরও বিপাকের মধ্যে পড়েছেন যখন বুধবার দুপুরে রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে মেডিক্যাল টেস্টের পরে দ্বিতীয় দফায় তাঁর কন্য সুকন্যা ভট্টাচার্য ও দেহরক্ষী আপাতত তিহার জেলে বন্দি সায়গল হোসেনের বয়ান সামনে ফেলে জেরা করা হয় এই বাহুবলী তৃণমুলী নেতাকে। গত নভেম্বর মাসে পরপর দু’দিন ধরে সুকন্যা ভট্টাচার্যকে জেরা করেছিল ইডি। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে এই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকার বার্ষিক আয় ৩ লক্ষ টাকা বেড়ে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকায় পৌঁছে গিয়েছিল। দু’-দুটি শিখণ্ডী সংস্থার ডিরেক্টর, কয়েক কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট, একাধিক চালকলের মালিক বনে যাওয়া সবই কয়লা পাচারের কল্যানেই, দাবি ইডি’র। সেই জেরার বয়ান সামনে ফেলেই অনুব্রত মণ্ডলের বয়ান নেওয়া হচ্ছে।


দিল্লিতে ইডি’ দপ্তরে এদিন সকাল থেকে জেরার আগে মঙ্গলবার রাতভর দফায় দফায় নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হলো মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহের কেষ্ট মণ্ডলকে নিয়ে। 
প্রথম দফায় ভার্চুয়াল শুনানির পরে মঙ্গলবার রাত পৌনে দুটোয় দিল্লিতে অশোকবিহারে বিচারক রাকেশ কুমারের বাড়িতে শুনানি শেষ হয়। সশরীরেই অনুব্রত মণ্ডলকে হাজির করতে বলেছিলেন বিচারক। ইডি’র তরফে ১৪দিনের বিচারবিভাগীয় হেপাজত চাইলেও বিচারক রাজেশ কুমার তিন দিনের হেপাজতের নির্দেশ দেন। ১০ মার্চ সকালে অনুব্রত মণ্ডলকে রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে পেশ করতে হবে। হোলির পরে একটা দিন বাদ দিয়েই শুক্রবার হাজির করার নির্দেশ দেওয়ায় ইডি প্রথম দফায় তিন দিন সময় পায় জেরার। 


একদিকে রাজ্যের শাসক দল,পুলিশ প্রশাসনের সব রকম চেষ্টা অন্যদিকে বিপুল টাকা খরচ করে দাপুটে আইনজীবী ভাড়া করে গত তিনমাস ধরে কলকাতা থেকে দিল্লি একের পর এক আদালতে মামলা করে, দলীয় কর্মীকে দিয়ে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে অনুব্রতকে বীরভূমের জেলেই রেখে দেওয়ার কৌশল, খোদ আসানসোলে সিবিআই আদালতের বিচারককে গাঁজা কেসে ফাঁসিয়ে হুমকি চিঠি দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা সহ কোনও কিছুই বাদ রাখা হয়নি। লক্ষ্য একটাই ছিল অনুব্রত মণ্ডলের দিল্লি যাত্রা ঠেকানো। এমনকি কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেওয়ার পরেও রবিবার দিনভর চলে নাটক, শেষমেশ সোমবার আসানসোলের সিবিআই আদালতের বিচারক ফের নির্দেশ দেওয়ার পরে অনুব্রতকে পুলিশি নিরাপত্তায় মঙ্গলবার সকালে দোলের উৎসবের মাঝেই প্রথমে কলকাতায় আনা হয়। 
সকালে ৬-৪৫মিনিটি নাগাদ আসানসোল জেল থেকে বের করে আনা হয় তাঁকে। ঘণ্টা দু’য়ের পরে কনভয় প্রথম থামে শক্তিগড়ে ল্যাংচা কুঠিতে, সেখানে পুলিশের সামনে তৃণমূল কর্মীর সঙ্গেই প্রাতঃরাশ সারেন মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহের কেষ্ট মণ্ডল। পুলিশের খাবারের বিলও মেটায় তৃণমূল, গোটা ঘটনা নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়। এরপর সেখান থেকে ১১টা নাগাদ ইএসআই জোকায়। সেখানো স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরে সোজা দমদম বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়। হাসপাতালেই পুলিশ আদালতের নির্দেশ স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরে অনুব্রত মণ্ডলকে সরকারি ভাবে ইডি’র আধিকারিকদের হাতে তুলে দেয়। কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় ইডি এরপর অনুব্রতকে নিয়ে সোজা দমদমের উদ্দেশ্য রওনা দেয়। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় তাঁকে দেখে সাধারণ মানুষজন গোরু চোর- গোরু চোর বলে চিৎকারও করতে থাকেন। 


এরপর ৬টা ৪৫-এর বিমানে অনুব্রতকে নিয়ে দিল্লি রওনা দেন ইডি’র আধিকারিকরা। রাত পৌনে নটা নাগাদ দিল্লি পৌঁছায় বিমান। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ঘেরাটোপে অনুব্রতকে সঙ্গে নিয়ে রাত সাড়ে নটা নাগাদ রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও রুটিন চেক আপের পরে ইডি রাতেই রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে ভার্চুয়াল শুনানির আবেদন জানায়। রাত ১১টা নাগাদ বিচারক রাজেশ কুমারের এজলাসের শুরু হয় ভার্চুয়াল শুনানি। ইডি’র তরফে আদালতে জানানো হয়, গোরু পাচারের মানি লন্ডারিংয়ের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে একাধিক তথ্য হাতে এসেছে। তদন্তের এই পর্যায়ে অনুব্রত মণ্ডলকে হেপাজতে নিয়ে জেরার করা খুবই জরুরি।


যদিও আধ ঘণ্টা শুনানির চলার পরেই তা স্থগিত হয়ে যায়। বিচারক জানান অনুব্রত মণ্ডলকে সশরীরে হাজির করতে হবে। এরপরেই ইডি’র আধিকারিকদের নির্দেশ দেন তাঁর বাড়িতেই নিয়ে আসা হোক অনুব্রত মণ্ডলকে। সেখানেই চলবে শুনানি। রীতিমত টানটান উত্তেজনা। 
এরপর অনুব্রত মণ্ডলকে সঙ্গে নিয়ে ইডি’র আধিকারিকরা, তদন্তকারী সংস্থার আইনজীবী, অনুব্রতর আইনজীবী মুদিত জৈন রওনা দেন অশোকবিহারে বিচারপতির বাড়ির উদ্দেশে। রাস্তা চিনতে না পারায় সেখানেও কিছুক্ষণ দেরি হয়। শেষমেশ রাত একটায় বিচারপতির বাড়িতে পৌঁছান ইডি’র আধিকারিকরা। শুরু হয় শুনানি। এও এক নজিরবিহীন ঘটনা। দিল্লির সাংবাদিকদের মধ্যেও চাঞ্চল্য ছড়ায় এমন ঘটনায়। রাত ১-৪৫ মিনিটে শেষ হয় সওয়াল জবাব। বিচারক রাকেশ কুমার মঙ্গলবার গোরু পাচার মামলায় অনুব্রতকে আগামী ১০ মার্চ পর্যন্ত ইডি হেপাজতে রাখার নির্দেশ দেন।

Comments :0

Login to leave a comment