অমিত কুমার দেব
বিগত প্রায় ৩ বছর যাবত কোন যাত্রী ঘাটতি না থাকলেও ফেব্রুয়ারী মাস থেকে বন্ধ হতে চলেছে কোচবিহার -কলকাতা বিমান পরিষেবা। ইন্ডিয়া এয়ার ওয়ান কর্তৃপক্ষ এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার কোচবিহার বিমানবন্দরের আধিকারিককে চিঠি দিয়ে ইতিমধ্যে একথা জানিয়ে দিয়েছে বলে খবর।
উল্লেখ্য, কেন্দ্র -রাজ্য টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১তারিখ চালু হয় কোচবিহার - কলকাতা বিমান চলাচল। ইন্ডিয়া ওয়ান সংস্থার ৯ আসন বিশিষ্ট এই বিমান চলাচল করছে।
এই কোচবিহার বিমানবন্দরে অধিক যাত্রী বহনকারী বিমান ওঠানামা করার ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা নিয়ে কোন রকম উচ্চবাচ্য করেনি কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকার। এ ব্যাপারে কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছিলো কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল। আর এবার চলমান বিমান পরিষেবাও বন্ধ হতে চলেছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের উড়ান স্কিমের আওতায় চালু হয় এই বিমান পরিষেবা। আমেদাবাদের একটি বিমান সংস্থা ইন্ডিয়া ওয়ান এয়ার এর দায়িত্ব পেয়েছে। প্রতিদিন কোচবিহার থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে জামশেদপুর এবং জামশেদপুর থেকে ভুবনেশ্বর পর্যন্ত চলাচল করে এই বিমান বলে সূত্রে খবর। বহু পুরোনো এই কোচবিহার বিমানবন্দর। ১৯৩৪ সালে প্রথম বিমান নামে কোচবিহারে। ১৯৩৮ সাল নাগাদ তৈরী হয় এই বিমান বন্দর। কোচবিহারের রাজাদের উদ্যোগেই নির্মিত হয় এই বিমানবন্দর। উত্তর পূর্ব ভারতের অন্যান্য এয়ারপোর্টগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রয়োজনের তাগিদে তৈরী হয়েছিল। ব্যতিক্রম কোচবিহার। এই রাজনগরে একসময় দিনে ২৪ আসনের ৩টি করে বিমান ওঠা নামা করতো নিয়মিত। এছাড়া মহারাজাদের নিজস্ব বোনাঞ্জো বিচ ক্রাফ্ট প্লেন তো ছিলই। ১৯৪৮ সালে বিমানবন্দরটি বাণিজ্যিক বাহকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত হিমালয়ান এভিয়েশন, দ্বারভাঙ্গা এয়ারওয়েজ, কলিঙ্গা এয়ারওয়েজ, এয়ারওয়েজ ইন্ডিয়া, ভারত এয়ারওয়েজ এবং জামির এয়ারওয়েজের মতো বেশ কয়েকটি ছোট বেসরকারি বাহক বিমানবন্দর থেকে চলাচল করত। ১৯৭২ সাল থেকে পূর্ববর্তী ভারতীয় এয়ারলাইন্স তিন বছর ধরে এখান থেকে উড়ান পরিচালনা করেছিল। এরপর বায়ুদূত বিমান চালায়। ১৯৯৫ সালে পাকাপাকি ভাবে বিমান চলাচল বন্ধ হয়। এরপর বাম আমলে একাধিকবার চালু করার প্রয়াস নেওয়া হলেও, উড়ান চালু করা যায়নি। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকবার বিমান চলাচল করলেও কয়েকদিন পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। শেষবার ২০১৬ সালে এই বিমানবন্দর থেকে বিমান ওঠানামা করে। তবে শেষ ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বিমান চলাচলের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল কোচবিহারের সাংসদের পক্ষ থেকে। কিন্তু এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া এবং কোচবিহার জেলা প্রশাসনের মধ্যে কিছু ত্রুটির কারণে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
এই বিমানবন্দর থেকে বিমান চলাচল নিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্যের ক্ষমতাসীনদের কৃতিত্বের দড়ি টানাটানি বারবার সংবাদ শিরোনামে এলেও, ভুলে গেলে চলবে না, এই বিমান বন্দরটি পুনরুজ্জীবনের জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার। ২০০৭সালে কেন্দ্রীয় বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় এবং এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার সাথে একাধিকবার দরবার করেন রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়েই এই কোচবিহার বিমানবন্দর সংস্কারের জন্য ২০কোটি টাকা বরাদ্দ করে এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া। এরপর শুরু হয় এই বিমানবন্দর সংস্কারের কাজ। কোচবিহার বিমানবন্দরে রানওয়ে রয়েছে ১ হাজার ৬৯ মিটার। এই রানওয়েতে ৭২আসনের বিমান নামনো সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন কম করে প্রায় ১৫০০ মিটারের রানওয়ে। সব মিলিয়ে ১ হাজার৭০০ মিটার রানওয়ে তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নতুন করে ৬৩১মিটার রানওয়ে বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। নদীর ওপর রানওয়ে থাকবে ৫৫ মিটার, চওড়া হবে প্রায় ৪০ মিটার। একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীরা এই বিমানবন্দরের সাথে কার্যত লাগোয়া মরাতোর্ষা নদীর ওপর একটি বক্স ব্রিজ ডিজাইন করারও উদ্যোগ গ্রহণ করে বর্ধিত রানওয়ের জন্য। কিন্তু ২০১১সালে রাজ্যে পালাবদলের পর এই কাজের গতি কমে যায় অনেকটাই।
এই প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) কোচবিহার জেলা সম্পাদক অনন্ত রায় বলেন, “কেন্দ্র ও রাজ্যের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকার কারণেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। কোচবিহার সহ গোটা উত্তরবঙ্গে কোন ইস্যুতে যখন বেকায়দায় পড়ে কেন্দ্র ও রাজ্য। ঠিক তখনই এলাকার মানুষের আইওয়াশ করবার জন্যই পরিকল্পনাহীন ভাবে বিমান পরিষেবা চালু করা হয়। এব্যাপারে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন। তাই বিমান পরিষেবা বন্ধ নয়, দ্রুত রাজ ঐতিহ্য সম্পন্ন কোচবিহার বিমানবন্দর থেকে আন্তঃরাজ্য বিমান পরিষেবা চালু করার এদিন দাবি জানান তিনি।”
Comments :0