HARRY BELAFONTE

শ্রমিকের জীবনযন্ত্রণা ছুঁয়ে ছিল
তাঁর গান, ফেয়ারওয়েল বেলাফন্টে

আন্তর্জাতিক

HARRY BELAFONTE

সৌরভ গোস্বামী

আই অ্যাম স্যাড টু সে আই অ্যাম অন মাই ওয়ে ওন্ট বি ব্যাক ফর মেনি এ ডেজ’-- অনেক দিন নয়, চিরকালের মতো বিদায় নিয়েছেন হ্যারি বেলাফন্টে। 

১৯২৭ সালের ১ মার্চে হার্লেমের এক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অভিবাসী পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। নিউইয়র্কে জন্ম গ্রহণ করলেও তাঁর শৈশব কাটে জামাইকায়। ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে পড়াশোনা করতে পারেননি তিনি। ১৭ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মার্কিন নৌসেনায় যোগদান করেন বেলাফন্টে। যুদ্ধ থেকে ফিরে অভিনয়ের ক্লাসে যোগদান করেন, পাশাপাশি চলে গানের চর্চা। নিউইয়র্কে নানা ক্লাবে গান গেয়ে প্রথম জনপ্রিয়তা পান হ্যারি বেলাফন্টে। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম অ্যালবাম ক্যালিপ্সো। 

১৯৫৭ সালের চলচ্চিত্র "আইল্যান্ড ইন দ্য সান"-এ তাঁর চরিত্র, যেটিতে হুয়ান ফন্টেইন অভিনীত একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলার সাথে রোম্যান্সের আবহ রয়েছে, মার্কিন মুল্লুকে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল; এমনকী সাউথ ক্যারোলিনা আইনসভায় একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছিল যাতে ফিল্ম দেখানো যেকোনো থিয়েটারকে জরিমানা করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

জামাইকান মেন্টো লোকগানের সঙ্গে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো ক্যালিপসোর স্টাইলকে মিলিয়ে দিয়ে ৫০-এর দশকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করেছিলেন বেলাফন্টে। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মার্টিন লুথার কিংয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তিনি। জর্জ বুশ ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন। তিনি আজীবন বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক এবং ফিদেল কাস্ত্রো এবং হুগো শাভেজের সমর্থক ছিলেন। ফিদেল সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘ আপনি যদি ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করেন, আপনি যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, আপনি যদি জনগণের অধিকারে বিশ্বাস করেন, আপনি যদি সমস্ত মানবজাতির সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করেন - তাহলে  ফিদেল কাস্ত্রোকে সমর্থন করা ছাড়া আপনার আর কোন উপায় নেই! কমিউনিস্ট মতাদর্শের জন্য তাঁর পেছনে নজরদারি চালায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলি, প্রায় দশ বছরেরও অদিক সময়কাল ধরে। 

তাঁর গানের সহজ-সরল সুর, সহজবোধ্য কথা ভালোবাসতে পারেনি, এমন মানুষ বিরল। তাঁর বিখ্যাত ব্যানানা বোট সং-এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কতখানি মর্মস্পর্শী ইতিহাস - রাতভর জাহাজে কয়লা বোঝাই করা দাসশ্রমিকের দীর্ঘশ্বাস। বেলাফন্টের গানে বারবার উঠে এসেছে প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণির কথা। মার্কিন সমাজে বর্ণবৈষম্য ভাঙতে গানকেই হাতিয়ার করেছেন বরাবর। মার্কিন দেশে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট দিয়ে যে দীর্ঘ যাত্রার শুরু - মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের জামিন হয়ে তাঁকে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন বেলাফণ্টে-ই, সেই মুক্তির পরই ঐতিহাসিক মিছিল, যার শেষে সেই কালজয়ী বক্তৃতা 'আই হ্যাভ আ ড্রিম' - পরবর্তী সময়ে সেই প্রতিবাদী কন্ঠ সোচ্চার হয়েছিল আফ্রিকার মানুষের জন্য লড়াইয়ে, আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে এইডসের মহামারীর মুহূর্তে সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারের দাবিতে। 

জীবনে সবচেয়ে বেশি অর্থ সাহায্য করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে। ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে অজস্র গান গেয়েছিলেন আমেরিকার ফুটপাথে। মুক্তির পরেও। সেই গান ভাষার, দেশকালের সীমানা ভেঙে দিয়েছিল অবলীলায়। সেই তরঙ্গ এসে পৌঁছায় বাংলাতেও। ভূপেন হাজারিকা গাইলেন- সাতাশ বছর আর সাতটি মাসের অন্ধ কারা তুমি ভাঙলে, প্রখর রৌদ্রে তুমি আফ্রিকার নূতন যুবক হয়ে চললে, জিন্দাবাদ ম্যান্ডেলা, ম্যান্ডেলা জিন্দাবাদ।

তাঁর জামাইকান ফেয়ারওয়েলের একাধিক বাংলা অনুবাদ রয়েছে। বাংলায় ‘ডাউন দ্য ওয়ে’ অবল্মবনে গান তৈরি করেন রঞ্জন প্রসাদ। পূরবী মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে বহু অনুষ্ঠানে শোনা গিয়েছে সেই গান। অসংখ্য মানুষের গলায় ফুটে উঠেছে, ‘পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়, যেথা সময় থমকে থামে বটের ছায়!সেই গানের কথায় যেন মেয়েকে দেখার ব্যাকুলতা নিয়ে দূরে কাজ করতে যাওয়া বাবার ঘরে ফেরার আকুতি স্পষ্ট হয়! যেন এদেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন যন্ত্রণাকে বহুকাল আগেই ছুঁয়ে ফেলেছিলেন বেলাফন্টে। 

জামাইকা ফেয়ারওয়েলে বুঁদ বাঙালি তাঁর ফেয়ারওয়লের দিনে বেলাফন্টের গলায় ‘‘জন হেনরি’’র হাতুড়ির শব্দ শুনবে না? এই গানের শ্রেণিচেতনা, মুক্তির স্বপ্ন ও সংগ্রাম আমাদের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে... আমাদের জন্য প্রাত:স্মরণীয়।

Comments :0

Login to leave a comment