Hariyana buldozer

ঘুরে বেড়াচ্ছে বিট্টু বজরঙ্গি, মুসলিম বস্তি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে খাট্টারের বুলডোজার

জাতীয়

অরূপ সেন: নয়াদিল্লি

হুমকি-ইঙ্গিত মতোই বুলডোজার চললো হরিয়ানাতেও। এবং সেই বেছে বেছে মুসলিম মহল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বিধ্বস্ত ন্যূহের কাছে তওরা টাউনে বৃহস্পতিবার রাতে বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেওয়া হলো প্রায় ২৫০ ঝুপড়ি। মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টার দু’দিন আগেই এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেই হুমকি মতোই চললো বুলডোজার। সরকারিভাবে যদিও, এর পক্ষে খাস জমি জবরদখল মুক্ত করার অজুহাত দেওয়া হয়েছে।
বিজেপি’র এই ‘বুলডোজার সংস্কৃতি’ নিয়ে অতি বিরক্ত সুপ্রিম কোর্ট গত সপ্তাহেই উত্তর প্রদেশের যোগী সরকারকে কড়া ভাষাতেই তুলোধনা করে বলেছিল, ‘মানছেন তাহলে, বুলডোজার চালিয়ে বাড়ি ভাঙা অন্যায়?’ সর্বোচ্চ আদালতের সেই ধমক যদিও কানে তোলেনি বিজেপি নেতৃত্ব। নাহলে, সোমবার ন্যূহে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর অন্যতম মূল কারিগর স্বঘোষিত ‘গোরক্ষক’ বিট্টু বজরঙ্গি দুদিন আগেই দাবি তোলে, ‘যোগীর স্টাইলে হরিয়ানাতেও বুলডোজার চালাতে হবে। এনকাউন্টারে খতম করতে হবে।’ আর তার পরপরই খোদ মুখ্যমন্ত্রীও বুলডোজার চালানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
শুধু ইঙ্গিত নয়, কথা মতোই কাজ। ন্যূহ’র ২০ কিলোমিটার দূরে তওরার একটা গোটা মুসলিম বসতি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। প্রশাসনের দাবি, গত চার বছর ধরে আসাম থেকে আসা এই ‘বাংলাদেশী’রা এখানে ঝুপড়ি বানিয়ে ছিল। মহম্মদ রোড বরাবর প্রায় এক একর জুড়ে ওই বসতি উচ্ছেদ করতে বৃহস্পতিবার রাতে আধা সেনা সহ বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে গিয়ে প্রশাসন বুলডোজার চালিয়েছে।
হরিয়ানায় বুলডোজার চালিয়ে হরিয়ানার প্রশাসন এখন যেন ‘রাজধর্ম’ পালন করছে। গ্রেপ্তার-আটকের ফিরিস্তি দিয়ে দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জাহির করা হচ্ছে। এদিনই যেমন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল ভিজ দাবি করলেন, সবমিলিয়ে ২০২জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ১০২টি এফআইআর দায়ের হয়েছে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ৮০ জনকে আটক করা হয়েছে। এদিন আম্বালায় ভিজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করতে চাই, সেদিনের ঘটনায় যুক্ত কাউকে রেয়াত করা হবে না।’ 
মন্ত্রী যদিও জবাব দিলেন না, বিট্টু বজরঙ্গি ওরফে রাজ কুমার কীভাবে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুশোর ওপরে গ্রেপ্তার হলেও ‘বাপ তো বাপ রাহেগা’ ভাইরাল ভিডিও’র কারিগর বিট্টু কেন গ্রেপ্তার হয়নি। জবাব নেই প্রশাসনের। শুধু পুলিশ সুপার নরেন্দ্র সিং বিজরনিয়া জানিয়েছেন, সোমবারের সংঘর্ষের ঘটনায় ফরিদাবাদের এই স্বঘোষিত গোরক্ষকের বিরুদ্ধে। গাজিপুর বাজার ও ডাবুয়া বাজারের ফল-সবজি ব্যবসায়ী এই বিট্টুর বিরুদ্ধেই শুধু এই একমাসে ধর্মীয় উসকানি ছড়ানোর তিন-তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে। তবুও গ্রেপ্তার-আটক কিছুই করা হয়নি বিট্টুর বিরুদ্ধে। প্রশাসন হয়তো, পেটোয়া সংবাদ মাধ্যমে বিট্টুর দেওয়া সাক্ষাৎকারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। সেখানে বিট্টু বজরঙ্গির দাবি ছিল, হিন্দুর তো সেদিন ‘পুজো’ করতে মিছিলে তলোয়ার এনেছিল। কারো কারো হাতে সেদিন বন্দুকও তো ছিল, প্রশ্নের জবাবে বজরঙ্গির জবাব, ‘কিছু লোকের হাতে অস্ত্র ছিল, কিন্তু তাদের তো লাইসেন্স রয়েছে। আর তলোয়ার তো আমরা বিয়ে, পুজো সবকিছুতেই নিয়ে যাই’। 
এমন ‘ধার্মিক’ সাফাইয়ে সন্তুষ্ট প্রশাসন তাই হয়তো মামলা করলেও ছোঁয়নি বিট্টু বজরঙ্গিকে। ব্যবস্থা নেওয়া তো দূর, বরং বিট্টুর দাবি মতো ‘বুলডোজার দাওয়াই’-এর পথেই হাঁটছে হরিয়ানার প্রশাসন। সঙ্গে তো সংখ্যালঘু মনে ভয় ধরাতে বিট্টুর বাহিনী রয়েইছে। তাদের বাহিনী তো খুলে আম গিয়ে মহল্লায় মহল্লায় শাসিয়ে যাচ্ছে, ‘যেখান থেকে এসেছিস, সেখানে ফিরে যা’।
এই তো গত মঙ্গলবার সকালে গুরগাঁওয়ের সেক্টর ৭০এ’র পারলা গ্রামে এসেছিল গেরুয়া ফেট্টিধারীর একটা বাইক-বাহিনী। গোটা পঁচিশেক বাইকের, প্রত্যেকটা দুটো-তিনটে করে লোক। এই পারলায় ৮০০-৯০০ পরিবার ঝুপড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। কেউ কাজ করে আশপাশের আবাসনগুলিতে গৃহপরিচারক-দারোয়ানের। কারো আবার পেট চলে নোংরা, পুরানো জিনিস কেনাবেচার ব্যবসা করে। এই পারলাতেই থাকেন পশ্চিম বঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে আসা নাবিল আহমেদ। গাড়ি ধোয়ার কাজ করে সংসার চালান। সেদিনের ধমক-অভিযানের গল্প শোনালেন, ‘বাইক থেকে নেমেই ওরা একে-তাকে চড়চাপটা মারতে শুরু করলো। সকলের হাতেই লাঠি, তরোয়াল, বন্দুক — কিছু না কিছু একটা ছিল। আইডেন্টিটি কার্ড দেখতে চাইলো। তারপর আবার দু’ঘা দিয়ে শাসিয়ে গেল, বিকেল চারটে পর্যন্ত সময় দিলাম, চলে যা এখান থেকে, নাহলে সবশুদ্ধ জ্বালিয়ে দেব।’
গেরুয়া বাইকবাহিনী চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেদিন পুলিশ এসে গিয়েছিল সেখানে। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আবার বাইকবাহিনী ফিরে এল। নাবিল বলছিলেন, ‘পুলিশ ওদের আটকালো, কিন্তু কোনও বলপ্রয়োগ করলো না’। এমনটা দেখে পারলার অনেকেই আর সেই রাতটা গ্রামে কাটানোর সাহস করেননি। বাড়ি বাড়ি কাজ করেন শাবানা বিবি, তিনটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে পাশের জঙ্গলেই কাটিয়ে দিয়েছেন। বলছিলেন, ৮-১০টা পরিবার জঙ্গলের মধ্যে বিস্কুট খেয়েই রাতটা কাটিয়ে দিয়েছি। 
দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক গ্রাম থেকে মাস সাতেক আগেই সব কিছু বেচেবুচে ছেলেকে নিয়ে এখানে চলে এসেছেন সাইফুদ্দিন মোল্লা। ওখানে তো কাজ নেই, এখানে তবু এটা-ওটা করে চলে যায়। শোনালেন, এখানকার ৯০ শতাংশ মুসলিমই মঙ্গলবার রাতের পর পালিয়ে গিয়েছে। এর-তার থেকে দার করেও টিকিট কেটে পালিয়েছে। সাইফুদ্দিনের গলায় খেদ, ‘রয়ে গেছি আমাদের মতো কয়েকজন। যাদের কোথাও যাওয়ার নেই।’
মঙ্গলবার থেকে এখানকার মানুষের আতঙ্কের কিছু ভিডিও ঘুরছে সোশাল মিডিয়ায়। দক্ষিণ গুরগাঁওয়ের ডেপুটি কমিশনার সিদ্ধান্ত জৈন অবশ্য দাবি করছেন, ‘এই সব ফেক। সর্বত্র শান্তি রয়েছে। কোথাও কোনও সম্প্রদায়কে হুমকি দেওয়া হচ্ছে না’।

Comments :0

Login to leave a comment