Unity

যে কোনও মূল্যে ঐক্য সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে

জাতীয় রাজ্য উত্তর সম্পাদকীয়​

মহম্মদ সেলিম
 

কমরেড জ্যোতি বসু বর্বর বলেছিলেন বিজেপি-কে। স্পষ্ট করে। এটি হচ্ছে নেতৃত্বের গুণ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অ্যাজেন্ডাটি কী? অ্যাজেন্ডা শুধু একটি মসজিদ ভাঙা নয়। এখন আমরা দেখছি ধর্ম, রাজনীতির মিশেল দিয়ে গোটা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দির তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। এখন কে ধর্মগুরু, আর কে প্রধানমন্ত্রী, কে মুখ্যমন্ত্রী আর ধার্মিক নেতা বোঝা যাচ্ছে না। 
ইতালিতে ফ্যাসিবাদের সময়, মুসোলিনির শাসনে বলা হয়েছিল সরকার এবং কর্পোরেটের ভেদ মুছে যাবে। কর্পোরেট কখনও সরকারের ভূমিকা পালন করবে, সরকার কর্পোরেটের ভূমিকা পালন করবে। জার্মানিতেও আমরা দেখেছি নাৎসিবাদকে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ সর্বত্র একই কায়দায় আসে না। তার রকম ফের ঘটে। দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত আমাদের দেশে ধর্ম, জাতিভেদ প্রথা এইগুলি হাতিয়ার হতে পারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। নাৎসি জার্মানিতে যেমন ‘জার্মান আর্য’ গর্ব বোধ তৈরি করা হয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে একটি অংশের বিরুদ্ধে বৈরিতা, শত্রুতার অনুভব তৈরি করা হয়। জার্মানিতে তাই দেখা গিয়েছিল— প্রচার হয়েছিল জার্মানি সবকিছু করতে পারে। এমন ধরনের একটি অহং করে গড়ে তোলা হয়, ফ্যাসিবাদের তাই চরিত্র। আমাদের দেশে তেমনই ‘বিশ্বগুরু’, রাজ্যে ‘বিশ্ববাংলা’র নামে অহঙ্কার তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। যখন বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিতর্কটি হচ্ছে, তখন উত্তরভারতে বাসে, অটো, রিক্শা সহ বিভিন্ন জায়গায় একটি স্টিকার দেখতাম ‘গর্‌ব সে বোলো হাম হিন্দু হ্যায়’। তার এক দশক আগে দেখতাম ‘মেরা ভারত মহান হ্যায়।’ তারও এক দশক আগে দেখতাম ‘কথা কম কাজ বেশি’। এই ধরনের বার্তাগুলি আসলে শাসক দল, শাসক গোষ্ঠী সে দেশের মানুষের মাথায় এসব গেঁথে দিতে চায়। তখন ইন্টারনেট আসেনি, হোয়াটসঅ্যাপ আসেনি, তখন এগুলো এই প্রবচনগুলি পোস্টারে, স্টিকারে, দেওয়াল লিখনে দেখা যেত। আজ এই পোস্টার, দেওয়াল লেখাগুলি দেখা যাচ্ছে না। মিডিয়ার সাহায্যে, ধর্মীয় গুরুদের ব্যবহার করে, ধর্মীয় স্থান, ধর্মীয় উৎসবকে ব্যবহার করে, তিথি নক্ষত্র দেখে এগুলিকে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে। 
যাঁরা রাজনীতি করেন, একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ, লক্ষ্য আছে, আছে ইতিহাস বোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত যাঁরা, ভারতের মতো দেশে বসবাসকারী নানা ভাষা, নানা বেশ, নানা জনগোষ্ঠীর মানুষকে এক সূত্রে বাঁধতে হলে, শাসকের এই একই বার্তায় গেঁথে দেওয়ার চক্রান্তগুলি সম্পর্কে তাঁদের উপলব্ধিতে থাকতে হয়। যেমন, যখন বাবরি মসজিদ ভাঙা হলো, একটি ঐতিহাসিক সৌধ ভাঙা হলো, ওরা বলল ধাঁচা, আসলে ওটা ছিল একটি ধাপ। একটি সিরিজের প্রথম ধাপ। সঙ্ঘ পরিবার বলেছিল,‘ইয়ে তো আভি ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা বাকি হ্যায়।’ সেখানে যে কুশীলবরা ছিলেন, তাঁরা এখন নেই। লালকৃষ্ণ আদবানী, কল্যাণ সিং, সাধ্বী ঋতাম্ভরা, উমা ভারতী, মুরলি মনোহর যোশী প্রমুখ। একটা নির্দিষ্ট সময়ে একেকজনের নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে। কিন্তু ধর্মভাবকে নমনীয় থেকে কঠোর করার এই অপপ্রয়াস চলেছে। সাধারণ ধর্মাবলম্বী মানুষ, ধার্মিক মানুষ বলেন বিশ্বাসের কথা। যেটা আসে মন থেকে কিংবা হৃদয় থেকে। যারা স্কিমার, যারা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন, তারা ধর্মের নমনীয় রূপকে মন কিংবা হৃদয় থেকে তুলে কঠোর অস্ত্র হিসাবে মগজে নিয়ে আসেন। যখন ধার্মিক মানুষ মন কিংবা হৃদয় থেকে ধর্মের কাছে আসেন, তখন সেটি হয় সমর্পণ। তিনি নিবেদিত হন। সেটাই যখন বিভিন্ন এজেন্সি মাথা খাটিয়ে, কৌশলে তাকে ব্যবহার করে, তখন তারা মানুষকে যা করায়, তা হলো সেই ভয়ঙ্কর রূপের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। দুয়ে তফাত আছে। এই আত্মসমর্পণ শুধু সংখ্যালঘুরা করেন না, তা সংখ্যাগুরু অংশের মানুষকেও বন্দি করে। তাঁর চিন্তা ভাবনা, চেতনা, যুক্তি, মুক্তচিন্তা কিছু থাকে না। সেই বিশ্বাসকে কঠোর করে তাঁকে পরিচালিত করা হয়। 
আশির দশকের মাঝামাঝি আমাদের দেশে, ধর্মকে, ভাষাকে হাতিয়ার করে, জাতীয় ঐক্য ভেঙে, সম্প্রীতিকে নষ্ট করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রয়াস নেওয়া হলো। যেমন শিখ ধর্মকে ব্যবহার করে ভিন্দ্রানওয়ালে- স্বর্ণমন্দির- খালিস্তান। আসামে ভাষাকে ব্যবহার করে বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করা হলো। কাশ্মীরে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদ তৈরি হলো। জাতীয় ঐক্যের পক্ষে বিপজ্জনক, বিভেদপন্থা মাথা চাড়া দিলো। তখনই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ‘একাত্মতা যজ্ঞ’ একটি যাত্রা বের করল। দেশের সব রাজধানী ঘুরে তারা হরিদ্বারে গিয়েছিল। সেই পথে কলকাতায় সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেছিল তারা। তার আগে যেসব রাজ্যে গিয়েছিল, সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীরা এই যজ্ঞর শিবিরে গিয়েছিলেন। শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। আমাদের এখানে মুখ্যমন্ত্রী তখন জ্যোতি বসু। তাঁকেও আমন্ত্রণ জানালো তারা। কমরেড জ্যোতি বসু এক কথায় নাকচ করে দিলেন। বললেন, আমি কেন যাবো? অনেকে বললেন জ্যোতি বসুর ঔদ্ধত্য। কিন্তু তা ছিল তাঁর দূরদৃষ্টি। যাঁরা আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলেন, জ্যোতি বসু তাঁদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনাদের উদ্দেশ্য কী? তাঁরা জানান, আমরা বিভিন্ন জায়গার নদীর জল কলস করে নিয়ে যাচ্ছি হরিদ্বারে। যাতে দেশকে এক সুরে বাঁধা যায়। সে সময়ে মধ্য প্রদেশে খরা হয়েছিল। জ্যোতি বসু বলেন, আপনারা খরার জায়গায় জল নিয়ে গেলেন না কেন? যাঁরা আমন্ত্রণ জানাতে গেলেন তাঁরা বুঝলেন কোথায় এসেছেন। এই হলেন জ্যোতি বসু। আসলে এরা যা বলে আর যা করে কিংবা করতে চায়, তা আলাদা। এরা বিশ্বাসকে ব্যবহার করে যুক্তিকে ভাঙতে। ধর্মীয় আভাকে ব্যবহার করে একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। সরকারি দল যখন এটা করছে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে করছে, তার দিকে বিরোধী দলগুলির নজর রাখতে হবে। বুঝতে হবে কেন করছে, কী করতে চাইছে? 
এখানে কমিউনিস্টদের তার দৃষ্টিভঙ্গি, মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা দেখতে হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে রক্ষা করা কমিউনিস্টদের দায়িত্ব। অন্যান্য বিরোধী দল মনে করে আমি কিছুটা বয়ে যাই এই ধারায়। তাতে আমার কিছু লাভ হতে পারে। কমিউনিস্টরা সেভাবে ভাবে না। তারা বুঝতে পারে এটা কোথায় আমাদের নিয়ে যেতে চাইছে। তাৎপর্যপূর্ণ হলো ওই ‘একাত্মতা যজ্ঞ’ যাঁর উদ্যোগে হয়েছিল, সেই স্বামী সুমিত্রানন্দর উদ্যোগেই পরে তৈরি হলো রাম জন্মভূমি মুক্তি মোর্চা। 
তালি একহাতে বাজে না, আর একটি হাত লাগে। তেমনই ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্রেও ‘বনাম’ তৈরি করা হয়। এখানে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের ধারণা সাধারণ বৈরি হিসাবে দাঁড় করাতে চাইবে সংখ্যালঘুদের। সেই সংখ্যালঘুরা ধর্ম, ভাষা, জাতিসত্ত্বা, গায়ের রঙ, পোশাক— নানা বিষয়কে ভিত্তি করে হতে পারেন। প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় এই সংখ্যালঘুরা ‘পিপল নট লাইক আস।’ স্বাধীনতা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সবকিছু একসূত্রে গেঁথে একদিকে দিকে নিয়ে যাওয়া। পরে তৈরি করা হলো দেশের মধ্যেই একটি অংশকে আর এক অংশের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার পথ। তাই যখন রাম জন্মভূমি মুক্তি মোর্চা তৈরি হলো, তারপরই বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি তৈরি হলো। সেখানেও ধর্মগুরু, রাজনীতিবিদ্‌দের দুদিকে এককাট্টা করার চেষ্টা হলো। একটি রেষারেষি তৈরির জন্য। ধর্ম বিশ্বাসকে প্রথমে সাম্প্রদায়িকতা করে তোলা হলো। তারপর তাকে ভিত্তি করে তৈরি করা হলো প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। ভারত ও পাকিস্তান বললে যতটা উৎসাহ তৈরি হয়, ভারত বনাম পাকিস্তান বললে তা উন্মাদনা তৈরি করে। হিন্দু ও মুসলমান, মন্দির ও মসজিদ— এই ছিল আমাদের সমাজে উচ্চারণ। তাকে আশির দশক থেকে ‘ও’ তুলে বসানো হলো ‘বনাম।’ দু’হাতে তালি বাজানোর জন্য। যেটা সমস্বার্থের বিষয় তাকে জলাঞ্জলি দেওয়া শুরু হলো। যাকে কেন্দ্র করে পরস্পর বিরোধী মনোভাবকে তীব্র করা যাবে, সঙ্ঘাত বাঁধানো যাবে, সেগুলিকে সামনে আনা হলো। এমন পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টদের কাজ হচ্ছে সমস্বার্থের বিষয়গুলিকে সামনে নিয়ে আসা— আন্দোলন সংগ্রামে, প্রচারে। বিভাজনকারী শক্তি সঙ্ঘাত তৈরি হওয়ার মতো বিষয়গুলিকে সামনে এনে সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মানুষদের মধ্যে উন্মাদনা তৈরি করে। সমাজের একটি বড় অংশের মধ্যে উন্মত্ততা তৈরি করা হয়। আমরা নব্বই দশকের দেখেছি করসেবার নাম করে এমন উন্মত্ততা তৈরি করা হয়েছিল। তারই পরিণতি মসজিদ ভাঙা, দাঙ্গা। পশ্চিমবঙ্গে এই পাশবিক উন্মত্ততা তৈরি করা যায়নি। তার অন্যতম প্রধান কারণ তখন জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার ছিল। রাজ্যে তখনও ধর্মবিশ্বাস ছিল। ধার্মিক মানুষ ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হিসাবে সেই মানুষের মগজকে যুক্ত করা যায়নি। এই সমাজের একটি বড় অংশের মধ্যে উন্মত্ততা তৈরির অন্যতম উপাদান হয় বিশ্বাস। মানুষের বিশ্বাস থাকে মনে, ধর্মগ্রন্থে, ধর্মস্থানে, ধর্মগুরুতে। রাজনীতির প্রোজেক্টের অংশ হয়ে গেলে তাকে টেনে হিঁচড়ে ধর্মগ্রন্থ, ধর্মস্থান থেকে রাস্তায় নামিয়ে আনা হয়। মনের থেকে টেনে আনা হয় রাজনৈতিক মঞ্চে। এরপর তাকে প্রবল প্রকাশ করার প্রয়াস দেখা যায়— তিলক পড়েছি বোঝাতে তা চওড়া করা হয়, টুপি পরেছি বোঝাতে বড় টুপি পড়া হয়। এটা দিয়ে ধর্মের, ধর্মানুরাগীর ভালো হয় না। ধর্মকে যে যন্ত্রের মতো ব্যবহার করছে লাভ হয় তার। সে তাকে নির্বাচনী অঙ্কে ব্যবহার করে। আসলে ধর্ম হাইজ্যাক হয়ে যায়। এখানেই আসে ধর্মানুরাগীর দায়িত্বের প্রশ্ন। সেই ধর্মের অনুরাগীর মানুষের দায়িত্ব তাঁকে বলতে হবে— ‘আমার ধর্ম, বিশ্বাসের নামে এটা কোরো না।’ কিন্তু এমন উন্মাদনা তৈরি করা হয় যে, এই কণ্ঠগুলি ক্ষীণ হয়ে পড়ে। এখন কী দেখছি? এমন উন্মদনা তৈরি হলো যে প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুরুদের, যারা কিছু বিরোধিতা করছেন, তাদেরও ভিলেন বানানো হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রকল্প এত প্রবল হয়ে যায় যে, তখন ধর্মগুরু, ধর্মস্থান, ধর্মীয় উৎসব, ধর্ম বিশ্বাস কিছুই রেহাই পায় না। 
আগে মানুষের উপর শোষণ চালানোর জন্য, শাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাজাকে বলা হতো ঈশ্বর প্রেরিত। আসলে ‘ঈশ্বর’ রাজা রানিকে সৃষ্টি করেননি। রাজা রানি সিংহাসনে আরোহণের পরে তার শোষণ, শাসন চলতে পারে সেই অনুসারে ধর্ম, ধর্মীয় চিহ্ন, ধর্মগুরু, এমনকি অধিষ্ঠাত্রী দেবদেবী তৈরি করে। যাঁদের এই বিষয়ে সন্দেহ আছে, তাঁরা মিউজিয়ামে গিয়ে রোম, গ্রিক, মিশর সাম্রাজ্যের নিদর্শন খতিয়ে দেখতে পারেন। একটি করে সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে, আর সেই সময়ের ‘ঈশ্বর’-রেও বিবর্তন হয়েছে নয়তো হারিয়ে গেছে। অর্থাৎ এই দেবদেবীরা সাম্রাজ্য রক্ষা করেননি। সাম্রাজ্যই সেই দেবদেবীর প্রতিষ্ঠা করেছে, রক্ষা করেছে নিজের স্বার্থে।
আজকের ভারতে বিগ্রহের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। ‘বিশ্বগুরু’ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরা নরেন্দ্র মোদীর অদম্য ইচ্ছা। প্রশাসন, দল, সঙ্ঘ পরিবারের সবকটি সংগঠন নেমে পড়েছে। এই সবই একদিকেই নির্দেশ করছে, সরকার বা প্রধানমন্ত্রী বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করছেন না। রামের আবার নতুন করে কী প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন? আসলে মোদী তাঁরই প্রতিষ্ঠা করছেন। 
এর একটি ধর্মতত্ত্বর দিক আছে। এটি হিন্দু ধর্মের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। হিন্দু ধর্মকে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে। খ্রিস্টান, ইহুদি, ইসলামের মতো যেগুলি সেমিটিক ধর্ম, এগুলিতে একটি নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ থাকে। একজন নির্দিষ্ট ঈশ্বর-প্রেরিত দূত থাকেন। একটি নির্দিষ্ট ধর্মস্থান থাকে। আর কিছু নির্দেশনামা থাকে— কী করা যাবে, কী করা যাবে না। কিন্তু কিছু ধর্মের এমন থাকে না। যেমন হিন্দু ধর্মের নেই। হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসেই অনেক বৈচিত্র আছে। সঙ্ঘ পরিবার এটিকে কেন্দ্রীভূত করতে চাইছে। অযোধ্যাকে এই জন্যই এত প্রোমোট করা হচ্ছে। এক দেবতা, এক ধর্মগ্রন্থ, এক ধর্মীয় স্থানে বাঁধতে চাইছে। কিন্তু করার কথা ছিল কী? দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কী কী বলেছিল বিজেপি, নরেন্দ্র মোদী? প্রতিশ্রুতি ছিল— কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে, সকলের জন্য পাকা বাড়ি হবে, বছরে ২কোটি কাজ হবে, কালো টাকা উদ্ধার হবে এবং তা নাগরিকদের অ্যাকাউন্টে ১৫লক্ষ করে ঢুকে যাবে এমন কত কিছু। তার বদলে চেষ্টা হচ্ছে হিন্দু ধর্মকে এককেন্দ্রীক করা। দেশকে ঠিক করার বদলে হিন্দু ধর্মের বৈচিত্রকে কঠোর, একমুখী করার চেষ্টা হলো।
আমাদের রাজ্যে আমরা কী দেখছি, নবজাগরণের সময়, রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বদের উদ্যোগে থেকে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। আমাদের রাজ্যে উত্তর ভারতে যা সম্ভব হয়েছে তা রাতারাতি সম্ভব হয়নি। আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে তা প্রয়োগ করার জন্য একটি বাইপাসের আশ্রয় নেয়। সেই লক্ষ্যে প্রথমে তৃণমূল কংগ্রেস সৃষ্টি করা হয়। মমতা ব্যানার্জিকে তার নেতা হিসাবে তৈরি করা হয়। ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মেলানোর বিরোধিতার যে পরিবেশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো ব্যক্তিত্বদের উদ্যোগে দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়েছিল তাকে ভাঙা হলো। রাজনীতির মঞ্চে ধর্মকে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা হলো তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে। ধর্মীয় উৎসব, ধর্মীয় প্রতীক, ধর্ম বিশ্বাসকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হলো। আমরা দেখলাম আরএসএস গীতা পাঠের কথা বলল, তৃণমূল বলল চণ্ডীপাঠের কথা। আরএসএস রামনবমী পালন করার কথা বলল, রাজ্যের মন্ত্রীদের নামিয়ে দিলেন রামনবমী পালন করতে। অর্থাৎ রাজনীতির মূল কথা ওরা করতে চাইল ধর্মকে। বামপন্থীরা তখন কাজের দাবি, মানুষের জীবন জীবিকার সমস্যা, দুর্নীতির মতো বিষয়ে আন্দোলন করছেন। এখন দেখা গেল যে রাজ্যে একটা সমাবেশ ডাকতে হলে হাইকোর্টে যেতে হয়, হঠাৎ সেই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন চারটি ধর্মস্থান ঘুরে মিছিল যাবে। কোনও কর্মসূচি করতে গেলে ১৫ দিন আগে নোটিস দিতে হয়, সেখানে এই ক্ষেত্রে সে সবের কোনও বালাই নেই। ঠিক এমনই দেখা গেল অভিষেক ব্যানার্জি যখন কোনও অনুমতি ছাড়া কর্মসূচি করলেন। 
২২ তারিখ মমতা ব্যানার্জি জানালেন কালীঘাটে পুজো দিয়ে আরও তিনটি ধর্মস্থানে যাওয়া উচিত। অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আগামী লোকসভা নির্বাচনে যে তরী পার হতে চাইছে বিজেপি, ইনি তার বিরোধিতা করার বদলে তার ভিত্তি তৈরি করতে সাহায্য করছেন। এখানেই আরএসএস-এর কৌশলী চিন্তার প্রয়োগে মমতা ব্যানার্জির প্রয়োজনিয়তা। মাত্র একমাস আগে গীতাপাঠের মাধ্যমে যা জমাতে পারেনি, এখনও এত টাকা খরচ করে, রাজনৈতিক ‘চাল’ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে দেখছে ভাত ফুটছে না, তখন মমতা ব্যানার্জি তাতে উত্তাপ সৃষ্টির জন্য উৎপাত সৃষ্টি করলেন। যখন প্রয়োজন রাজ্য প্রশাসনের, প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের কর্মীদের রাস্তায় নামানো, বিশেষত মিশ্র এলাকায়, সংবদনশীল এলাকায়, তখন তিনি গোটা প্রশাসনকে নিয়ে কেন্দ্র হতে চাইলেন। এটা হলো রেষারেষি। রেষারেষি না হলে, ‘বনাম’ না হলে সঙ্ঘের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। মমতা ব্যানার্জি এমন ‘বনাম’ তৈরি করেছেন। কখনও রামমন্দির বনাম জগন্নাথ মন্দির, কখনও তোমার মন্দির বনাম আমার চারটি ধর্মস্থান।
মোদ্দা কথা হচ্ছে ধর্ম আশ্রিত, ধর্ম মিশ্রিত ধর্মীয় আবেগকে সুড়সুড়ি দেওয়ার রাজনীতি। তাই সঙ্ঘের, বিজেপি’র বিরোধিতা যেমন করতে হবে, তেমনই মমতা ব্যানার্জির এই ‘বনাম’-এর রাজনীতি, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করতে হবে। ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ভাঙার কয়েকদিন আগে, তিনি কংগ্রেসে থাকলেও শহীদ মিনারের সভায় বলেছিলেন, ‘অযোধ্যায় কিছুই হবে না। ওসব সিপিএম’র চক্রান্ত।’ তিনি সেদিনও বাংলার মানুষের মনোভাবকে বিজেপি, সঙ্ঘর বিরোধিতার বদলে সিপিআই(এম) বিরোধিতায় প্রবাহিত করতে চেয়েছিলেন।
যে কোনও মূল্যে ঐক্য সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। এদের রাজনৈতিক প্রকল্পকে প্রতিহত করতে হবে। বাংলা তার ইতিহাসবোধ থেকে, তার স্বকীয়তা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেবে। আমরা কোনও প্ররোচনা, কোনও গুজবে পা দেবো না।

Comments :0

Login to leave a comment