Indian Statistical Institute Bill

মহলানবীশের প্রতিষ্ঠানে হাত বাড়াচ্ছেন মোদী!

ফিচার পাতা

ড. অরিন্দম গুপ্ত

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার “Indian Statistical Institute Bill, ২০২৫” নামে একটি নতুন বিল প্রকাশ করেছে। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ও প্রতিষ্ঠানটি সম্বন্ধে জানেন, এমন বহু শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই বিল নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যা নিয়ে চর্চার প্রয়োজন রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠান যা আইএসআই নামেই অধিক পরিচিত তৈরি হয় ১৯৩১ সালে। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধীনে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি পথ চলা শুরু করে। দেশের পরিসংখ্যান, অর্থনীতি, গণিত সম্বন্ধীয় গবেষণার  ক্ষেত্রে এটি দ্রুতই একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। আইএসআই’র ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটিও বিশেষভাবে যুক্ত। মহলানবীশ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাজে উৎসাহ দিতেন এবং তাঁর পরিসংখ্যান সংক্রান্ত কাজেও আগ্রহ দেখাতেন। রবীন্দ্রনাথই মহলানবীশকে ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপরই মহলানবীশ পরিসংখ্যান সংক্রান্ত কাজ শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধেই মহলানবীশ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতেন এবং রবীন্দ্রনাথই তাঁকে বিদেশ সফরেও সহযোগী হিসেবে নিয়ে যেতেন।
নেহরু এবং প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের পেশাগত সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয় ১৯৪০ সালে এলাহাবাদে এক বৈঠকের পরে। বৈঠকে তাঁরা ভারতে পরিসংখ্যান এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এই সময় থেকেই নেহরু মহলানবীশের কাজে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। 
স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটি আলাদা গুরুত্ব পায়। দেশে তখন উন্নয়নের পরিকল্পনা গড়ে অগ্রগতির লক্ষ্যে কাজ চলছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে এদেশেও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে আইএসআই’র নেতৃত্বমূলক ভূমিকার ভিত্তি তৈরি হয়। আইএসআই’র গবেষণার ফলে ন্যাশনাল স্যম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশনের জন্ম হয় যা আজও এদেশে NSSO তথ্যভিত্তিক নীতি নির্ধারণের মূল ভিত্তি। ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার আইন পাস করে এটিকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের (Institution of National Importance) স্বীকৃতি দেয়। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠানটিকে ‘public good research’—অর্থাৎ দেশের পরিকল্পনা, তথ্য সংগ্রহ এবং মৌলিক গবেষণা সংক্রান্ত কাজের জন্য গড়ে তোলা। তারপর থেকে আইএসআই কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা রূপায়ণ মন্ত্রকের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে এসেছে। কম্পিউটার সায়েন্স সহ আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। দীর্ঘদিন ধরে এর শিক্ষায়তনিক (Academic) ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে।
১৯৫৯ সালের আইন অনুযায়ী আইএসআই স্বাধীনভাবে পরীক্ষা নেওয়া এবং ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। গোড়া থেকেই এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষাক্ষেত্রে এবং দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে এখানে টিউশন ফি নেই, বরং শিক্ষার্থীরা স্টাইপেন্ড পায়। তবে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কিছু নতুন কোর্সে— যেমন বিজনেস অ্যানালিটিক্স, ডেটা সায়েন্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফি নেওয়া শুরু হয়েছে। আইএসআই’র সদর দপ্তর কলকাতায়, প্রধান অধিকর্তা এখানেই বসেন। এর বাইরে ৪টি কেন্দ্র আছে- দিল্লি, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু ও তেজপুরে। 
দেশের বিকাশে আইএসআই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পেরেছে এর স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার জন্য। ১৯৫৯ সালের আইনের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষায়তনিক ও প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। মেধাবী ছাত্রছাত্রী ও বিজ্ঞানীদের প্রতিভা বিকাশের সহায়ক ছিল এই ব্যাবস্থা। আইএসআই এখন একটি নিবন্ধিত (Registered) সোসাইটি। সরকার অর্থ দিলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সোসাইটির কাউন্সিলের হাতে। বর্তমানে কাউন্সিলে ৩৩ জন সদস্য রয়েছেন যার মধ্যে ১০ জন অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত। সোসাইটির গভর্নিং বডি দ্বারা নির্বাচিত হন ৩ জন, ডিরেক্টর, কেন্দ্রগুলি থেকে ৩ জন, কাউন্সিল ও সরকার কর্তৃক ৯ জন মনোনীত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, ৬ জন সরকারি প্রতিনিধি। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন একাডেমিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ডিরেক্টর বাছাই করা হয় নির্বাচনী কমিটির মাধ্যমে, যেখানে বাইরের বিশেষজ্ঞরাও থাকেন। এই কাঠামো কোনো একক পক্ষকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয় না এবং গণতান্ত্রিক ভারসাম্য বজায় রাখে ও বিজ্ঞানীদের মতামত প্রাধান্য পায়।
ঠিক এই কারণেই নতুন বিলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 
(১) নতুন বিল ১৯৫৯ সালের আইনের জায়গায় পুরো নতুন একটি কাঠামো আনতে চায়। সেখানে স্বায়ত্তশাসনকে আক্রমণ করা হয়েছে। নতুন আইন কার্যকরী হলে আইএসআই এবার ‘Body Corporate’ হিসাবে গঠিত হবে, যেখানে ‘Board of Governors’-এর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য মনোনীত হবেন সরকারের দ্বারা। ডাইরেক্টর ও ডিন নিয়োগও সরকারের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করবে। এর মানে, অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের বৈজ্ঞানিকদের যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রায় শূন্যে নেমে যাবে। আইএসআই’র সিদ্ধান্তগ্রহণ সম্পূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দখলদারিত্ব কায়েমের আশঙ্কা তৈরি হবে।
(২) পুরনো আইনে সরকার নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সীমিত সময়ের জন্য প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিতে পারত। নতুন বিল সেই সীমা তুলে দিয়ে স্থায়ী সরকারি নিয়ন্ত্রণের পথ খুলে দিচ্ছে। 
(৩) নতুন বিলে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্থিতিশীলতা (Financial Sustainability), সম্পদ সৃষ্টি (Resource Generation) এবং ব্যবহারিক পরামর্শ পরিষেবার (Applied Consultancy) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আইএসআই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে গুরুতর পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। দেশে গঠনের বদলে এই প্রতিষ্ঠানকে এখন রাজস্ব উৎপাদক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এর ফলে নিখরচায় মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ দিয়ে জ্ঞানীয় সম্পদ তৈরির দিকে মনোযোগ কম দেওয়া হবে। ব্যবসায়িক দিকে ঝুঁকতে পারে আইএসআই। 
(৪) সরকার এই মনোভাবে এগলে ভবিষ্যতে সরকারি অর্থ বরাদ্দ কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে আইএসআই’তে। 
(৫) আইএসআই একটি গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান যার শক্তি আধুনিক বিজ্ঞান সহ মৌলিক গণিত, সম্ভাব্যকতা (probability) এবং পরিসংখ্যানের বিজ্ঞানসম্মত চর্চায়। মানবকল্যাণে এর ব্যবহারের বদলে কর্পোরেটকেন্দ্রিক নীতিতে মৌলিক গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং প্রতিষ্ঠানটির মূল চরিত্র বদলে যাবে। 
(৬) এতদিন আইএসআই স্বাধীনভাবে পরীক্ষা নেওয়া এবং ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতা রাখত। নতুন আইন কার্যকর হলে এই ক্ষমতাকে বোর্ড এবং সরকারের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল করে দেবে। ফলে পাঠক্রম, নিয়োগ এবং গবেষণার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে।
(৭) নতুন বিল লাগু হলে শিল্প, বাণিজ্য এবং কর্পোরেট সহযোগিতা অগ্রাধিকার পাবে। ফলে আইএসআই’র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগত ভাবমূর্তি ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
(৮) ঐতিহাসিক কারণেই আইএসআই’র সদর দপ্তর কলকাতায়। এই দপ্তরে বিজ্ঞানীদের গবেষণা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেমন খ্যাূতি অর্জন করেছে, তেমনি তা সাহায্য করেছে রাজ্যের অন্যান্য গবেষকদেরও। ফলে পশ্চিমবঙ্গে বিজ্ঞানের গবেষণাকে উন্নত করার জন্যও এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আছে। নতুন খসড়া আইনটি রূপায়িত হলে আইএসআই’র সদর দপ্তর কলকাতায় থাকা বাধ্যতামূলক থাকবে না। ফলে প্রশাসনিক কেন্দ্র অন্যত্র সরানো হতে পারে, যা কলকাতা তথা এই রাজ্যে আরও গবেষণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
(৯) প্রস্তাবিত বিল প্রকৃতপক্ষে আইএসআই’র স্বায়ত্তশাসন ও একাডেমিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করবে। ১৯৫৯ সালের আইন যে ভারসাম্য ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিল, নতুন বিল তা বাতিল করে আইএসআই-কে সরাসরি সরকারের অধীন একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। এটি শুধু আইএসআই নয়, ভারতের অন্যান্য স্বশাসিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যও অশনি সংকেত। জ্ঞানের স্বাধীন চর্চার কেন্দ্রে কোনো সঙ্কীর্ণ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ঘটলে তা দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে না। 

Comments :0

Login to leave a comment