শিবানন্দ পাল
আপনি কি আপনার শিশু সন্তানকে হাতে লেখায় উৎসাহিত করেন? যদি না করেন তাহলে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিন! কারণ নতুন একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে শিশুরা নিজের হাতে লেখে, তারা টাইপ করা শিশুদের তুলনায় লেখাপড়ায় ভালো। সেজন্য হাতের লেখার অনুশীলন শিশুদের লেখাপড়ার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আজকাল অনেক স্কুলে শিশুদের হাতে ডিজিটাল সরঞ্জাম ধরিয়ে দিতে পারলেই স্কুল কর্তৃপক্ষ মনে করে তাঁদের অর্ধেক কাজ হয়ে গেল। এক শ্রেণির স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে ভীষণভাবে উৎসাহ দেয়, অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে প্রচার চালায়, নইলে নাকি শিশুরা স্মার্ট হবে না। পিছিয়ে পড়বে। বিজ্ঞাপনী চমকে অভিভাবকদের অনেকেই এগুলি বিশ্বাস করেন এবং চড়া ফিজ দিয়ে স্মার্ট গড়বার জন্য শিশুদের সেই সব স্কুলে ভর্তি করেন। সমাজে বিষয়টি দিন দিন সংক্রামক ব্যাধির চেহারা নিচ্ছে।
কিন্তু স্পেনের অন্যতম সেরা শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাস্ক কান্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণা করে স্পষ্ট জানিয়েছেন, হাতের লেখার পরিবর্তে যে শিশুরা কীবোর্ড ব্যবহার করে তারা যথাযথ মেধা অর্জন করতে পারে না। তাঁরা বলছেন, পাঁচ-ছ বছর বয়সে, শিশুরা নিজেদের বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ স্তর অতিক্রম করে। এই সময় অক্ষরের চেহারা, অক্ষর সম্পর্কে শিশুরা প্রথম ধারণা পায়। অক্ষর, শব্দ এগুলো গঠন করতে শেখে। তাই লেখাপড়া শেখানোর ক্ষেত্রে যে শিশুরা নিজেদের হাতে লিখে লেখাপড়া শেখে তারা বেশি মেধাবী নাকি যারা কী বোর্ডের মাধ্যমে লেখাপড়া বেশি পছন্দ করে? কোন মাধ্যম বেশি কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে? বিষয়টা জানার জন্য তাঁরা কতকগুলি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। ৫০ জন শিশুকে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি ভাষার (আর্মেনিয়ান এবং জর্জিয়ান) বর্ণমালা দেওয়া হয়। যেহেতু শিশুরা স্প্যানিশ ভাষী, তাই বর্ণমালার অক্ষরগুলো এমন দেওয়া হয় যেগুলো স্প্যানিশ ভাষায় উচ্চারণের অনুরূপ। এরপর শিশুদের অক্ষরগুলো দিয়ে দুটো-অর্থপূর্ণ শব্দ তৈরি করতে শেখানো হয়। বাংলা বর্ণমালায় বলা যায় যেমন দুই অক্ষরের শব্দ- আম, জাম!
গবেষক দলের প্রধান জোনা আচা ব্যাখ্যা করেন, অপরিচিত ভাষার অক্ষর ব্যবহার করা হয় এজন্য যে, আমরা নিশ্চিত হতে চেয়েছি শিশুরা সকলে একসাথে প্রথম শিখুক। সকলের মাতৃভাষা স্প্যানিশ। স্প্যানিশ অক্ষর দিলে শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই পরিচিত হতে পারে। তাই নতুন আনকোরা ভাষা ব্যবহার করা হয়। ভাষা শেখার পদ্ধতি এবং তার অগ্রগতিকে পরিমাপ করার জন্যই এই ব্যবস্থা।
শিশুদের প্রথমে চারটি দলে ভাগ করা হয়। দুটো দলকে দিয়ে হাতে অক্ষর এবং শব্দ লেখানো হয়। একটা ডটেড গাইড ব্যবহার করে সেগুলো ট্র্যাক করা হয় এবং অন্যটি সেগুলি অনুলিপি করে। অন্য দুটি দল একটি একক ফন্ট অথবা একাধিক ভিন্ন ফন্ট ব্যবহার করে কীবোর্ডে টাইপ করে। গবেষকরা কেবল শিশুদের হাতের নড়াচড়ার প্রভাব, যাকে গ্রাফোমোটর অ্যাক্টিভিটি বলা হয়, তা নয়, অক্ষরের আকারের বৈচিত্র কীভাবে শিক্ষার্থীদের উপর প্রভাব ফেলছে তাও পরীক্ষা করছিলেন। প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রে নতুন অক্ষর এবং শব্দ শনাক্তকরণ, উচ্চারণ এবং লেখার ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়েছিল। পরীক্ষার ফলাফলগুলো দেখা যায় আশ্চর্যজনক।
যে শিশুরা পেন্সিল এবং কাগজ ব্যবহার করেছে তারা সব থেকে ভালো পারফর্ম করেছে। অক্ষরের আকার এবং উচ্চারণ স্পষ্ট মনে রাখতে পেরেছে। শব্দগুলো নির্ভুলভাবে লিখতে পেরেছে। শব্দের গঠন মনে রাখার ক্ষেত্রে এগুলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলেই গবেষকদের মনে হয়েছে। উল্টোদিকে যেসব শিশু টাইপ করে শিখছিল তারা প্রায়শই অক্ষরের ক্রম গুলিয়ে ফেলেছে। 'আম' লেখার জায়গায় 'মআ', 'জাম' লেখার পরিবর্তে 'মজা' লেখার মতো ভ্রান্তি করেছে। শব্দগুলো সঠিকভাবে সম্পূর্ণ করতে পারেনি।
জোনা আচা বলেছেন, গ্রাফোমোটর ফাংশন- অক্ষর তৈরি করতে হাত কীভাবে নড়াচড়া করে, রেকর্ড করে। অক্ষর এবং শব্দের গঠন উভয়ই মুখস্থ করার জন্য অপরিহার্য। যখন আমরা হাতে লিখি, তখন প্রতিটি অক্ষরের আকৃতিকে তৈরির জন্য আমাদের মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় নড়াচড়ার সাথে সংযুক্ত করে। একটি কী টিপে লেখার চেয়ে এতে শক্তিশালী স্মৃতি সংযোগ তৈরি হয়। বুদ্ধিমত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে এই স্মৃতি সংযোগ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণা এখানেই থেমে নেই। অক্ষর এবং শব্দের ভিজ্যুয়াল অর্থাৎ চাক্ষুষ উপস্থাপনার ব্যাপারটা কীভাবে হয়, শিশুদের শেখার ওপর তা কিরকম প্রভাব ফেলে, তাও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। পরীক্ষার সময়, হাতের লেখার শিশুরা একই রকমের ফন্ট দেখতে পেয়েছে। কিন্তু কীবোর্ডের শিশুরা বিভিন্ন ধরনের ফন্ট দেখতে পেয়েছে। অর্থাৎ হাতের লেখার শিশুরা নিজেদের মগজাস্ত্র প্রয়োগ করে কোনও নির্দেশিকা ছাড়াই নিজেরা দ্রুত অক্ষর আঁকতে সক্ষম হয়েছে। তাদের মস্তিষ্ক অক্ষর চিনতে এবং শব্দ সনাক্ত করতে সক্ষমতা দেখিয়েছে।
শিশুমনে যখন অক্ষরজ্ঞান তৈরি হয়, তখন তাদের মস্তিষ্কে অক্ষরের মূল বৈশিষ্ট্য চিরায়তভাবে প্রোথিত হয়ে যায়। গবেষকরা দেখেছেন, হাতে লেখা অক্ষরগুলির ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ইমেজিং সক্ষমতা মস্তিষ্কের সেই অংশকে গভীরভাবে সক্রিয় করে যা অক্ষর শনাক্তকরণে ট্রেসিং বা টাইপিংয়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। প্রতিবার লেখার ক্ষেত্রে অক্ষরের ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ প্রলেপ, মস্তিষ্ককে বুঝতে সাহায্য করে যে কোন কারণে অক্ষরটি অনন্য। শিশু যখন হাতে লেখে, হাত এবং আঙুলের প্রতিটি প্রয়োজনীয় নড়াচড়ার সাথে অক্ষরের আকৃতি তার মস্তিষ্কে গ্রোথিত হয়। যা কী বোর্ডে লেখার চেয়ে শক্তিশালী স্মৃতি সংযোগ তৈরি করে। দাগা দিয়ে বা আঙুল বুলিয়ে পড়ার ফলে দুটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়। একটি অক্ষর চেনার, দ্বিতীয়টি বর্ণগুলো কীভাবে একত্রিত হয়ে শব্দ গঠন করে তার সক্ষমতা অর্জন। এগুলোকে বর্ণানুক্রমিক অর্থোগ্রাফিক জ্ঞান বলা হয়।
বর্ণমালার জ্ঞান শিশুদের প্রতিটি অক্ষরের আকৃতিকে তার উচ্চারণ ধ্বনির সাথে সংযুক্ত করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, "ফ" অক্ষরটি /ফ/ ধ্বনি তৈরি করে। অন্যদিকে উচ্চারণ সংক্রান্ত জ্ঞান তাদের মনে রাখতে সাহায্য করে যে কীভাবে অক্ষরগুলি একত্রিত হয়ে প্রকৃত শব্দ তৈরি করে। যেমন "ফুল" বানানের সঠিক বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ হল "ফ-ু-ল"। "ফুল" হিসাবে লেখা এবং 'ফুল' ধ্বনি উচ্চারণ করা। যার অর্থ গাছের ফুল।
গবেষকরা দেখেছেন যে লেখার মাধ্যম অক্ষরের আকৃতি নির্বাচন এবং তার সঠিক উচ্চারণ দুটি দক্ষতাই উন্নত করে। যখন শিশুরা হাত বা আঙুল দিয়ে অক্ষর তৈরি করে, তখন তার মস্তিষ্ক অক্ষরের আকৃতি এবং শব্দের উচ্চারণ উভয়কেই কপি করে। সময়ের সাথে সাথে তা বানান, পঠন সাবলীলতা এবং মস্তিষ্কের শব্দভান্ডার বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। গবেষণার একটি অংশে দেখা গেছে, যেসব বাচ্চারা বিভিন্ন ফন্ট ব্যবহার করে টাইপ করে, তারা একই ফন্ট ব্যবহার করা বাচ্চাদের তুলনায় কিছুটা ভালো ফল করে বটে। তবুও যারা নিজের হাতে লেখে তাদের তুলনায় ভালো ফল করতে পারে না। গবেষক জোনা আচা স্পষ্টভাবে বলেছেন, "প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি শুধু পরিপূরক উপায়ে ব্যবহার করা উচিত। প্রাথমিক শিক্ষায় হাতের লেখাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।"
জার্নাল অফ এক্সপেরিমেন্টাল চাইল্ড সাইকোলজির জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণা পত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে, হাতের লেখার ফলে অক্ষর শনাক্তকরণ এবং পড়ার দক্ষতা উন্নত হয়। হাতের লেখা পড়ার সময় মস্তিষ্কের অংশগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে, অক্ষরের সাথে প্রাথমিক পরিচয়কে শক্তিশালী করে।
হাতে লেখা শুধু একটি ঐতিহ্য নয়, এটি পড়ার দক্ষতা বৃদ্ধি করে। শিশুদের আঙুল দিয়ে অক্ষর আঁকতে শেখালে তাদের মস্তিষ্ক সেগুলো ভালোভাবে মনে রাখতে সাহায্য করে এবং যখন তারা অবাধে, কোনও মডেল বা ফন্ট ছাড়াই কাজটি করে, তখন তারা খুব দ্রুত শেখে। সেজন্য পেন্সিলের পরিবর্তে কীবোর্ড ব্যবহার করানোর আগে স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবকদের দু’বার ভাবা উচিত। আঙুল দিয়ে পড়তে শেখানো শুরু করা উচিত। কারণ আঙুলের মধ্যে দিয়ে বইয়ের জ্ঞান মস্তিষ্কে সঞ্চারিত হয়। মস্তিষ্কে তা স্থায়ী হয়। মস্তিষ্ক মনে রাখে।
Handwriting
হাতের লেখার অনুশীলন কেন জরুরি
×
Comments :0