Modi

গরিবীর বদলে গরিব মুছতে গিয়ে ধরা পড়লেন মোদী

জাতীয়

প্রতি ৪০ মিটার অন্তর নিজের একটা ছবি লাগিয়েও লাভ হলো না। সবুজ কাপড়ে ‘আসল ভারত’কে মুড়ে রাখার চেষ্টাও মাঠে মারা গেল। জেলে পুরে, ধমকিয়ে-চমকিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমের মুখ ‘অনেকটাই’ বন্ধ রাখা গেলেও, আদর করে ডেকে আনা দেশের সংবাদমাধ্যম ধরে ফেলেছে মোদীর ‘ব্লাফ’। দু’দিনের মহাসমারোহ ঘিরে মোদী সরকারের আয়োজন দেখে তারা এখন খুল্লাম-খুল্লাই লিখছে, বিশ্বগুরু সাজতে মশগুল মোদী দেশ থেকে গরিবী দূর করতে না পেরে গরিবদের উৎখাতের বন্দোবস্ত করেছে। ফরাসি দৈনিক ‘ল্য মোঁদ’ থেকে বোস্টনের ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটার’ কিংবা এশিয়ার জাপানের ‘নিক্কেই এশিয়া’ কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছে বিবর্ণ ভারতকে আড়ালে রাখতে মোদীর উচ্ছেদ নীতিকে। আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ তো লিখেই দিয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদী আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফ্রান্সের লি পেন কিংবা হাঙ্গেরি ভিক্টর আরবানের মতাদর্শকেই বেছে নিয়েছে।’
২০১১-র লোকগণনা অনুযায়ী ২কোটির আবাদির দিল্লিতে সরকারি হিসাবে ৪৭হাজার মানুষের মাথার উপর ছাদ ছিল না। সমাজকর্মীদের হিসাবে অবশ্য রাজধানী দিল্লিতে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা অন্তত দেড় লক্ষ। জি ২০’র বৈঠককে সামনে রেখে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে দিল্লিতে শুরু হয়েছে বুলডোজার শাসন। ‘বেআইনি দখলদারি’ হটানোর অজুহাতে দিল্লি থেকে ধাপে ধাপে মুছে ফেলা হয়েছে গরিব মানুষের আবাস স্থলগুলিই। 
ফরাসি দৈনিক সেসব তুলে ধরেই একহাত নিয়েছে মোদীকে। লিখেছে, ‘মোদী ভারতকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি বানানো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর তার সেই ল্যান্ডস্কেপকে নষ্ট করতে পারে এমন কিছু নির্মূল করতে কোনোরকম খরচ করতেই ছাড়েননি তিনি: ছোটখাট দোকান, হোক বা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কুকুর, কিংবা বাঁদরের দল- সকলকে তাড়ানো হয়েছে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে শহর থেকে কীভাবে হাজার কুকুর অবৈধ ও নিষ্ঠুরভাবে ধরা হয়েছে, তার ফাঁস করে দিয়েছে একটি প্রাণী সুরক্ষা সংস্থা। শুধু কি তাই, ট্রাফিক সিগনালে যে বাচ্চাগুলি ভিক্ষে করে, তাদেরও চলে যেতে বলা হয়েছে। অন্তত ২৫টি বস্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওবা হয়েচে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে উৎখাত করা হয়েছে, কোনও বিকল্প মাথা গোঁজার জায়গা ছাড়াই। এই মানুষগুলি তাঁদের জীবিকা হারিয়েছেন।’ 
নিজের দেশের সংবাদ মাধ্যমে আসল খবর না বেরোলেও বিদেশি দৈনিকে যখন তাঁদের দুর্দশার কথা আসছে শুনে বস্তি সুরক্ষা মঞ্চের আবদুল শাকিল বললেন, ‘সৌন্দর্যায়নের নামে শহরের গরিবদের জীবন ধ্বংস করা হয়েছে।’ আর প্রগতি ময়দানের কাছের এক বস্তির রঙের মিস্ত্রি মুহম্মদ নাসিরুদ্দিন জানালেন, তিনদিন ধরে তিনি কাজেই বের হতে পারছেন না। প্রগতি ময়দানের এলাকায় এখন উৎসবের ঝলকানি। ফুটপাথের সঙ্গে রাস্তাতেও ঘন ঘন সাফাই হচ্ছে। আর নাসিরুদ্দিনের বস্তির মুখ ঢাকা পড়েছে সবুজ আলখাল্লায়। যার মাঝে খানিক তফাতে ‘প্রাইম মিনিস্টার অব ভারত’-এর হাসিমুখ। সেই হাসিমুখের আস্তরণ সরিয়ে কখনও সখনও উঁকি দিচ্ছে গরিব-গুর্বোর মুখ। নাসিরুদ্দিন জানালেন, ‘সকালের দিকে কড়াকড়ি খুব বেশি হচ্ছে। আমাদের কাউকে বেরোতেই দেওয়া হচ্ছে।’ ওই হাফিজ নগরেরই বছর আঠারোর এক সাফাই কর্মী জানালেন, ‘আমরা রাস্তায় নামলেই পুলিশ জেরা করছে। ফিরিয়ে দিচ্ছে জোর করে’। 
খানিকটা দুরের জনতা ক্যাম্পেও একই অভিজ্ঞতা। বাড়ি বাড়ি গ্যাস সিলিন্ডার পৌঁছে পেট চলে বছর পঁয়ত্রিশের করণ পালের। সরাই কালে খানে দোকানে পৌঁছাতে গত সাতদিন অন্ধকার থাকতেই বেরিয়ে পড়তে হয়েছে করণকে। এক সপ্তাহ ধরে মুরগি মাংসের দোকানটা খুলতে পারেননি বছর বাইশের পারভেজ। শোনালেন, ‘সবসময় সব জায়গায় পুলিশ। ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের ঘরেই থাকতে বলা হয়েছে।’
দক্ষিণ দিল্লির বসন্ত বিহারের কুলি ক্যাম্পে বছর ষাটের মুন্না লালের পান-বিড়ির দোকান। নেলসন ম্যান্ডেলা মার্গের সামনে সেই দোকান থেকে দিনে দু’-তিন হাজার টাকা আয় হয় যায়। কিন্তু মোদীর বিশ্বগুরু সাজার বাসনা কুলি ক্যাম্পকে সবুজ কাপড়ে মুড়ে ফেলেছে। রবিবার কথা বলতে যেতেই খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘কাহাঁ হ্যায় কাম?’ জানালেন, সকাল থেকে মাত্র ৪০ টাকা কামাই হয়েছে।’ 
নয়ডায় সেকশন ১৬ মেট্রো স্টেশনের কাছে জে জে কলোনির মুখ ঢাকা পড়েছে সবুজ বিশাল টিনের শিটের আড়ালে। দিল্লি-নয়ডা ফ্লাইওয়ে থেকে যেন গরিবি চোখে না পড়ে তাই এমন বন্দোবস্ত। সেখানেই সুনীল কুমারের মুদির দোকান। দোকান কর্মী মহম্মদ সালিমের কথায়, এখন এখানে দম ঘুটতা হ্যায়। আমারই দমবন্দ হয়ে যাচ্ছে। কাস্টোমার কী আসবে। ক্রেতার অভাবে মাছি তাড়ানো দোকান মালিকের খেদ, ‘যো দিখতা হ্যায় ওহি বিকতা হ্যায়। পার হামেঁ তো গায়েব হি কর দিয়া গায়া হ্যায়’।  
দিল্লি আর লাগোয়া দিল্লির গরিব মানুষ এখন এনটাই মনে করছেন। বলছেন, ’আমাদের ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা হয়েছে।’ বোস্টনের পত্রিকাটি লিখেছে, ‘ভারত সরকার দারিদ্র আড়াল করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছে। গরিবের মর্যাদা ছিনিয়ে নিয়েছে।’
আসলে দারিদ্র আড়ালের শুরু থেকেই চেষ্টা হয়েছে, ওকটি লোককেই তুলে ধরার। তিনিই ইন্ডিয়া, থুড়ি ভারত। তিনিই জি ২০। তিনিই বিশ্বগুরু। নিজেকে এখন তিনি ‘গ্লোবাল সাউথের নেতা’ হিসাবে তুলে ধরতে ব্যস্ত। নিজের ঢাক নিজেই পেটানোয় ‘নির্লজ্জ’ তাঁরই মুখ তাই সর্বত্র। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ‘মেক-ওভার’ হোক কিংবা গরিব-গুর্বোদের বস্তি ঢাকতে কোথাও তিনি হাজির হাসিমুখে, কোথাও আবার পরিচিত সেই শ্যেন দৃষ্টি নিয়ে। পাবলিক টয়লেট থেকে পেট্রোল পাম্প, বাস স্টপ থেকে বহু প্রাচীন বট গাছ, মেট্রোর এনট্রান্স থেকে ফ্লাইওভার, ফেন্সিং— কোথায় নেই তিনি! শহরজোড়া হোর্ডিং, ব্যানারে তিনি ছেয়ে ফেলেছেন রাজধানীকে। সোজা করে বললে, দিল্লি এখন মোদীময়। 
এই উইক এন্ডে জি ২০ বৈঠক কোনও যৌথ ঘোষণা দিয়ে শেষ হোক বা না হোক গরিবী আড়াল করে নিয়ন আলোয় মোদীর ভারতকে পণ্য করে তোলায় চেষ্টার কোনও কসুর রাখেনি কেন্দ্রের সরকার। আর গোটাটার বিজ্ঞাপনেই হাজির সেই তিনিই। এয়ারপোর্ট থেকে এখন যদি কেউ শহরে আসতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান, তাহলে শুধুই নজরে পড়বে ব্যানার, বিলবোর্ড, ডিজিটাল প্যানেলের মতো আউটডোর সাইনেজ। যার চারটের মধ্যে অন্তত একটাতে নজর পড়বে ‘প্রাইম মিনিস্টার অব ভারত’-এর মুখ। প্রতি চল্লিশ মিটার এগোলেই একবার সেই মুখ দেখতেই হবে। 
মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে রাখা হচ্ছে আইটিসি মৌর্য। পাশের তাজ প্যালেসে থাকবেন চীনের প্রতিনিধিরা। বিমানবন্দর থেকে এই হোটেলগুলিতে আসার গোটা ১২ কিলোমিটার রাস্তায় হোর্ডিং-ব্যানার গোনার মতো একটা কঠিন কাজ করেছে এক ডিজিটাল নিউজ পোর্টাল। তাদের দেওয়া হিসাবে এই রাস্তার দু’ধার জুড়ে জি ২০’র ৯৬৩টি প্রোমোশনাল ইনস্টলেশান। এর মধ্যে ২৩৬টিতেই মোদীর জলুসের ঝলকানি। এবং নিশ্চিতভাবেই ‘অনুপস্থিত’ বৈঠকের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণকর্তা ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’-এর কোনও ছবি। নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনেও অবশ্য ডাক পড়ে না দেশের সাংবিধানিক প্রধানের। তাই এমন একটা ইভেন্ট যে শুধু মোদীময় হবে, তাতে অবাক নয় কোনও মহলই। 
শুধু বাদ সাধলো অতিথি দেশের সংবাদ মাধ্যম। ফাঁস করে দিল গরিবীর নামে গরিব মুছে ফেলার ছক। যার হাতে গণতন্ত্রই বিপদের মুখে, তাঁকে তুলে ধরে ‘গণতন্ত্রের জননী’ সাজতে গিয়েই সব সর্বনাশ। আসল ভারত তো এখনও বেঁচে। তাই দিল্লিতে মোদীর মুখে বস্তি চাপা পড়লেও ইম্ফলে মায়ের দল কুশপুতুলে আগুন ধরিয়ে জুতো মারছে সেই মুখেই। শুক্রবার, জি ২০ বৈঠক শুরুর প্রাক্কালে এটাই ভারতের ছবি।

Comments :0

Login to leave a comment