ভ্রমণ — মুক্তধারা, বর্ষ ৩
আমতা আমতা করে হামতা...
অভীক চ্যাটার্জী
রাতে ভালো ঘুম হলো না, রাত পোহালেই এই পাহাড় এই অরণ্য বনানী ছেড়ে ফিরে যেতে হবে কংক্রিটের জঙ্গলে। পাহাড় যে আমার চিরকালের বড় প্রিয়, বড় আদরের। রাতে একবার তাবুর বাইরে এলাম। আকাশ ভরা তারা,আর সেই তারার রাজ্যে একা আমি জেগে আছি। বাকি তাবুগুলোতে সব আলো বন্ধ। দূরে অন্য কোনো তাবুতে কুলি আর গাইডরা দেশীয় মদ খেয়ে গপ্পো করছে। পাস দিয়ে দুরন্ত গতিতে পাহাড়ি নদী বয়ে চলেছে। তার আওয়াজ এসে চলেছে অবিরত। সব মিলিয়ে এক বিষন্নতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে আমায়। এবার যাবার পালা।
সকালে খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। তাবুর বাইরে তখন ঠাণ্ডা হওয়া বইছে। একে একে সবাই জেগে উঠছে। আমি প্রতীক আর পার্থ (নতুন আলাপী) আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে গেলাম। আশপাশটা বেলেমাটিতে ভরা। দূর পাহাড়ের গায়ে তখন রোদের দাগ পড়েছে। রহস্যময় উপত্যকায় সকাল হচ্ছে আলস্যভরে।
খেয়ে দেয়ে আমাদের সার্টিফিকেট দেওয়া শুরু হলো। তারপর আমরা সবাই একসাথে গাড়িতে উঠে বসলাম। পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে আমাদের গাড়ি চলল মানালি। ধূসর ধীরে ধীরে কমছে। সকালের রোদের আলোয় নদীর জল যেন হীরের মত ঝলমল করছে। পথ এঁকেবেঁকে চলেছে নিচে। এগারোটা নাগাত আমরা পৌঁছলাম সেই অটল ট্যানেল এর সামনে। মনে পড়ে গেলো আমাদের মানালিতে দ্বিতীয় দিনের কথা। আমি আর প্রতীকের এখানে ঘুরতে আসার কথা। অটল টানেল পার করে সবুজে ঘেরা হিমাচলের চেনা আবহাওয়াতে পা রাখলাম আমরা। সেই মেঘলা আকাশ, সবুজ পাহাড় আর কালো পিচঢালা রাস্তা। আমরা বেলা দেড়টা নাগাত মানালির মাল রোডে এসে নামলাম। এবার বিদায় বেলা। সবাই সবার মত চলে যাবে নিজের নিজের পথে। আমি প্রতীক আর পার্থ যাবো মানালি ISBT, সেখান থেকে বাস নিয়ে আমরা ফিরবো দিল্লী। মাল রোডেই কিছু খাবার খেয়ে নিলাম আমরা। তারপর একটা ছোট গাড়ি ভাড়া করে আমরা চললাম ISBT এর উদ্দেশ্যে। প্রচুর বাস দিল্লী যাচ্ছে। আমরা একটা volvo 9600 তে উঠে বসলাম। বাস ছেড়ে দিলো। পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে রাজকীয় যন্ত্রদানব চলতে শুরু করল দিল্লির দিকে। আর আমি, ডুবে গেলাম গত পাঁচ দিনের স্বপ্নময় যাত্রাপথের স্মৃতিচারণায়।
দূরে এখনো দেখা যাচ্ছে বরফ ঢাকা পর্বত চূড়া। একটু পরেই আর দেখা যাবে না। এই সবুজ দিগন্তরেখা পেরিয়ে আমরা চলে যাব আমাদের নগরজীবনে। আমি হয়তো প্রতিবার নেমে আসি আমার চেনা ছকে, চেনা রাস্তায়; কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে এই পাহাড়ের গায়ে। এই শতাব্দী প্রাচীন মহীরুহ শেওলা জমা শিকড়ের পাশে। যেখানে বুনো ফুলের গন্ধে মৌমাছি খেলা করে আর ঠাণ্ডা হওয়া জানান দেয় তার চিরন্তন উপস্থিতি।
আমি জানি আমি আবার ফিরে আসবো। নতুন কোনো এক যাত্রাপথ ধরে আবার উঠে যাবো কোনো এক অন্য অভিযানে। আবার চোখে চোখ রাখবো অন্য এক শৃঙ্গের। ট্রেকিংয়ের যে বীজ আমার বুকে পুঁতে দিয়েছেন আমার বাবা, সে বীজ আমার আদরের আতিশয্যে আজ এক মহীরুহে পর্যবসিত হয়েছে। আমার প্রতিটা অভিযানই তার বেঁচে থাকার রসদ, তার মাথা তুলে দাঁড়ানোর আকাশ। তাই আমায় ফিরে আসতে হয়। আমি ফিরে ফিরে আসি বার বার।
চলবে
Comments :0