Murshidabad

ভাঙনের স্থায়ী সমাধান চাই এবার, হুঁশিয়ারি সেলিমের

জেলা

‘‘ওরা বলছে গ্রাম ছেড়ে দিতে। কোথায় যাব আমরা!’’ রবিবার সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে কাছে পেয়ে গঙ্গা ভাঙনে তলিয়ে যেতে থাকা সামসেরগঞ্জ ঘনশ্যামপুরের আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা এভাবেই নিজেদের অসহায়তার কথা জানালেন। তাঁদের অভিযোগ, ‘‘সরকার থেকে ভাঙন প্রতিরোধের নামে কেবল বালি ফেলা হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে নদীর জলে আর তৃণমূল নেতাদের পকেটে। জমি বাঁচানো যাচ্ছে কই!’’ 
‘‘বালি থাকে না, বোল্ডার কই!’’ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জ্ঞান নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই রেহেন্না খাতুন, ফুল খাতুনরা চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে এদিন মহম্মদ সেলিমকে বলতে থাকেন, ‘‘আমরা বালি চাই না। বোল্ডার দিয়ে খাঁচা বেঁধে স্পার তৈরি করে নদীর ভাঙন ঠেকানো হোক। তা না করে আমাদের বারবার গ্রাম ছাড়তে বললে আমরা কোথায় যাব?’’
চোখের সামনে নদীর গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে তাঁদের জমি, বাড়ি, দোকান। সব শুনে সেলিম তাঁদের বলেছেন, ‘‘আর চুপ করে থাকা নয়। আর কান্নাকাটি নয়। সরকারের কাছে চিৎকার করে সমাধান চাইতে হবে। জবাব দিতে হবে সরকারকে।’’
এদিন সেলিমের সঙ্গে কথা বলার পর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ নদীর দিকেই চেয়ে থাকলেন জ্যোৎস্নারা বিবি। চোখের সামনে ভাঙনে  তলিয়ে গিয়েছে তাঁর দু-দু’টি জমি। একটি পেয়েছিলেন পারিবারিক সূত্রে, অন্যটা তিন লক্ষ টাকায় কিনেছিলেন। ভেবেছিলেন বাড়ি বানাবেন। এখন শুধুই নদী। সেই না-থাকা জমির দিকে আঙুল তুলে  ষাট বছর বয়সী জোৎস্নারা বিবি হতাশা আর আক্ষেপ জানাতে থাকলেন। বাড়িতে অসুস্থ  স্বামী, পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে এক কামরার ঘরে থাকেন। ভেবেছিলেন একটা বাড়ি করবেন। সেই স্বপ্ন তছনছ। বললেন, ‘‘এখন কীভাবে বাড়ি করব, কীভাবে সংসার চালাবো, সেকথা ভেবেই ঘুম উড়ে গেছে।’’ ঘুম উড়ছে দেবীদাসপুরের বোবি বেওয়ারও। চোখের সামনে তৈরি করা বাড়ি ভেঙে ফেলতে হয়েছে। এখন খুঁজে চলেছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই।  


এদিন সকালে সামসেরগঞ্জের ভাঙন কবলিত এলাকা ঘুরে দেখেন মহম্মদ সেলিম। সঙ্গে ছিলেন সিপিআই(এম)’র মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা, রবজুরল ইসলাম, মোদাসসার হোসেন। সাতঘরিয়া থেকে শুরু করে গঙ্গা নদীর তীর ধরে প্রতাপগঞ্জ, মহেশটোলা, পূর্ব দেবীদাসপুর, পশ্চিম দেবীদাসপুর, ঘনশ্যামপুর হয়ে দিগড়ি পর্যন্ত হেঁটে যান সিপিআই(এম) নেতারা। সঙ্গে ছিলেন গ্রামের মানুষ। ভাঙন দেখাতে দেখাতে আবদুল রহমান, সঞ্জু সেখরা বলছিলেন, নদী যতো ভাঙছে, তীরের দিকে গভীরতা তত বেশি বাড়ছে। বালির বস্তায় কি হবে? তাঁদের অভিযোগ, তবু বালিতেই ভরসা তৃণমূল নেতাদের! কারণ, সেখানেই টাকা। বালির বস্তা ফেলার কোন হিসেব নেই। তৃণমূল নেতারাই বালি, ছাইয়ের বস্তা ফেলার ঠিকাদার। নয়ছয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ১৮ অক্টোবর রাজ্য সরকারের অ্যান্টি ইরোশন দপ্তরে ডেপুটেশন দেয় সিপিআই(এম)’র প্রতিনিধি দল। আধিকারিকরা তাঁদের জানান, সামসেরগঞ্জে এবছর ভাঙন মোকাবিলায় কোনও বরাদ্দ হয়নি, আগের বছরের ভাঙন কবলিত এলাকার জন্য বরাদ্দ। সেই বরাদ্দ হয়েছে শুধু বালির বস্তা ফেলার কাজে। ভাঙন তাতে আটকায়নি। 
এদিন স্থানীয় মানুষের তৈরি গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ কমিটির পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি তুলে দেওয়া হয় মহম্মদ সেলিমের কাছে। মহম্মদ সেলিম বলেন, স্থানীয় মানুষের দাবি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হবে। তবে ভাঙন মোকাবিলার কোনও সদিচ্ছা নেই সরকারের।
নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে মহম্মদ সেলিম ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, ‘‘ভাঙন চলছে। আর রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই সরকার নিজের মধ্যে দায় ঠেলাঠেলি করছে।’’
সেলিম বলেন, ‘‘দিল্লি থেকে কলকাতা অবধি লড়তে হবে। না লড়লে কিছু পাওয়া যায় না। লড়াই যখন শুরু হবে, সেচ দপ্তরের টাকা, বাঁধের টাকা, বালির টাকা কোথায় গিয়ে টাকার পাহাড় হয়েছে সব বেরিয়ে আসবে।’’
মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘মানুষ অসহায়। স্কুল, খেলার মাঠ, মন্দির, কবরস্থান, দোকান, বাজার, বাড়ি-ঘর সব চলে যাচ্ছে। দুই সরকার নিশ্চুপ। একদিকে মানুষের দুর্গতি। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার নদী নিয়ে রাজনীতি করছে। প্রধানমন্ত্রী নমামি গঙ্গে’র নামে বেনারস সাজাচ্ছেন। গঙ্গা নদীর জন্য যা টাকা সব টাকা বেনারসে ঢালা হচ্ছে। দুর্গত মানুষের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ঝাড়খণ্ড, বিহার, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদীয়াতেও ভাঙন হচ্ছে।’’
সেলিম মনে করিয়ে দেন, ‘‘রাজ্যে ক্ষমতায় এসে তৃণমূলের সরকার বলেছিল স্থায়ীভাবে পাড় বাঁধাবে তারা। ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের হাত থেকে দায়িত্ব নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু শুধু দুর্নীতি হয়েছে, স্থায়ী কোনও কাজ হয়নি। তাই ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ বলছে এখন ভাঙন মোকাবিলা রাজ্যের দায়িত্ব।’’ সেলিম বলেন, ‘‘আমাদের স্পষ্ট কথা, নদী ভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধান চাই। ক্ষতিগ্রস্ত সকলকে দ্রুত ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন দিতে হবে।’’
গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে জামির মোল্লা জানান, ‘‘ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা, স্পার নির্মাণ, পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে আমরা ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ডেপুটেশন দিয়েছি। রাজ্য সরকারের অ্যান্টি এরোশন দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। এই দাবি নিয়ে লাগাতার আন্দোলন চলবে। নদী ভাঙন মোকাবিলার নামে কোটি কোটি টাকা কাদের পকেটে গেল সেই জবাব তৃণমূলকে দিতে হবে।’’

 

Comments :0

Login to leave a comment