GAZA

গণহত্যার বিরোধিতাও অপরাধ!

সম্পাদকীয় বিভাগ

গণতন্ত্রের জন্য বিশ্বজুড়ে নিজেদের গরিমা প্রচার করে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে বাক্‌ স্বাধীনতা নাকি সেদেশের সংবিধান দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত। ইতিহাসের নিরিখে এর সমর্থনে অনেক প্রমাণও মিলতে পারে, কিন্তু বর্তমানে অতি দক্ষিণপন্থার উত্থান ও ট্রাম্প জমানায় মার্কিনী গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে সংশয় তোলার পরিসর ক্রমশই বাড়ছে। প্যালেস্তাইনের বুকে ইজরায়েলী গণহত্যার প্রতিবাদ করায় সেদেশে পাঠরত বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর একের পর এক আক্রমণ নেমে আসছে। অতি সক্রিয়তা দেখিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এমন প্রতিবাদীদের মধ্যে রীতিমতো ‘সন্ত্রাসবাদী যোগ’ আবিষ্কার করে তড়িঘড়ি তাদের ভিসা বাতিল করে আমেরিকা থেকে বিতাড়নে নেমেছে। 
প্যালেস্তাইনের মুক্তিকামী মানুষের সমর্থনে এবং গাজায় ইজরায়েলী গণহত্যার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়েই প্রতিবাদ হচ্ছে। আমেরিকার বেশ কিছু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। নিউইয়র্ক শহরে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়েছিল সবচেয়ে বেশি, সেখানে পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ুয়াদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটিয়েছে। সেই কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত ছাত্রী ছিলেন প্রবাসী ভারতীয় রঞ্জনী শ্রীনিবাসন। তিনি আমেদাবাদের সিইপিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তার পর স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু মার্কিন সরকার তাঁকে সেদেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক বলে আবিষ্কার করে ইজরায়েলী হামলার বিরোধিতা করতে দেখে। বিপদ বুঝে শ্রীনিবাসন কানাডায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, সম্প্রতি আরেক প্রবাসী ভারতীয় ছাত্র বদর খান সুরি একইরকম কারণে ট্রাম্প প্রশাসনের চক্ষুশূল হয়েছেন। আমেরিকার জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক বদর খান সুরি ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে সরব হওয়ার ‘অপরাধে’ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন, শনিবার রাতারাতি তাঁর ‘এফ-১’ ছাত্র ভিসা বাতিল করে, তাঁকে ‘বেআইনি অভিবাসী’ বলে দাগানো হয়েছে। ‘হামাস ঘনিষ্ঠতা’র অভিযোগ তোলা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বছর পাঁচেক আগে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় ‘বিশ্ব রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ নিয়ে পিএইচডি গবেষণা শেষ করে মেধাবী ছাত্র বদর খান সুরি জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ‘এডমন্ড স্কুল অব ফরেন সার্ভিস’-এ মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রীকরণ ও সংঘাত নিয়ে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণার সুযোগ পান। এরই মধ্যে প্যালেস্তিনীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক মাফেজ সালেহকে বিয়ে করে ভার্জিনিয়ার আর্লিংটনে তাঁরা বসবাস করা শুরু করেন। বদরের স্ত্রী মাফেজ পেশায় সাংবাদিক এবং গাজা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। গাজায় ইজরায়েলের বেলাগাম গণহত্যার বিরুদ্ধে আমেরিকা জুড়ে যে প্রবল বিক্ষোভ চলছে, বদর ও মাফেজ তাতে অংশ নেয়। বদর ও তাঁর স্ত্রীর ধর্মীয় পরিচয়কে দেখিয়েই মার্কিন পুলিশ তাদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী যোগ দেখতে পেয়েছে। আশার কথা এই যে, বদরের আইনজীবী ভার্জিনিয়া আদালতে এর বিরুদ্ধে আবেদন করে প্রাথমিকভাবে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন। আদালত বদরকে আমেরিকা থেকে বিতাড়নের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইজরায়েল একতরফা হামলায় যেভাবে গাজায় নির্বিচারে মানুষ মারছে, বিশেষত নারী ও শিশুরা নিহত হচ্ছে, তাতে সারা বিশ্বের শান্তিপ্রয় মানুষ ক্ষুব্ধ। ইজরায়েল নিজেই সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রের পরিচিতি লাভ করছে। অথচ এর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ বিক্ষোভে সোচ্চার হলেই যেভাবে আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে তাতে ট্রাম্প জমানায় মার্কিনী গণতন্ত্রের ফোঁপড়া চেহারাই বেআব্রু হচ্ছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়েও আমেরিকায় ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছে, ইরাক যুদ্ধের সময়েও আমেরিকার বহু চিন্তাবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে মুখর হয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এসব সহ্য করতে নারাজ। প্রশ্ন শুধু ট্রাম্পের বিরুদ্ধেই ওঠে না, ভারতের মোদী সরকারের বিরুদ্ধেও ওঠে। প্রবাসে ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের হেনস্তা হতে দেখেও ভারত সরকার কেন চুপ করে রয়েছে, কোন বাধ্যবাধকতায় ভারতের বিদেশ মন্ত্রক মার্কিন সরকারের আচরণের প্রতিবাদ করছে না? মোদীর বোঝা উচিত, দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে বন্ধুত্বের পরিণামের ফল যেন প্রবাসে ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের বইতে না হয়।

Comments :0

Login to leave a comment