Post Editorial

মুখে যা, কাজে কি তাই?

উত্তর সম্পাদকীয়​

Post Editorial


অলকেশ দাস
রিজওয়ানুর রহমানের রহস্যের মৃত্যুর পিছনে বাম সরকারের পুলিশ-প্রশাসন, নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব করার জন্য মুসলমানের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ইত্যাদি ২০১১ সালের আগে গোটা রাজ্যে মুসলমানদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল।
২০০৬ সালেই সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেখানে ছিল পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত পশ্চাৎপদতার কথা। তাকে কেন্দ্র করে তৃণমূল গোটা রাজ্যে মুসলমানদের বলতে শুরু করে— কী পেলেন ৩৪ বছরে ? সরকার প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। রঙ্গনাথ কমিশনের সুপারিশ দেশের মধ্যে প্রথম প্রয়োগ করে। বামফ্রন্ট  সরকার তথ্য প্রকাশ করে মুসলমানদের রাজ্যে অবস্থান সম্পর্কে। দেখা যায় ২০১১তে মাল্টি সেক্টরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে (এমএসডিপি) সারা দেশের অন্য রাজ্যগুলির চেয়ে সবচেয়ে বেশি খরচ (৩০%)করা হয়েছে পশ্চিমবাংলায়। সেই সময় রাজ্যে মুসলিম পরিবার ছিল ৩০. ৯ শতাংশ। তাদের ২৫.৬ শতাংশ পরিবারের হাতে চাষযোগ্য জমি ছিল। এ বিষয়ে সারা দেশে জম্মু-কাশ্মীরের পরেই আমাদের রাজ্য ছিল। ২০০৯-১০ সালে ৩২.৩ শতাংশ মুসলিম শিশুরা রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হয়েছিল। সারাদেশে এই গড় ছিল ১৩.৪৮শতাংশ। ঐ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ২৫.২৭ শতাংশ মুসলিম প্রার্থী ছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ১৯.৮৫ শতাংশ ছিল মুসলিম প্রার্থী। সংখ্যাগুরুবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষের লড়াইয়ে সারাদেশে বামফ্রন্ট নেতৃত্ব দিয়েছিল। এতদ্‌সত্ত্বেও প্রতিক্রিয়ার শক্তি মুসলিম অংশকে যথেষ্ট বিভ্রান্ত করতে সমর্থ হয়েছিল। ২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারের পতন এবং ফলাফলে বিপর্যয়ে এটি একটি অন্যতম কারণ ছিল।

সার্কাসে ব্যালেন্সের খেলা

পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা ২৭.১ শতাংশ। রাজ্যের ৩৪১ টি ব্লকের ৬৫ টি মুসলিম নিবিড়। ১৩টি লোকসভা কেন্দ্র আছে যেখানে মুসলিম ভোট ৩২ থেকে ৬৪ শতাংশ। ৪৬ টি বিধানসভা কেন্দ্র আছে যেখানে মুসলিম ভোটার ৫০ শতাংশের উপরে। ১৬টি বিধানসভা কেন্দ্র আছে যেখানে মুসলিম ভোটার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে। ৮৩টি বিধানসভা কেন্দ্র আছে যেখানে মুসলিম ভোটার ২০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে। মমতা সুবিধাবাদে এখানেই পাখির চোখ করেছেন। রেড রোডে নামাজ পড়েছেন। নিয়মিত  রোজা ভাঙার ইফতার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে মুসলমানদের রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছেন। ইমাম ভাতা দিয়েছেন। মাঝে মাঝেই নিখুঁত চিত্রনাট্য অনুযায়ী বিজেপি বা মোদীর বিরুদ্ধে গরম হয়েছেন। আর মুসলমানকে দেখিয়েছেন তিনি কত মোদী বিরোধী!
মুসলিম এলাকায় গিয়ে মাথায় আঁচল দিয়ে হিজাবি সেজেছেন। ফিরহাদ হাকিমকে কলকাতার মেয়র করে দলের ‘মুসলমান মুখ’ সাজিয়েছেন। ১০হাজার মাদ্রাসা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন (যদিও এক দশক পরেও ২৭৫ -এর গণ্ডি পেরোতে পারেননি এখনো)। রেলমন্ত্রী যখন ছিলেন তখন বলেছিলেন ফুরফুরা শরীফ থেকে ডানকুনি ট্রেন চলবে হেলেদুলে। সঙ্গে সঙ্গে শিলান্যাসের কাজও সারা। উনি চলে যাওয়ার পরে আরও দুই রেলমন্ত্রী তৃণমূলের ছিল। মুকুল রায় এবং দীনেশ ত্রিবেদী। রেল লাইন আর এগোয়নি।
অনেকে তাকে ভোটের জন্য মুসলিম তোষণের অভিযোগ করেছেন। বিনম্রভাবে অস্বীকারের পরিবর্তে ঝাঁঝিয়ে বলে উঠেছেন- যে গোরু দুধ দেয় তার লাথি খেতে হয়। অনেকে বুঝতে পারেননি তাদেরকে মুখ্যমন্ত্রী গোরু বলে সম্বোধন করেছেন। মসলিমদের থেকে লাথি খেতে হতে পারে সেই ভয়ও পেয়েছেন। যে ‘লাথি’ তাকে সাগরদিঘিতে সত্যিই খেতে হয়েছে!

সাগরদিঘি  উপনির্বাচন
মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি বিধানসভা কেন্দ্রে মুসলিম ভোটার  ৬৪ শতাংশ। গত নির্বাচনে তৃণমূল জিতেছিল ৫৮,৮৪৫ ভোটে। এবার তারা পরাজিত হয়েছে ২২, ৯৮৬ ভোটে।  মুখ্যত সংখ্যালঘু এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের তৃণমূল- বিজেপি বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করার ফলে তৃণমূল হেরেছে। এদিকে কংগ্রেসের জয়ী প্রার্থী তৃণমূলে যোগদান করেছে। তাতে জয় ছোট হয়ে যায়নি। এই ঘৃণ্য দলবদলকে নিয়ে জনগণের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তাতে বোঝা গেছে জনগণ তার নিজের অবস্থানেই আছে। 
চোখ খোলার শুরু
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে তৃণমূলের বিপর্যয়ের সময়েও উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটের শতাংশ তৃণমূল পায়। ২০২১সালে বিধানসভা নির্বাচনে সিডিএস -লোকনীতি সংস্থা নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্লেষণ করে বলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুসলিম ভোটারদের ৭৫ শতাংশ ভোট তৃণমূল পেয়েছে। পরিসংখ্যানে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে সংখ্যালঘুদের এই সমর্থন ব্যতীত তৃতীয়বারের জন্য মমতা সরকার গঠন সম্ভব হতো না।
কিন্তু তখনো মুসলমানেরা বুঝতে পারেনি যে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর পরামর্শদাতা পিকের সঙ্গে বসে তিনি মুসলমান বিষয়ে সতর্ক হয়েছেন। মুসলিম ইস্যুকে এড়িয়ে গিয়ে ববি হাকিমকে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন। পার্ক সার্কাস ময়দানে সংখ্যালঘু দপ্তরের মিলন উৎসব এড়িয়ে গেছেন পরপর তিন বছর। ওয়েস্ট বেঙ্গল মাইনরিটি ফিন্যান্স কর্পোরেশনকে কার্যত নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় রাখা হয়েছে। ২০১৬-তে বিধানসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি  ৪০ বার এবং ‘মুসলিম’ শব্দটির ২ বার উল্লেখ ছিল। কিন্তু ২০২১-এ বিধানসভার নির্বাচনে তৃণমূলের নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে ‘মুসলিম’ শব্দটির ব্যবহার একবারও দেখা যায় না। সংখ্যালঘু ব্যবহার করা হয় কেবলমাত্র ২বার। তাও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত করে। তৃণমূল মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যাও হ্রাস করে দেয়। ২০১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের মুসলিম প্রার্থী ছিল ৪৬ জন। ২০২১-এ তা দাঁড়ায় ৩৫। নন্দীগ্রামে বিধানসভার নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করবার সময় মন্দির এবং মন্ত্রোচ্চারণের ভঙ্গিতে বোঝা যায় মমতা ও তৃণমূল বিজেপি’র সঙ্গে হিন্দু ভোট টানার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। আরও পরিষ্কার হয়ে যায়, মমতা যখন তার নিজের ব্রাহ্মণ পরিচিতি উচ্চকিতভাবে জনগণের কাছে প্রকাশ করেন।
আনিস খান একটি দরজা খুলে দিল। ২৮ বছরের ছিপছিপে এমবিএ পাস পড়ুয়া ছাত্র। বাম ছাত্র আন্দোলন করা যুবক। মৃত্যুর আগের দিনও তার ফেসবুকে প্রতিবাদ আছড়ে পড়েছে। কেন হিজাব নিষেধের বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নীরব ? সিএএ-এর ব্যাপারে সে ভয়ঙ্কর সোচ্চার ছিল। মাঝরাতে পুলিশ না হলে পুলিশের বেশে যারা বাড়িতে ঢুকলো তারা আনিসকে নিয়ে গেল বাড়ির ছাদে। আর তারপরই তার রক্তাক্ত লাশ পাওয়া গেল বাড়ির উঠোনে। সরকার, পুলিশ, মুখ্যমন্ত্রী বলে দিল এটা আত্মহত্যা। গোটা রাজ্যের মানুষ বলল এটা খুন। সরকার কোনমতে হাত ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করল। যে মুসলমান ভোট দিয়ে সরকার গড়েছিল সেই সরকার মুসলমানের খুন হয়ে যাওয়া, ইনসাফের দাবির দিকে ফিরেও তাকালো না।
আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হলেন হিন্দি সিনেমার অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা, যিনি ২২ বছর কখনো রাজ্যসভায়, কখনো লোকসভায় বিজেপি’র সদস্য ছিলেন। ঐ কেন্দ্রে এর আগে সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন বিজেপি আরএসএস-এর বাবুল সুপ্রিয়। তাঁর নেতৃত্বে আসানসোলে যে গন্ডগোল বাধে তাতে মৃত্যু হয় স্থানীয় ইমাম ইমাদুল রসিদির পুত্রের। সেই বাবুল সুপ্রিয় যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব থেকে ছাঁটাই হন সোজা গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন তৃণমূলের কোলে। বুকে টেনে নেয় তৃণমূল। এক লহমায় মুছে যায় তাঁর হাত থেকে দাঙ্গার রক্ত। দাঙ্গার নায়কের এবার প্রোমোশন হয় মমতার মন্ত্রিত্বে উত্তরণে !
গরম কথা বলায় দক্ষ অর্জুন সিং। বিধানসভা ভাঙচুর করেছিলেন মমতার সঙ্গে। বাহুবলী তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়ে সাংসদ হয়েছিলেন। বলেছিলেন আমরা ৭০ ,ওরা ৩০। পায়ের তলায় কুচলে দেবো। আমরার জায়গায় বুঝতে হবে হিন্দুরা, ওরার জায়গায় মুসলমান। সাম্প্রদায়িকতার  বিষবাষ্পময় তিনি এখন আবার তৃণমূলে।
তৃণমূলের এমএলএ ছিলেন। বিধাননগর মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের মেয়রও ছিলেন। সব্যসাচী দত্ত। বিজেপিতে যখন পালালেন তখন ফিরহাদ হাকিম বললেন- ‘মীরজাফর’। বিজেপি-তে গিয়ে সব্যসাচী বললেন বাংলা দ্বিতীয় পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে। বললেন যারা জয় শ্রীরামের বিরোধিতা করে তাদের তিনি পাকিস্তানে পাঠাবেন। ২৪ মাস পরে যখন সব্যসাচী আবার তৃণমূলে ঢুকলেন তার হাতে পতাকা তুলে দিলেন সেই ফিরহাদ। ২০২২ এর বিধাননগর মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের নির্বাচনে জেতার পর মমতা তাঁকে চেয়ারম্যান করে দিলেন !
তৃণমূল দল তৈরি করা এবং তৃণমূল বিজেপি’র জোট বন্ধনে মমতার পর যাঁর সর্বাধিক ভূমিকা সেই মুকুল রায় ২০১৭ সালে বলেছিলেন —বিজেপি সাম্প্রদায়িক নয়, ধর্মনিরপেক্ষ পার্টি।  সেই মুকুল রায় বিজেপি’র এমএলএ থেকেও এখন তৃণমূলে। তাঁর সেই বিখ্যাত বক্তব্য— যাহাই বিজেপি তাহাই তৃণমূল।
সবশেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বলেছিলেন প্রতিবাদে প্রতি বছরের ঐদিন মৌনীব্রত পালন করবেন। ৬ ঘণ্টায় যারা মসজিদ ভেঙেছিল সেই তাদের সঙ্গেই ৯৮ সালে দল তৈরি করে জোট বেঁধেছিলেন। রথযাত্রা, ইটপুজো, করসেবা এবং দাঁড়িয়ে থেকে বাবরি ভাঙার নেতা আদবানি। মমতা বললেন মোদী খারাপ, আদবানি ভালো। বলতে পারলেন না— দুটোই খারাপ। বাবরি মসজিদ ধ্বংসে অভিযুক্ত এই আদবানিকেই রাষ্ট্রপতি পদে চেয়েছিলেন স্বয়ং মমতা। মুসলমান এলাকায় নজরুলের নাম উচ্চারণ আর হিন্দু এলাকায় রবীন্দ্রনাথ। এইভাবেই নজরুলকে মুসলমান বানিয়ে ছেড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। অন্নদাশঙ্কর লিখেছিলেন— ‘আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল’। মুখ্যমন্ত্রী সে কথা বলতে পারবেন না।
নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্যের পর কতগুলো জায়গায় যখন আগুন জ্বলে উঠেছিল তখন সেই দাঙ্গাকে জিইয়ে রাখার কাজ তৃণমূল এবং তার সরকার করেছিল। মুসলমানদের বোঝানোর জন্য যে তোমার পাশে সরকার আছে। তোমাকে আমিই রক্ষা করতে পারি। সাগরদিঘির উপনির্বাচনে হারের পর মুসলমান ভোট হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় তৃণমূল শঙ্কিত ছিল। বামেদের, কংগ্রেসের পক্ষে রায় যাওয়া বিজেপি’র পক্ষেও সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। রামনবমীতে বিজেপি’র আগ্রাসী অভিযানে বাধা না দিয়ে মমতা যখন বলেন— যাচ্ছো, যাও কিন্তু মুসলমান এলাকার ভেতর দিয়ে যেও না। অনেকে এরমধ্যে ওভাবে মুসলমান এলাকার উল্লেখে প্ররোচনা দেখেন। রমজান মাসে রোজা রাখার সময় মুসলমানরা শান্ত থাকে। উৎসব দিয়ে ওদের বিরক্ত করবেন না। মুখ্যমন্ত্রী বলেন। তার মানে রমজান মাস ছাড়া সারা বছর মুসলমানেরা অশান্ত থাকে। এটাই তো আরএসএস এবং বিজেপি বলে। মুসলমানরা জেহাদি, নিয়ম মানে না, আইন মানে না, সন্ত্রাসী। মুখ্যমন্ত্রীর ঝুলির বিড়াল বেরিয়ে গেছে।

উত্তর প্রদেশে বুলডোজার রাজনীতি চলে। সরকারের প্রতিবাদ করলে বিশেষ করে সে যদি মুসলমান হয় তার বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। পশ্চিমবাংলাতেও তাই। সরকার আর সরকারি দলের বিরোধিতা করলে গাঁজা কেস দিয়ে দেওয়া হবে। রাজ্যের একটা মাত্র প্রকৃত বিরোধী বিধায়ক। আইএসএফ’র নওসাদ সিদ্দিকী। চোখ রাঙানিকে গণ্য করেন না, ধার ধারেন না। সেই জন্য শাসকের চক্ষুশুল। তিনি নাকি পুলিশকে মারবার ষড়যন্ত্র করেছেন! অথচ পুলিশের কাছে কোনও প্রমাণ নেই। সারা রাজ্য ফুঁসে উঠল। সাগরদিঘিতে মুখ কালা হওয়ার পর নওসাদকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প পথ তৃণমূলের ছিল না। জেলের বাইরে এসে নওসাদ বলল কীভাবে তাঁকে দল পরিবর্তনের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হয়েছে। এবার পঞ্চায়েত ভোটে ভাঙড়ে লড়াই করার ফলশ্রুতিতে তাঁর নামে খুনের মামলা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘটনা, সময় মুসলিমদের ভাবা প্র্যাকটিস করতে শেখাচ্ছে। ভোটের আগে কারা ছদ্ম, ভোটের পরে কারা আসল?
কী হাল মমতা-রাজে?
বামেদের বিরুদ্ধে এবং তাদের সরকারের বিরুদ্ধে তৃণমূলের অভিযোগ ছিল যে তারা মুসলমানের অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত উন্নয়নে অবহেলা করেছিল। কেউ যখন অবহেলার অভিযোগ করে এটা বোঝা যায় সে আসলে অবহেলা দূর করে উন্নয়নে মনোযোগী হবে। তৃণমূল আমলে সংখ্যালঘু মুসলিমদের রিপোর্ট কার্ডে কিন্তু তা ধরা পড়ে না। পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে- ২০১৮-১৯ এর দেখা যাচ্ছে যে স্যালারি যুক্ত কাজ পশ্চিমবাংলায় ১৩ শতাংশ মুসলমানরা পায়। সারাদেশে এর গড় ২২.১ শতাংশ। অনিশ্চিত বেতন এবং নিরাপত্তাহীন ক্যাজুয়াল ওয়ার্ক পশ্চিমবাংলার ৩৪.৩ শতাংশ মুসলমানেরা করে। দেশে এই গড় ২৬ শতাংশ। স্বনির্ভর কাজে নিযুক্ত রাজ্যের মুসলিমরা মাসে গড়ে আয় করে ৬১৯৭ টাকা। দেশের গড়  ১০,১৯২ টাকা। নিয়মিত বেতন হয় এমন কাজের ক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলায় মুসলিমরা মাসে আয় করে গড়ে ৯৪৬০ টাকা। দেশে এই গড় ১২৯০১ টাকা। এমসিডি সার্ভেতে ধরা পড়েছে তৃণমূল আমলে মুসলমানদের অবস্থা। যেমন মালদহে ২.১৬ শতাংশ মুসলিমদের বাড়ি আছে। বীরভূমে পাকা বাড়ি আছে মুসলিমদের ৮.২৩ শতাংশের‌‌। কোচবিহারে ৬.৩১ শতাংশ মুসলিম বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। মুর্শিদাবাদে  তা ২৭.৭৪ শতাংশ পরিবারে। উত্তর ২৪ পরগনায় ৬.৫৮ শতাংশ মুসলিম বাড়িতে পাকা বাড়ি আছে। মুসলিম ছেলেদের মধ্যে সরকারি চাকরি সবচেয়ে কম উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়, ০.২৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বীরভূমে। তাও কেবল ১.৯১ শতাংশ। সব জেলায় মুসলিমরা অন্যদের চেয়ে সাক্ষরতার হারে পিছিয়ে। ব্যতিক্রম উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ জেলা। মুসলিমদের মধ্যে সাক্ষরতার গড় ৬৯.৫ শতাংশ। রাজ্যে সাধারণের গড় ৭৬.২৬। ড্রপ আউটের হার ২২ শতাংশ। মুসলিমদের প্রাথমিক শিক্ষা বেহাল। স্নাতকের দৌড়ে পিছিয়ে আছে তারা। সরকারি ক্ষেত্রের চাকরিতে মুসলমানরা কী অবস্থায় আছে তিনটি জেলা দেখলেই বোঝা যাবে। কলকাতায় ৫.৩ শতাংশ, হাওড়ায় ৪.২৪ শতাংশ, পুরুলিয়ায় ২.৬৬ শতাংশ মুসলিমরা সরকারি কাজ করে। সরকারি গড় দেশে ১৪ শতাংশ। সোসাল নেটওয়ার্ক ফর অ্যাসিস্ট্যান্স টু পিপল (SNAP) সমীক্ষা তথ্য জানিয়েছে যে মুসলিমদের ৮০ শতাংশের মাসিক আয় ৫০০০ টাকার নিচে। ১৫,০০০ টাকার উপরে মাসিক আয় এমন মুসলিমের সংখ্যা ৩.৮ শতাংশ। কেবলমাত্র ১২.২ শতাংশ মুসলিম বাড়িতে পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা আছে। রাজ্যে ১লাখ লোক কিছু ১০.৬ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। কিন্তু ৩টি সংখ্যালঘু নিবিড় জেলায় বিদ্যালয়ের সংখ্যার গড় এর চেয়ে বেশ কম। মালদহ (৮.৫), উত্তর দিনাজপুর (৬.২), মুর্শিদাবাদ (৭.২)। মুসলমান নিবিড় ৩৫ শতাংশ গ্রামের মানুষকে ৪ কিলোমিটার হেঁটে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হয়। এইরকম ৮% গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। মুসলিম নিবিড় দশ শতাংশ গ্রামে এখনো আইসিডিএস সেন্টার নেই। ৫২ শতাংশ মুসলিম  ক্লাস সেভেন অবধি সর্বোচ্চ পড়াশোনা করে। নাবার্ডের ২০২২-এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবাংলায় কৃষক পরিবারের আয় মাসিক ৭৫৭৩ টাকা‌। কেবলমাত্র ছটি রাজ্যে এর চেয়ে কম কৃষকেরা আয় করে। কৃষি ঋণ দেওয়ার দিক থেকে ১৫ নম্বরে অবস্থান করে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্য থেকে দলে দলে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ছে। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ বলে যে রাজ্যে কাজ নেই ,তাই উপায় নেই। তাই তাদের বাধ্য হয়ে বাইরে যেতে হচ্ছে। এদের সবাই সমাজের প্রান্তিক অংশের মানুষ। বেশিরভাগ তফসিলি, আদিবাসী, সংখ্যালঘু। এদের বেশিরভাগের স্বপ্ন ছেলেমেয়েকে ভালো করে পড়াশোনা করানো, মেয়ে বা বোনের বিয়ে দেওয়া, নিজের একটা বাড়ি তৈরি করা অথবা ধার শোধ করা। তারা তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য মমতাকে ভোট দিয়েছিল। এই স্বপ্ন খানখান হয়ে ভেঙে গেছে।

কালো মেঘের ঘনঘটা

২৭.১ ভাগ মুসলমানকে বাদ দিয়ে যুদ্ধ জেতা কঠিন। বিজেপি এটা জানে। সেই জন্য তাদের ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটির সভাতে রাজ্য নেতাদের বলা হয়েছে মুসলিম ভোটারদের কাছে যেতে। এরপরেই বিজেপি’র দিলীপ ঘোষ বলতে শুরু করেছেন ৩০ ভাগ মুসলমান যদি পিছিয়ে থাকে তাহলে রাজ্য কী করে এগিয়ে যাবে? এই দিলীপ ঘোষই আগে বলেছেন তৃণমূলের দুর্নীতি, খারাপ প্রশাসন ইত্যাদি ক্ষণস্থায়ী। আসল ইস্যু হিন্দুদের নিরাপত্তা। মানে মুসলমানদের নিরাপত্তার দরকার নেই।
শুভেন্দু বার্তা দিচ্ছেন মুসলমানের পাশে দাঁড়ানোর! অথচ এই শুভেন্দু নিজেকে ‘সনাতনী হিন্দু’ বলে, আর মুসলমানকে ‘জেহাদী’ বলে। সব জনসভায় বলেছে সবাইকে ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে হবে। মানে মুসলমানকেও। দেশ চালাতে এরা ব্যর্থ। সেই জন্য দৃষ্টি ঘোরাতে পাকিস্তান, চীন, দেশরক্ষা, মুসলমান প্রচারে আমদানি করে। মুসলমানের বিরুদ্ধে ঘৃণা উৎপাদন করে। হিন্দু রাষ্ট্রের স্লোগান তোলে। উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিষ ঢালে যে মুসলমানের জন্য তোমরা দেশ ছাড়লে তাকে এদেশে রাখবে কেন? নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এনে হিন্দুদের সঙ্কেত দেয় যে তারা এদেশ থেকে মুসলমানদের তাড়াতে চায়। এনসিইআরটি-কে দিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে মোঘল ইতিহাস তুলে নেয়।  আরএসএস মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখতে চায় তা পরিষ্কার করে দেয়।
বিজেপি এবং তৃণমূল দেখায় যে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে। কিন্তু এদের মধ্যে সম্পর্ক মধুর। তৃণমূল আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতির সমস্ত তথ্য বিজেপি’র হাতে। তাতে গোটা তৃণমূল দলটাই জেলের ভেতরে থাকার কথা। বিজেপি বাঁচিয়ে রেখেছে তৃণমূলকে। লোকসভার ভেতরে জনবিরোধী সমস্ত বিলকে তৃণমূল সমর্থন করেছে কখনো সরাসরি কখনো সংসদে অনুপস্থিত থেকে। বিজেপি’র সঙ্গে তৃণমূলের বোঝাপড়া বাম বিরোধিতা থেকে। কোনভাবেই মুসলমান ভোট যেন বামেদের দিকে না যায়-এই শর্তে।

মাটিতে নবজীবনের রঙমহল 
গত বছরের অক্টোবরে জলপাইগুড়ির মাল নদীতে দুর্গা পুজোর বিসর্জনের সময় হঠাৎ হড়পা বানে নদীর জলে ভেসে যেতে শুরু করে দর্শনার্থীরা। তাদের বাঁচাতে জলে ঝাঁপ দেয় মাণিক মহম্মদ, ফরিদুল ইসলাম, তরিফুল ইসলাম, ডেভিড ওলান, পিন্টু শেখ, রাজ ওরান। কেউ মুসলমান, কেউ আদিবাসী। এরা প্রায় ৩০ জনের প্রাণ বাঁচায়। এদের মধ্যে তরিফুলের বয়স ২০ বছর। সে অনায়াসে বলে ফেলে, আমার জীবন একটা, কিন্তু প্রাণ বাঁচালাম দশজনের। ১০ তো ১জনের চেয়ে বেশি, না? আমরা মানুষ। হিন্দু-মুসলমান হওয়ার আগে আমাদের মানুষ হওয়া উচিত নয় ? ফেসবুকে আনিস খানের একটা পোস্টে ছিল মোটরসাইকেলে দুজন মেয়ে। যে চালাচ্ছে তার মাথায় স্কার্ফ। বোঝা যাচ্ছে সে মুসলিম। গাড়ির পিছনের সওয়ারির হাতে গণেশ মূর্তি। আনিস লিখেছে-এটাই আমাদের ভারতকে এক করে রেখেছে। কটা ভোটের জন্য এটাকে নষ্ট করো না। তাঁর ভাবনা কার্যকরী করতে পারবো না ? স্বৈরাচার আর বিভাজনের বিজেপি আর তৃণমূলকে প্রাণপণে সরাতে পারবো না? আনতে পারবো না সেই শক্তিকে, সেই বামেদের যারা শত ঝঞ্ঝা আর প্রতিকূলতার মধ্যেও গণতন্ত্রের ছাতা নিয়ে রক্ষা করেছে সংখ্যালঘু মুসলমানের শান্তি, সম্প্রীতি আর উন্নয়ন? নিশ্চয়ই পারবো।

Comments :0

Login to leave a comment